
বেশ আমূল বদলে ফেললেই কি ছদ্মবেশ, বেশও কি ছদ্মবেশ নয়?
আদতে পোশাক, চুলের স্টাইল, সাজসজ্জার সরঞ্জাম- এসবই তো পৃথক করে মানুষকে! নইলে কেবল চামড়া আর অগোছালো চুলের বেষ্টনীতে মানুষ যদি মাটির কাছে নতজানু হয়, তবে তাকে দেখতে হয়তো আর যে কারও মতোই দেখায়। জন্মের পর থেকে বেড়ে ওঠার পথে বেশভূষা, কথা বলার কায়দা, যা মানুষ দিনের পর দিন দেখে দেখে রপ্ত করে তা কেবল নিজের সেই অনুভূতিহীন, অভিব্যক্তিবিহীন মুখটাকে ঢাকার জন্য। একের পর এক প্রলেপে শরীর ঢেকে ঢেকে সে একদিন বাইরের মানুষের সামনে নিজেকে সুনির্দিষ্ট ছকে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে পারদর্শী হয়ে ওঠে। আর তখন সামনের মানুষটি কেবল তার সাজানো ব্যক্তিত্ব দেখে, ওই ছবিতেই তাকে চেনে, মনে রাখে। তার পোশাক, কথা বলতে বলতে তার হাত নাড়ানোর কায়দা, তার হাসি বা চুপ করে থাকা, এ সমস্ত কিছু মিলিয়েই তার অবয়বটা ফুটে ওঠে। প্রকৃতির কোল থেকে ফুঁড়ে বের হওয়া প্রাকৃতিক মানুষটির এ এক ছদ্মবেশই বটে।
অথচ সাজানো, বানানো সেই ছদ্মবেশ শরীরের অপরিহার্য অঙ্গের মতো প্রতি সকালে পরিধান করতে করতে সেটিই হয়ে দাঁড়ায় চেহারা। চেহারাই তখন এক রকমের ছদ্মবেশ। মানুষটা আসলে কে, কী চায়, কীসে খুশি হয়, কেবল সে নিজে জানে, জানায় না কাউকে। ধীরে ধীরে ছদ্মবেশটা তাই হয়ে ওঠে তার অভ্যস্ততা। নিজেকে নিয়মকানুনের মধ্যে বেঁধে ফেলার পর নিয়মের ঘেরাটোপ সে নিজেই ভাঙতে পারে না। কখনও ভুলে ভাঙলে নিজের মনেই বলে-
এ তো মোটেই আমার মতো নয়!
প্রতিটি মানুষেরই নিজস্ব বেশভূষার মধ্যে ঘুরপাক খাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। অন্তত সুনির্দিষ্ট গণ্ডিতে। বাড়ির সদস্যদের কাছে তার একরকম চেহারা থাকে, কর্মক্ষেত্রে আরেক। আবার বন্ধুদের কাছে এক তো রাস্তাঘাটে আরেক। বলতে গেলে প্রত্যেকটি দর্শক-শ্রোতার সামনে মঞ্চের চৌকশ অভিনেতার মতো সাবলীলভাবে মানুষ এতটুকু কালক্ষেপণ না করে বেশভূষা, অর্থাৎ মুখের ভঙ্গি, আচার-ব্যবহার বদলে ফেলতে অভ্যস্ত। আবার সেই অভ্যস্ততা সে নিজেই সে ভাঙতে পারে। এ যেন এক মুখোশের ওপরে আরেক মুখোশ চড়ানো। বিচিত্র কারণে মানুষ ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃতভাবে ছদ্মবেশ ধারণ করে। তবে যে কোনো সমাজে ছদ্মবেশ সম্পর্কে সাধারণত নেতিবাচক কিছু ধারণা জড়িয়ে থাকে। মানুষ ছদ্মবেশ ধারণ করে যেন কেবল ক্ষতিই করার জন্য।
এ রকম ধারণার পেছনে কারণও আছে বটে। বেশভূষা বদলে, গলার স্বর পরিবর্তন করে, চুল-দাড়ি-মোচের নকশা বা হাতের লেখা বা স্বাক্ষর নকল করে প্রতিদিন কত কত মানুষকে প্রতারণা করা হয় তার হিসাব নেই। মানুষকে বোকা বানানোর মতো সাধারণ ব্যাপার থেকে শুরু করে হত্যা বা সর্বস্ব আত্মসাতের মতো ভয়াবহ অপরাধের সঙ্গে ছদ্মবেশ নামের শব্দ জড়িয়ে থাকে। প্রত্যেকেই জীবনে কিছুদিন বাদে থমকে গিয়ে ভাবে, ও আচ্ছা, ওটা তবে ওর মুখোশ ছিল। নিজেকে লুকোনোর যাবতীয় প্রচেষ্টা, তা হোক কথাবার্তায় বা পোশাকে বা কাজে, তাকে এক শব্দে মুখোশ বললেই বোঝানো হয়ে যায় ছদ্মবেশ। তবে কোনো কোনো ছদ্মবেশ দীর্ঘস্থায়ী হয়। কোনোটা হয় অল্প সময়ের জন্য, সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধনের জন্য। কোনো ছদ্মবেশ প্রয়োজনে মানুষ বারবার ধারণ করে।
দুর্ঘটনা বা প্রতারণা যখন ঘটে তখন ছদ্মবেশ নিয়ে মানুষ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। কিন্তু দৈনন্দিন ছদ্মবেশ নিয়ে সাধারণত মানুষের কোনো প্রতিক্রিয়া থাকে না। পরিচিত টেকো মানুষ হুট করে পরচুলা পরে ঘুরতে পারে, আবার কেউ চুলের রং বদলে দিতে পারে মুহূর্তেই, এ নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। ছদ্মবেশ এই প্রসঙ্গে জীবনের সঙ্গে এখন এমনভাবেই জড়িয়ে আছে যে বলা যেতে পারে, এখন কেউ কারও প্রকৃত চুলের রং জানে বলে বাজি ধরতে পারবে না। কিন্তু রোদচশমায় কথা বলা, চোখ ঢেকে রাখলে যেমন কারও কোনো আপত্তি নেই, তেমনি চুলের বা ঠোঁটের রং নিয়েও নেই।
আপত্তি তো দূরের কথা, ছদ্মবেশ কখনও মজা। ইচ্ছে করে করা হয়। আবার হতে পারে তার প্রতিযোগিতাও। কে নিজেকে কতটা লুকোতে পারে, ছদ্মবেশের মাধ্যমে দেখে নেওয়া যেতে পারে। ছোটকালে স্কুলে কতজনই তো 'যেমন খুশি তেমন সাজো' প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে, ব্যক্তিত্বকে লুকিয়ে অন্য কেউ হয়ে যাওয়ার প্রথম পাঠ হয়তো অনেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পেয়ে গেছে। কাদা মেখে মূর্তি সাজার পরে হয়তো সহপাঠীও একজনকে চিনতে পারেনি। অপ্রত্যাশিত চরিত্রের পোশাক আর সাজসজ্জায় কেউ চমকে দিয়েছে শিক্ষক আর বন্ধুদের। পশ্চিমা সংস্কৃতিতে ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান, হ্যালুইনের রাতে কিম্ভূতকিমাকার সেজে প্রতিবেশীদের চমকে দেওয়ার কায়দা রপ্ত করতে কে না ভালোবাসে। কলিংবেল বাজিয়ে ভূত সেজে প্রতিবেশীর দরজায় ক্যানডি বা মিষ্টি কোনো খাবারের জন্য ঝুড়ি বাড়িয়ে ধরে তাকে বিস্মিত করার মজা আছে। এশিয়ার সংস্কৃতিতে সাদা কাপড়ে ভূত সেজে ঘুটঘুটে অন্ধকারে কাউকে ভয় দেখানো জনপ্রিয় একটি মজার ধরন।
কখনও মজা করাটা এমনই হয়ে দাঁড়ায় যে যার সঙ্গে করা হয় তার ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। দাঁত কপাটি লেগে যাওয়া বা অজ্ঞান হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। বিজ্ঞানের উন্নতির যুগে মানুষ অনলাইনে ব্যস্ত থাকায় ছদ্মবেশের এসব সাধারণ মজা হয়তো এখন কমই হয়। তবে ছদ্মবেশ ধারণ করে বা কল্পিত ঘটনাপ্রবাহ সাজিয়ে মানুষকে বোকা বানানো বা চমকে দেওয়া এখন অনলাইন ভিডিওর একটি জনপ্রিয় ধারা। যাকে বলে, প্ল্যাঙ্ক ভিডিও। প্রযুক্তির সংযোজন হওয়াতে স্বাভাবিকভাবে একই কৌতুক নিয়ে মানুষ ভিন্নভাবে উপস্থিত হয়।
ছদ্মবেশ বিষয়টা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে অপরাধী ধরনের লোকেরা। যে কোনো অপরাধী, যেমন- সন্ত্রাসী, জঙ্গি, অপরাধ সংঘটনে গোপন প্রতিনিধি। এ সমস্ত বিষয়ে নিয়োজিত মানুষ সচরাচর মুখোশ অর্থাৎ এক ধরনের ছদ্মবেশ ব্যবহার করে। এই ছদ্মবেশ হতে পারে পোশাক বা সাজের সাহায্যে, হতে পারে সাধারণ চেহারাতেই, কেবল আচার ব্যবহারের মাধ্যমে। অপরাধীরা সাধারণত দীর্ঘ পরিকল্পনা নিয়ে একটি আবাসস্থল বা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করে, কাজ করে এবং সুযোগ বুঝে দাও মারে। কেউ একা, কেউ সংঘবদ্ধভাবে সম্পত্তি হরণ করে বা সম্পর্কে চির ধরায়। ছদ্মবেশে এসে বাসার বা প্রতিষ্ঠানের পাহারাদার সেজে ডাকাত হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ছদ্মবেশী প্রিয়জন খুন করে সম্পত্তি নিয়ে সটকে পড়ে। ছদ্মবেশে এসে মানুষ বিয়েশাদি করে সংসার পর্যন্ত করতে থাকে। এ রকম অসংখ্য উদাহরণ সামাজিক জীবনে থাকে। বাস্তব জীবনে রাজনীতিতে ছদ্মবেশে ব্যবহার জনপ্রিয়। এক দলের লোক অন্য দলে ছদ্মবেশে মিশে থাকে। তাদের দলের প্রতিনিধি হয়ে পরিকল্পনা আগেভাগে জেনে যায়। যেমন, মৌলবাদী দলের ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে তারা প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই বিদ্যমান দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের ছাত্রদের সঙ্গে ভিড়ে যায়, সুযোগ বুঝে তাদের পরিকল্পনা ভন্ডুল করে কিংবা দুর্বলতা বুঝে আক্রমণ করে। ছদ্মবেশী গুপ্তচরের কারণে রাজনীতিতে ভরাডুবি হবার, এমনকি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ারও প্রচুর উদাহরণ আছে। সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করে ইংরেজের হাতে ২০০ বছরের জন্য পরাধীন হয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী ছদ্মবেশী মীর জাফরের কথা কে না জানে। অনেকে আবার চাইলেও নিজের বেশ ত্যাগ করে সম্পূর্ণভাবে ছদ্মবেশী হতে পারে না। যেমন, নবাব সিরাজউদ্দৌলা সাধারণ মানুষের ছদ্মবেশ নিতে গিয়ে ভুলে গেলেন তার বাহারি নাগরা খুলে ফেলতে।
ক্ষমতা হারানোর ভয়ে কিংবা ক্ষমতা হারিয়ে যখন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতা পালিয়ে যান তখন ছদ্মবেশ নেওয়া ছাড়া তার হয়তো উপায়ও থাকে না। এমন অনেক উদাহরণ তো আছেই। তবে উদাহরণ তৈরি করারও উদাহরণ আছে। অ্যাডলফ হিটলারকে যখন জার্মানিতে আমেরিকার সৈন্যেরা খুঁজে পায়নি তখন ধরেই নিয়েছিল হিটলার ছদ্মবেশে জার্মানি থেকে পালিয়ে বাঁচবে। তাই কত রকমের ছদ্মবেশ সে নিতে পারে, তার সম্ভাব্য ছবি তৈরি করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল যাতে করে যে কোনো বেশেই তাকে চট করে ধরে ফেলা যায়। তাইতো তখন আমেরিকার ইন্টেলিজেন্সের সদস্যদের হাতে হাতে ঘুরছিল গোঁফ কামানো, বাস্তবের চেয়েও ভারি গোঁফওলা, বিচিত্র চশমা পরা, টাক মাথাওলা, বিভিন্ন আকৃতির দাড়িওলা, কপালের ওপরে ঢেউ খেলানো সিঁথি করা চুলের হিটলারের ছবি।
আবার শুধু দুর্ঘটনার সময়ে নয়, সাধারণভাবেও একজন রাজনীতিক ছদ্মবেশ গ্রহণ করেন, তার সবচেয়ে বহুল প্রচলিত উদাহরণ হলো, খলিফা হারুন-অর-রশীদ। তিনি রাতের অন্ধকারে দরিদ্র মানুষের ছদ্মবেশে প্রজাদের দুঃখ-দুর্দশা দেখতে বেরোতেন। সমস্যায় পতিত প্রজার সমস্যা ছদ্মবেশের ঘেরাটোপে সরেজমিন দেখে এসে পরের দিন তিনি সমাধান করতেন। ছদ্মবেশের এই বাস্তব কাহিনি কত মানুষকে প্রভাবিত করেছে তা বলা কঠিন। বহু মানুষ বিভিন্ন উদ্দেশ্যে হারুনের এই মহানুভবতার পথ অনুকরণও করেছে বটে। যেমন, ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরের নির্বাচনের কিছু আগে নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী নিজের কার্যকলাপ সম্পর্কে জনগণের মনোভাব জানতে চাচ্ছিলেন। যেই ভাবা সেই কাজ, প্রধানমন্ত্রী ইয়েন স্টলটেনবার্গ ট্যাক্সিচালকের ছদ্মবেশে শহর চষে যাত্রীদের খোলামেলা কথাবার্তা শোনা শুরু করলেন। পরে তিনি জানিয়েছিলেন যে মানুষ তার কাজের মূল্যায়ন কীভাবে করে সেটা জানার জন্য বিচিত্র পেশার যাত্রীর আলাপ শোনাকেই তিনি ভালো উপায় বলে মনে করেছেন। বলা বাহুল্য, কোনো কোনো যাত্রী তাকে চিনেও ফেলেছিলেন, তাদের আর ভাড়া গুনতে হয়নি।
বাস্তবে শুধু মানুষ কেন, প্রযুক্তিও নিতে পারে নানান ছদ্মবেশ। অপরাধী থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা কর্মী, এজেন্ট, যে কেউ তা ব্যবহার করতে পারে। যেমন, টর্চের মধ্যে লুকানো বন্দুক, বুকপকেটের কলমের মধ্যে ক্যামেরা, হাঁটতে সাহায্য করা লাঠির মধ্যে তীক্ষষ্ট তলোয়ার। এসব সত্তর-আশির দশকের জনপ্রিয় ছদ্মবেশী প্রযুক্তি এবং আজকের দিনেই সমান জনপ্রিয়। তবে হাল আমলে এক মোবাইল ফোনের মধ্যে ক্যামেরা, ব্যারোমিটার, আয়না, টেলিভিশন, সিডি প্লেয়ার, কতকিছুকে যে ছদ্মবেশে সেঁধিয়ে দেওয়া হলো, তার হিসেব নেই।
ছদ্মবেশকে গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে। বলতে গেলে ছদ্মবেশ এবং ছদ্মবেশের উন্মোচন সাহিত্য-চলচ্চিত্রের প্রধান উপাদান হয়ে আছে যুগের পর যুগ। যেহেতু ছদ্মবেশ মানুষের বেশের মতোই আদি অকৃত্রিম অভ্যাসের মতো, তাই কারণে-অকারণে মানুষ নানান ছদ্মবেশ ধারণ করে। সাহিত্য-চলচ্চিত্রে চরিত্রগুলো যেহেতু আমাদের বাস্তব জীবন থেকেই উঠে আসে, তাই তারাও নানান ছদ্মবেশের শরণাপন্ন হয়। ছদ্মবেশ গ্রহণ করে আর তা প্রকাশ করে পাঠক-দর্শকের মনে তোলপাড় করে দেয়। সেভাবে ভাবলে, ছদ্মবেশই রচয়িতার কল্পনার কিংবা সাহিত্য-চলচ্চিত্রের চালিকাশক্তি। ছদ্মবেশ চরিত্র, পটভূমি, কাহিনির মূল সুর উপস্থাপনে বড় ভূমিকা রাখে।
প্রাচীন জীবন বা জগৎ নিয়ে যেসব লোককাহিনি বা মিথ সমাজে প্রচলিত ছিল, ছদ্মবেশ সেখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেমন, পূর্ণিমার রাতে সুন্দরী নারীর ইচ্ছাধারী নাগিনী হয়ে যাওয়া, ঠোঁটে চুম্বন আঁকার সঙ্গে সঙ্গে কোলা ব্যাঙের রাজপুত্র হয়ে যাওয়া, ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী গাছের মগডালে বসে জ্ঞানীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া, সুনির্দিষ্ট পুকুরে ডুব দিয়ে ঘুঁটেকুড়োনির রাজকুমারী হয়ে যাওয়া আর রাজকুমারীর ঘুঁটেকুড়োনী, অভিশাপে রাজকুমার-রাজকুমারী গাছ বা আসবাব হয়ে যাওয়া- ছদ্মবেশ সংক্রান্ত এসব ঘটনা-দুর্ঘটনার সঙ্গে পাঠক অহরহ পরিচিত হতো। একদিকে ঠাকুরমার ঝুলি, অন্যদিকে আরব্য রজনীতে ছদ্মবেশের কথা এসেছে পাতায় পাতায়। কাহিনিগুলো ছদ্মবেশের রহস্যে ঢাকা থাকায় পাঠকের মনে তৈরি করে তুমুল উত্তেজনা। এ কারণেই পাঠক কাহিনিগুলো মনের মধ্যে স্থান দেয় ও প্রজন্মান্তরে পৌঁছে দেয়। ওই কাহিনির সূত্র ধরে কে জানে পৃথিবীর তাবৎ কোণে কত কত কাহিনির সৃষ্টি হয়েছে।
প্রযুক্তির শুরুর দিক থেকে ওয়াল্ট ডিজনির কার্টুন থেকে শুরু করে আজকের দিনের শিশু-কিশোর বিনোদন, সবই প্রায় ছদ্মবেশের ওপরে নির্ভরশীল। তাই তো সেদিনকার ছদ্মবেশী চরিত্র হাওয়ায় ভেসে আজকের হ্যানা মন্টানায় ভর করে, যে দিনে বোকাসোকা তরুণী, রাত হলেই বিখ্যাত পপ গায়িকা। ওয়াল্ট ডিজনির বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট-এ তরুণী রাজপুরীতে গিয়ে দেখে অভিশপ্ত বাড়িটিতে পাইক-পেয়াদা চেয়ার-টেবিল, পেয়ালা-পিরিচে পরিণত হয়ে আছে। গল্পের চরিত্রের এ রকম অভিশপ্ত নগরীতে উপস্থিত হওয়ার কাহিনি প্রায় সব দেশের রূপকথা বা মিথের মধ্যে বিদ্যমান, ডাইনি বুড়ি বা রাক্ষসী আসে সৎমায়ের ভূমিকায়, রাজকুমারীকে রাজ্যছাড়া করে বনের ভিতরে নিয়ে বন্দি করে রাখে। অন্যদিকে হিন্দু, বৌদ্ধ বা জৈন ধর্মের কাহিনি বা মিথগুলোতে ছদ্মবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। রাক্ষস-রাক্ষসী এই ধর্মগুলোর মিথের মধ্যে ছদ্মবেশে আবির্ভূত হয়। ইসলাম ধর্মের কাহিনিতেও শয়তান থাকে ফেরেশতার ছদ্মবেশে।
কল্পকাহিনিতে কিংবা চলচ্চিত্রে সুপার হিরো সম্পর্কে ধারণাই তৈরি হতো না যদি ছদ্মবেশ কাহিনির মূল জায়গা না হতো। ছদ্মবেশই কাহিনিতে স্পাইডার ম্যান, সুপার ম্যান, ওয়ান্ডার ওম্যান, বায়োনিক ওম্যান বা সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান-এর লুকানো চরিত্রটি বজায় রাখতে সাহায্য করে আর কাহিনির অন্য চরিত্রদের কাছে নিজেকে রাখে লুকিয়ে। যেমন, সুপার ম্যান কাহিনিতে ক্লার্ক কেন্ট চরিত্রে উপস্থিত হয় আর স্পাইডার ম্যান হয় পিটার পার্কার। ছদ্মবেশ কাহিনিতে প্রভাব বিস্তার না করলে কী করে জনপ্রিয় ড্রাকুলা সিরিজ তৈরি হতো! যে কোনো হরর সিনেমার জন্য ছদ্মবেশের বিকল্প নেই।
রহস্য বা স্পাই কাহিনি ও চলচ্চিত্রগুলোর কথা যদি ভাবা যায়, তবে স্বীকার করতেই হবে যে ছদ্মবেশের ধারণা বা প্রয়োগ ছাড়া সেগুলো লেখা ছিল অসম্ভব। জেমস বন্ড দুনিয়াজোড়া জনপ্রিয় তার ছদ্মবেশের জন্য। কেবল দর্শক জানে সে কার এজেন্ট- এ এক দারুণ মজা! শার্লক হোমস, ফেলুদা, ব্যোমকেশ, কিরিটি রায়- যার কথাই আলাপ করা যাক না কেন, ছদ্মবেশ ধারণ করা ছাড়া তাদের কাজ অসম্ভব। অন্যদিকে, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিতে দেখা যায় রোবট মানুষ সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিখ্যাত চলচ্চিত্র টার্মিনেটরের কাহিনিতে একাধিকবার ছদ্মবেশের আবহে কাহিনি এগিয়েছে। আর শুধু বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি কেন, সামাজিক বিখ্যাত কাহিনিও ছদ্মবেশকে কেন্দ্র করে মানুষের মনে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। রোমান হলিডে চলচ্চিত্রে দিনভর রাজকুমারীর সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের কাহিনি যে কোনো দর্শককে আপ্লুত করে বলেই অড্রে হেপবার্নের সেই মায়াময় সরলতা ভোলা যায় না। বলিউড চলচ্চিত্রে ছদ্মবেশ অত্যন্ত জনপ্রিয়। গোলমাল, চালবাজ, ইত্যাদি অসংখ্য চলচ্চিত্রে ছদ্মবেশ দর্শককে মাতিয়েছে। হলিউডের বিখ্যাত চলচ্চিত্র মিসেস ডাউটফায়ার ছদ্মবেশকে কেন্দ্র করে কিশোরদের উপযোগী চমকপ্রদ কাহিনি তৈরি করেছে। ক্যারি উইলিয়াম আয়া সেজে নিজেরই সন্তানদের দেখাশোনার ভার গ্রহণ করে সেই চলচ্চিত্রে। পরিবারের জন্য শিক্ষণীয় চমৎকার একটি কাহিনি গড়ে উঠেছে ছদ্মবেশের রহস্যের মধ্য দিয়ে।
সাহিত্য বা যে কোনো শিল্প নির্মাণে ছদ্মবেশ কাঙ্ক্ষিত। লেখক নিজের জীবনকেই নানান রং চড়িয়ে বারবার লিখে যেতে থাকেন। নিজেকেই লেখেন গল্পে, উপন্যাসে, আরও কত কতভাবে। যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তা লেখেন, যা কখনও দেখা হবে না জানা হবে না, তা-ও লেখেন। এই সমস্ত স্মৃতিচারণ আর জানতে চাওয়ার স্পৃহা তাকে কলম চালাতে বাধ্য করে। তবে লেখক যা লেখেন বা শিল্পী যে শিল্পকর্ম সৃষ্টি করেন তা তারই ছদ্মবেশ। বলা যায়, নিজেকে লিখলেও তিনি কল্পিত কাহিনির আবহে লেখেন। তাই ছদ্মবেশের প্রতি পাঠক-দর্শকের সহনশীলতা না থাকলে শিল্প-সাহিত্যের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে।
সাহিত্য সংস্কৃতি কল্পকাহিনি সবকিছুর গণ্ডি ছাড়িয়ে ছদ্মবেশের বহুল ব্যবহার দেখা যায় বাস্তবের রাষ্ট্রীয় বাহিনির আচার আচরণে। তারা নিজেদের দাপ্তরিক পোশাক ফেলে সাধারণ পোশাকে দেশের যে নাগরিককে দরকার তার বাড়িতে চলে যান কিংবা যেখানেই তাকে পাওয়া যাবে সেখানেই পৌঁছে যান দলবদ্ধ-ছদ্মবেশে। গিয়ে ছদ্মবেশী কণ্ঠে বলতে পারেন-
'আমাদের সঙ্গে চলুন, দরকার আছে।'
মন্তব্য করুন