
বাংলার শব্দকথা, লেখক-ডা. নৃপেন ভৌমিক, প্রকাশক-অবসর প্রকাশনী, মূল্য-১২০০ টাকা
খ্রিষ্টবর্ষ গণনা শুরুর প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্ব থেকে সুদীর্ঘকালের অভিধান চর্চার ধারায় এসেছে নানা বৈচিত্র্য, নানা বৈশিষ্ট্য। নিজ ভাষার সঙ্গে অন্য ভাষার ভাব বিনিময়ের উদ্দেশ্যে অভিধান চর্চা শুরু হলেও ক্রমে এর ব্যাপ্তি বেড়েছে- সন্নিবেশিত হয়েছে আরও বৈশিষ্ট্য। এসেছে শব্দানুষঙ্গ সন্ধান, প্রতিশব্দ নির্ণয়, শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্ধারণ, উচ্চারণ নির্দেশ, বানান নির্দেশ, ব্যাকরণগত তথ্যসন্ধান, শব্দার্থের সীমানির্দেশ, শব্দপ্রয়োগের ধারানির্ধারণ, শব্দ প্রয়োগের দৃষ্টান্ত উপস্থাপন ইত্যাদি নানা বিষয়। যুক্ত হয়েছে সমার্থক, ভিন্নার্থক এবং বিপরীতার্থক শব্দসন্ধান। শব্দ এবং শব্দার্থধারার বাইরে যুক্ত হয়েছে বিষয়ভিত্তিক অভিধান। এসেছে বিশেষার্থক অভিধান, বিষয়ভিত্তিক অভিধান। সংকলিত হয়েছে তারিখ-অভিধান, পরিভাষাকোষ ইত্যাদি নানা অভিধান। উদঘাটিত এবং সংকলিত হয়েছে শব্দের উৎসানুষঙ্গ।
এসবের বাইরে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে নানা বৈচিত্র্যসমৃদ্ধ ভিন্নধারার এক কোষগ্রন্থ। একে কোনো বিশেষ অভিধায় অবিহিত করা কষ্টসাধ্য নয়, দুঃসাধ্য; 'বাংলার শব্দকথা' শিরোনামের এক বিশাল গ্রন্থ। ডা. নৃপেন ভৌমিক রচিত এই গ্রন্থের ভূমিকায় গ্রন্থকারের বক্তব্য উদ্ধৃত করে গ্রন্থের বিষয়-বৈচিত্র্য সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে। তিনি লিখেছেন-
'নিছক কৌতূহলের বশে বাঙালির অত্যন্ত পরিচিত কিছু বাংলা শব্দের উৎস সন্ধান করতে গিয়ে তাদের ব্যুৎপত্তি অনুসরণ করে এবং অর্থ পরিবর্তন অনুধাবন করে প্রাচীন বাংলার অজ্ঞাত জীবনচর্চার কিছু কিছু ইতিহাস জানতে পেরেছি। এর ফলে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়েছে বাঙালির পরিচয়, তার ভাষা, চারিত্রিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য, ধর্মবিশ্বাস, জাতিভেদ সমস্যা এবং সংস্কার-কুসংস্কারের বিভিন্ন দিক। তারপর একে একে উদ্ঘাটিত হয়েছে বাঙালির ঘরবাড়ি, ঘরসংসার, আসবাবপত্র, বাসনকোশন, রান্নাবান্না, খাবারদাবার, মসলাপাতি, পিঠাপুলি, মন্ডামিঠাই, কাপড়চোপড়, সাজগোজ, প্রসাধন, গয়নাগাটি, উৎসব-অনুষ্ঠান, বাদ্যযন্ত্র, লোকগীতি, খেলাধুলা, ব্যবসাবাণিজ্য, অসুখবিসুখ, গালিগালাজ ও পদবি ইত্যাদির ইতিবৃত্ত। এ ছাড়া বাংলার খেতখামার, জলাশয়, গাছগাছালি, ফলফলাদি, শস্যফসল, শাকসবজি, পশুপাখি, পথঘাট, যানবাহন ও মুদ্রাব্যবস্থার কথাও উঠে এসেছে।'
গ্রন্থসূচিতে আছে আরও বৈচিত্র্য। ৪৩ মূলবিষয় এর ২২৫ বিষয়ধারার সূচিপত্রই তার প্রমাণ। গ্রন্থটি সাজানো হয়েছে বিষয়ভিত্তিক ক্রমন্যাসে।
গ্রন্থের শিরোনাম 'বাংলার শব্দকথা' হলেও এর পরিসীমা কেবল 'শব্দকথা'র সীমায় সীমাবদ্ধ থাকেনি; হয়ে উঠেছে আরও কিছু, অন্য কিছু। 'শব্দকথা' চাপা পড়ে গেছে বাঙালি জীবনের অজস্র বিষয়ের উৎস সন্ধানের গভীরতায়; যা সহজেই পাঠকচিত্তকে নিয়ে যায় বিষয়ের অতল গভীরে। পাঠকহৃদয় আপনমনে বলে ওঠে 'হেথা নয়, হোথা নয়- অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে।' এই 'অন্যকিছু' সন্ধানী বাঙালি পাঠক সহজেই খুঁজে পেতে পারেন তার ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, বিশ্বাস-অবিশ্বাস ইত্যাদির পরিচয়-নির্যাস।
বর্তমানে বাঙালি জাতির বাস্তবরূপ- রাজনৈতিক-ভৌগোলিক বিভাজনের কারণে কাঁটাতারের এপার-ওপার বসবাস। কিন্তু এই বিভাজন যে কোনো জাতিসত্তা কিংবা তার বিশ্বাস-সংস্কৃতিকে আলাদা করতে পারে না তারই এক প্রামাণ্য দলিল চিকিৎসক নৃপেন ভৌমিকের 'বাংলার শব্দকথা'। ব্যক্তিগতভাবে নৃপেন ভৌমিক শরীরবিজ্ঞানী। এই শরীর মানুষের শরীর, আর তার বিশেষায়িত অবস্থান স্নায়ু, যা মানবভাবনার সূতিকাগার কিংবা পীঠস্থান। সবার ওপরে তিনি শল্যবিদ।
'বাংলার শব্দকথা' নির্মাণে শল্যবিদ নৃপেন ভৌমিকের দৃষ্টি মানব-শরীর কিংবা মানব-স্নায়ুর দিকে নয়, বরং বাংলা শব্দভান্ডারের গোলাঘরের দিকে। সেই গোলাঘরের দরজা খুলে তিনি প্রবেশ করেছেন বাংলা শব্দভান্ডারের বিপুল সংগ্রহশালায়: খুঁজে পেয়েছেন বাংলা শব্দের রত্নভান্ডার। সেই শব্দভান্ডার পাঠকসমীপে উপস্থাপন করলে তিনি হয়ে উঠতেন সার্থক 'অভিধানকার'। কিন্তু গ্রন্থের ভূমিকার শুরুতেই তার সোচ্চার উচ্চারণ 'প্রথমেই বলে রাখা ভালো, এটি অভিধান নয়'; ঠিক তাই 'বাংলার শব্দকথা' অভিধান নয়। তবে এর ভিত্তি 'শব্দ' বা 'শব্দসন্ধান', তাই অভিধানের ঘ্রাণসমৃদ্ধ। কেবল শব্দ কিংবা শব্দসন্ধানেই সীমাবদ্ধ থাকেননি শল্যবিদ নৃপেন ভৌমিক; বরং তিনি তার নিত্যসঙ্গি সূক্ষ্ণ-শানিত শল্যাস্ত্র-মন নিয়ে দৃষ্টির গভীর নিরিখে অবলোকন করেছেন শব্দসমূহের অতলরূপ। খুঁজে এনেছেন সেই শব্দনির্ভর বিষয়-আশয়ের তলদেশস্থিত ইতিহাস-সংস্কৃতির রূপ-রূপায়ব। কেবল তুলে এনেই ক্ষান্ত হননি, বরং পাঠক স্নায়ুর দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছেন এর যথার্থ মর্মকথা।
সুপ্রাচীনকালের গ্রিক সাহিত্যতাত্ত্বিক অ্যারিস্টটল উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হোমিও চিকিৎসাসূত্রের ভিত্তিতে মোক্ষণ, বিমোক্ষণ বা ক্যাথারসিস প্রসঙ্গ ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি তার 'পোয়েটিকস' গ্রন্থে। বলেছেন বড় দুঃখ ছোট দুঃখকে বিলীন করে দিয়ে মানবমনকে হালকা করে দেয়, তাই ট্র্যাজেডি বা দুঃখের নাটক দেখে দর্শক আনন্দ পায় এবং এর ভিত্তি হোমিওপ্যাথিতত্ত্ব।
আমরা গর্বিত আধুনিক কালের মানব-স্নায়ুশল্যবিদ নৃপেন ভৌমিক তার অধীত বিদ্যা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে বাংলা শব্দভান্ডারকে মানব-স্নায়ুর দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া যায়। এর মাধ্যম তার সরস ব্যাখ্যা বিশ্নেষণ ও পরিবেশনার অনন্য কৌশলবৈশিষ্ট্য; যা আপনসন্ধানী বাঙালিমানসে চির অম্লান হয়ে থাকবে বলেই বিশ্বাস।
মন্তব্য করুন