এক।। বাঘের ল্যাজ

ছদ্মবেশ কথাটিকে বা পদটিকে চিনবার আগেই নাবালককালে ছদ্মবেশ দেখার বন্দোবস্ত ছিল। সেখানে এটা বেশ উদযাপিত একটা কর্মকাণ্ড হিসাবেই বিরাজমান। এর নাম হলো 'যেমন খুশি তেমন সাজো'। মফস্বলের স্কুলগুলোতে এখনো এই কর্মকাণ্ডের জনপ্রিয়তা ক্ষুণ্ণম্ন হয়নি বলেই জানি। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় তো বটেই; এমনকি মাধ্যমিকেও। এই একটা মহোৎসব যেখানে চাকরিজীবী শ্রেণির বাচ্চাকাচ্চার পাশাপাশি তাদের পিতামাতাও শামিল হয়ে থাকতেন। এতটাই থাকতেন যে, অনেক ক্ষেত্রে শিশুসন্তানটি নিজ 'খুশি' অনুযায়ী 'সাজা'র বিশেষ সুযোগ পেত না। বরং, এটাই অনেক পরিচিত দৃশ্য হবার কথা যে, শিশুর মাতাপিতার 'খুশি'তে সজ্জিত শিশুটির এক বাহু ধরে হিড়হিড় করে স্কুল ময়দান পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছেন তার মাতা বা পিতা। আশপাশে সুলভ থাকলে চাচাও হতে পারেন। এ রকম দৃশ্যে শিশুটিকে খুশি কম, ও বিপর্যস্ত অধিক দেখাত। তবে সেটা আমার দেখার গুণ বা দোষও হতে পারে। শিশুটি বরং পুনরায় উদ্ভাসিত হবার সুযোগ পেত যখন স্কুল ময়দানে সত্যিই এই ইভেন্টখানি হতো। সাধারণত বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার শেষ বা প্রায়শেষ অংশে থাকে এটা। যদি অফিসার গৃহিণীদের 'বাদ্যবালিশ' প্রতিযোগিতার আয়োজন না হয়, তবে এটা অবশ্যই শেষ আইটেম। এটাতে বিশেষ কোনো বিতর্ক নেই যে, এই সাজাসাজির মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় সাজ বহুকাল যাবৎ থেকে এসেছে ভিক্ষুক বা ভিখিরি বা কোনো কোনো অঞ্চলে যাকে ফকির বলা হয়ে থাকে তার সাজ। এখন ফকির আর ভিখিরি এক কাতারে এলো কবে ও কীভাবে, সেটা নিয়ে আলাপের দরকার পড়তেই পারে। কিন্তু সেই আলাপের যোগ্যতা আমার নেই। কিংবা সেই আলাপ করার চেষ্টা করলে যে আলাপ শুরু করেছি, তার দিশা পাওয়াও সম্ভব নয়। অন্যদিকে, কেন ভিখিরি-সাজ চাকরিজীবী পরিবারগুলোতে এবং তাদের প্রতিপালনাধীন শিশুদের কাছে এতটা পছন্দের, এই বিষয়ে উল্লেখ করার মতো কোনো গবেষণা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। তবে এসব কর্মকাণ্ডের পর কোনো ভিখিরিকে আমি গাইতে শুনিনি :'মোরে ভিখারি সাজায়ে কী রঙ্গ তুমি করিলে...'। মনে হয় না যে এই গানটা 'খাঁটি' ভিখিরিরা তেমন বিশেষ জানে কিংবা শিখতে বাসনা করে।

ছদ্মবেশ শব্দটাকে চিনতে সময় লাগলেও এর সন্নিকট আরেকটা শব্দ এর আগেই চেনা হয়ে গিয়েছিল। সেটা হচ্ছে 'বহুরূপী', এবং ঘটেছে শ্রীকান্ত উপন্যাস পড়তে গিয়ে। যতটা মনে পড়ে, শ্রীকান্ত উপন্যাসের অংশবিশেষ তখন উচ্চ মাধ্যমিক পাঠ্যসূচিতে ছিল; মাধ্যমিকে নয় বলেই মনে পড়ে। ঠিক পরের শিক্ষাবর্ষ থেকে পাঠ্যসূচিতে বেশ কিছু বদল আসে। ভেবেছিলাম, এটা শিক্ষাবর্ষের হিসাবে বলব। কিন্তু বাংলাদেশ দশম শ্রেণির পরে যেভাবে একটা বছর শুভঙ্করের ফাঁকিতে ফেলে দেয়, কর্তৃপক্ষ তাতে সহজে শিক্ষাবর্ষ বলা সম্ভব নয়। তাহলে এভাবে বলা যায় যে, যারা মাধ্যমিক দেন ১৯৮৫ বা তার পরে, তাদের পাঠ্যসূচি আমাদের থেকে আলাদা ছিল। কিন্তু শ্রীকান্ত উপন্যাসের সব খণ্ডই পড়বার জন্য আমি অনেকের মতোই উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত অপেক্ষা করিনি। সেখানে প্রথম খণ্ডেই রাতের বেলা এক বহুরূপী এসে হাজির হন শ্রীকান্তদের বাড়িতে। বাঘ সেজে এসেছিলেন তিনি। বাড়ির মধ্যে ভয়ে হুলস্থুল পড়ে গিয়েছিল। শোরগোলে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বহুরূপী তখন ডালিম গাছের তলায় বা কোনো একটা জায়গায় লুকিয়ে পড়েন। শ্রীকান্তের বন্ধু ইন্দ্রনাথ সিংহহৃদয় মানুষ। তিনিই বাতি নিয়ে কাছে গিয়ে দেখেন, ওটা বাঘ নয়; বহুরূপী। সমাজে যে 'বহুরূপী'র একটা গুরুতর রকমের নেতিবাচক ইমেজ আছে, সেটা কিছুতেই ওই পঠন-অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা সম্ভব ছিল না। আমার তো নয়ই, আমার ধারণা; বহু শিশু-পাঠকেরই এক দশা হবার কথা। ওই রাতে বাড়িসুদ্ধ লোককে ভয় দেখানোর অপরাধে বহুরূপী তথা বাঘরূপী মানুষটির যত্ন-করে-বানানো ল্যাজখানা কেটে নেবার শাস্তি দেওয়া হয়। আমার মনে পড়ে, উপন্যাসে পড়েছিলাম, বহুরূপী তখন হাতজোড় করে সকলের কাছে মাফ চাইছিলেন, বিশেষত তার ল্যাজখানাও রক্ষা করতে চাইছিলেন। আমার মনে হয় না, এই করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে ল্যাজ রক্ষাকারী ভূমিকাকে নিছক তার শৈল্পিক চেতনা বা আর্টিস্টিক ক্রিয়েশনের প্রতি মমত্ব হিসাবে দেখা ঠিক হবে। এটা বরং তার এই সাজসজ্জার জন্য খরচাপাতির প্রতিই মায়া বটে। তিনি এসেছিলেন বস্তুত মনোরঞ্জন করে কিছু বখশিশ পাবার আশায়। বখশিশ ততক্ষণে দুরস্ত হয়ে গেছে। তিনি তার ইতোমধ্যেই দুরূহ-পালনীয় জীবনে লগ্নি করে-ফেলা টাকাগুলো যাতে গচ্চা না যায় সেই চেষ্টায় হাতজোড় করে ক্ষমা চাইছিলেন। শিল্পীর মর্যাদার চেয়ে ল্যাজের দাম তার বহুরূপী জীবনে বহুমূল্য হয়ে পড়েছিল।

দুই।। মাল্টিটাস্কিং মনু মিয়া

ধরা যাক মনু মিয়া। নামটা হয়তো বড় বিষয় নয়। কিন্তু আবার বিশাল বিপর্যয়কারী বড় বিষয় এতটাই যে, যে-বিষয় নিয়ে এখানে বলতে চাইছি তাতে এই লোকটির নাম মনু মিয়া না হয়ে মুহসিন মির্জা বা মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় হলেই তাকে ছদ্মবেশী মনে হতে পারত। তিনি হেন কাজ নাই যে করেন না। প্রথম দিন যখন আপনার বাড়িতে (বা ভাড়া-বাসাতে) বিদ্যুতের কোনো একটা ঝামেলা দেখা দিয়েছে তখন আপনি পাড়ার মোড়ের দোকানে গিয়ে জিজ্ঞাসাপাতি করে এর খোঁজ পেয়েছিলেন। কিংবা এমন হতে পারে, এসব বিষয়ে লোক খোঁজাখুঁজির মতো সাধারণ কোনো পেশাজীবী আপনি নন। তাতেও কিন্তু আপনার এই খোঁজটা থাকতেই হবে। সে ক্ষেত্রে আপনার গাড়িচালক খুঁজে আনবেন কিংবা হয়তো ফ্ল্যাটবাড়ির দারোয়ানের নির্ধারিত কাজ এটা। খুঁজে আনবেন। সাধারণত এই লোকগুলো একবার দুইবার বা একটা দুইটা ফ্ল্যাটে আসতে থাকলে অন্যরাও কীভাবে যেন তাকে পেয়ে যান। ফলে এই সম্ভাবনাও আছে যে, মনু মিয়ার একটা মোবাইল ফোন নম্বর আপনার কিংবা আপনার ড্রাইভার কিংবা দারোয়ান কিংবা পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশীর কাছে ছিলই। এর পর শুধু ডেকে সময়টা ঠিক করা, আর আসতে হুকুম করা।

মনু মিয়া যতক্ষণ সুইচ বোর্ড খুলে কিংবা পাখার উপরের প্লাস্টিকের কৌটাখানি খুলে সারাই করছেন, ততক্ষণ তার সাথে সহকারী থাকলে তিনি তার সাথে গম্ভীর মুখে হুকুম-টুকুম সারতে পারেন। চেয়ার বা অ্যালুমিনিয়ামের মই ঠিক করতে বলতে পারেন, তার কিংবা প্লায়ার্স চাইতে পারেন। কোনো কারণে তিনি একা এসে থাকলে চুপচাপ থাকতে পারেন। কিন্তু ব্যাপক সম্ভাবনা আছে যে তিনি কাজের ফাঁকে ফাঁকে আপনাকে কিংবা আপনার বাসার প্রাপ্তবয়স্ক আর কোনো মানুষকে, পুরুষ হলেই ভালো, লাগাতার বিবরণী দিয়ে চলেছেন। এই বিবরণীর একাংশ হতে পারে এই সমস্যা তিনি ঠিক করে গেলে আর যে হবে না সেটার ঘোষণাপত্র। আরেক অংশ হবার কথা আগামীতে অন্য কোনো সমস্যায় পড়লে যেন আপনারা তাকেই ডাকেন। তিনি হাত খালি থাকলে দুই মিনিটের মধ্যে যে এসে হাজির হয়ে পড়বেন- সেই প্রতিশ্রুতিও তিনি দিয়ে বসতে পারেন। আরেকটা অনিবার্য অংশে তিনি জানাতে পারেন, কেবল বিদ্যুৎমূলক সমস্যাতেই না; তাকে ডাকা যেতে পারে গ্যাসচুলার ভেজাল বাধলে; পানির লাইনের কোনো ঝামেলা হলে। অতিউৎসাহী সংলাপে তিনি যদি কাঠের কাজের জন্যও চলে আসবেন বা কাউকে পাঠিয়ে দেবেন বলে বসেন; তাতেও আসলে আপনার চমকে যাবার কিছু নেই। এই অন্য কাউকে পাঠিয়ে দেবার বিষয়টা ছোটবেলা বইয়ে আপনারা পড়েছেন। এর নাম সিমবায়োসিস কিংবা মিথোজীবিতা। গরিবেরা এগুলো বই না পড়েই শিখে ও প্রতিপালন করতে থাকেন। সে যাহোক, তিনি নিজেই আসতে চেয়েছেন ধরে নিয়ে যদি ভাবি, আপনি তার 'জুতা-বুরুশ থেকে খুন-খারাপি' জব ডেস্ট্ক্রিপশন শুনে বলে বসলেন, 'ওই মিয়া, তুমি আসলে কোন কাজটা করো?' এই দুর্ঘটনা বা চ্যালেঞ্জটি আসলে মনু মিয়া তার জীবনে লাগাতার পেয়ে আসছেন। ফলে তার আপনার এই চ্যালেঞ্জে কাবু না-হয়ে পড়ার ব্যাপক সম্ভাবনা আছে। আপনার এই অথেনটিসিটি যাচাইমূলক আক্রমণটার বিপরীতে প্রথম আধা সেকেন্ড যদি তিনি টিকে যেতে পারেন, তাহলে সম্ভাবনা আছে যে তিনি উত্তর করবেন :'স্যার, কী যে বলেন না! এইগুলা সেই কবে থিকা কইরা আসতেছি!' এই কথাটার ভিতর সত্য আছে, গভীরতা আছে; অস্তিত্বের ঘোষণাপত্র আছে; প্রাত্যহিকতার প্রামাণ্য আছে। তবে ঠিকই, আপনি যে দক্ষতার সনদপত্রমূলক খাঁটিত্বের গোয়েন্দাগিরি করতে চেষ্টা করছিলেন, সেই দক্ষতা পুরাটা না থাকতে পারে। কিন্তু আমার কিছুতেই সেটা নিয়ে আগ্রহ নাই। আমার আগ্রহ আছে মনু মিয়ার মাল্টিটাস্কার ব্যক্তিত্ব আর ভড়ং ধরার ব্যক্তিত্বের মধ্যকার ভেদকারী সীমানা আসলে কতখানি সূক্ষ্ণ, সেটা নিয়ে।

আপনার কালীক বাৎসল্যের কালে কিংবা সস্নেহ চাহনিতে যখন মনু মিয়ার নানাবিধ হাতচালানি আর মুখচালানির অন্তরঙ্গ গ্রাহক আপনি, তখন মনু মিয়া আপনার জন্য এক নিরন্তর মুশকিল আসানের নাম। মনু মিয়া দারুণ প্রাণবন্ত এক মাল্টিটাস্কার তখন। কিন্তু যদি বা যে মুহূর্তে আপনি সাব্যস্ত করে নেবেন যে আপনার পকেটের পয়সা হাতিয়ে নেয়াই মনু মিয়াদের জীবনের প্রধান লক্ষ্য ও কর্মকাণ্ড, তখন তার সকল অস্তিত্ব বিলোপের পথে, আপনার দরবারে। মনু মিয়া কোনো কাজে বা পরিচয়ে কতখানি দক্ষ বা মানানসই সেসব প্রসঙ্গ এখানে অবান্তর। যতই না মনু মিয়া আপনার পকেটের খুব সামান্য পয়সাই হাতড়ে নিতে পারেন এবং প্রায়শ গুরুতর কোনো দুর্ঘটনা আপনার বাসায় না ঘটলে একদম পারেন না, তবু প্লাম্বার-টু-কার্পেন্টার গতায়াত আপনার বিচারে এক ছদ্মবেশ, এক প্রতারণা মাত্র; প্রায়শ যার আটপৌরে নাম দেওয়া হয়ে থাকে ভড়ং বা বুজরুকি। অথচ আপনি বা আমি কত অনায়াসে সিভিল-প্রশাসক থেকে লেখক, শিক্ষক থেকে কবি, অফিসে ঠ্যাং-তোলা বস থেকে ক্লাইমেট বিশেষজ্ঞ হয়ে যেতে পারি! তবে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ এদিকেও হতে পারে। হয়ও বটে। এদিকে যেসব ভড়ংয়ের অভিযোগ ওঠে সেগুলো প্রায়শ ঈর্ষা ও অপ্রাপ্তিজনিত হবার সম্ভাবনা রাখে।

তিন।। ভনিতা আর চৌকসতা

ভান আর ভনিতার সূক্ষ্ণ পার্থক্য আছে কিনা; থাকলে সেটা কেমন তা জানা-বোঝার জন্য আমাদের নাট্যশাস্ত্রীয় ও কাব্যশাস্ত্রীয় পণ্ডিত আমদানি করা লাগবে। তাও পাশ্চাত্যীয়প্রকরণসম্পন্ন পণ্ডিত হলে চলবে না। চাইলে কিছু অনলাইন পড়ালেখা আমিও করার উদ্যোগ নিতে পারতাম। তবে অনাবশ্যক। কাব্য-নাট্যশাস্ত্রের বাইরে দৈনন্দিন কাজকর্মে এই দুই পদের একটাও ইতিবাচক কোনো অর্থ বহন করে না। ঠিক যেমন বাক্যালঙ্কার শাস্ত্রে রেটরিকের অর্থ দিয়ে রাজনীতি-সমাজবিদ্যার জগতে রেটরিকের মানে আর চলে না। কিন্তু আজকের দুনিয়ায় আলাপ-আলোচনা করতে বসে কোন অর্থটা কখন কীভাবে প্রয়োগ করছেন, সে বিষয়ে অসতর্ক থাকলে চারপাশ থেকে লোকে হারেরেরে করে তেড়ে আসবেন।

'আমি ভাই অত ডিপ্লোম্যাসি/মারপ্যাঁচ পারি না, যা মনে আসে বলে দিই'- এই ঘোষণাপত্রটি লাগাতার শুনতে থাকি। যেহেতু আমি জনদরবারে খুব একটা যাই না; আমার ধারণা, আপনাদের শুনতে হয় আরো বেশি। যদি নিজেই আপনি এই কথার প্রয়োগকারী হয়ে থাকেন, তাহলে সম্ভাবনা আছে যে শুনলেও আপনি বিশেষ টের পান না। এই কথা যতবার শুনি ততবারই আমার হূৎকম্প বেড়ে যায়; এর কী উত্তর করব তা ভেবে। যা মনে আসে তাই তো আমাদের বলবার কথা। আমার কথা তো আরেকজনের মন থেকে পেড়ে বা কেড়ে বলবার কথা নয়। তার থেকেও বড় বিপদটা হলো, এই কথার মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন ধমক বা হুমকি থাকে। সেটা হচ্ছে 'তুমি পেঁচায়ে কথা বলো, তুমি ছদ্মবেশী, তুমি অসরল গরলমনা।' ধরুন, আপনি তিন দিন লাগাতার অফিস করেছেন আর রাতে নেটফ্লিক্সে সিনেমা দেখেছেন (কিংবা আরো সফল পেশাজীবী হলে প্রজেক্ট রিপোর্ট লিখেছেন, বৈদেশ গমনের প্রপোজাল লিখেছেন বা বালিশ কেনার দরপত্র, যা-ই হোক)। এরপর শুক্রবার পেয়ে সকালের নাশতা সেরে দুপুর ১২টা নাগাদ সপ্তাহের জমানো ঘুম দিতে বসেছেন, মানে শুয়েছেন। দুপুর ৩টায় যখন প্রতিবেশী বা কলিগ-বান্ধব আপনাকে সারপ্রাইজ দিতে দরজায় টোকা দিলেন বা কলিংবেল বাজালেন; দরজা খুলে তখন হয়তো আপনার বলার কথা, 'শুক্রবার ৩টার সময় দরজায় নক দেন; মাথায় পুতা দিয়া বাড়ি দিমু।' কিন্তু তা না বলে আপনি সাধারণত বলেন, 'আরে না না। কী বলেন অসময়! আমিই বরং অসময়ে ঘুমায়ে গেছিলাম। আইসা ভালো করছেন। একত্রে চা খাই, চলেন।' আপনার এই বলার অভ্যাসের নাম ডিপ্লোম্যাসি বা মারপ্যাঁচ দেবার কোনোই কারণ নাই। এর নাম স্মার্টনেস বা চৌকসতা দেওয়া যায়। কিন্তু সেটাও পরিস্থিতি বিচারে বাহুল্য হবে। এর একটা নাম সৌজন্য বা সামাজিকতা। আর তা না চর্চা করার কোনো সংগত কারণ দেখানো মুশকিল। ফলে প্রায়শ 'খাঁটি' ও 'সরল' আচরণের দাবিদাররা যেটা করেন সেটাই হয়তো একটা ছদ্মবেশ, তুল্যবিচারে। তারা হয়তো চান যে আপনি তার মেজাজ-মর্জি, রাগ-ক্ষোভ, হেনস্তামূলক আচরণ বরদাশত করতে থাকুন, অন্তত এই কারণে যে তিনি 'খাঁটি' আচরণের মালিক। তাতে আপনার ফুরফুরে মেজাজের সময়টা যতই তিনি মাটি করে দিন না কেন।

কোন দৃষ্টিকোণ থেকে কোনটা যে ছদ্মবেশ হলো, তা বেশ ঘোরালো-প্যাঁচালো একটা বিষয়। আমাকে যদি জিজ্ঞাসা করেন, ১০০ বারের মধ্যে ১০০ বারই দরজার ওপারে 'ভনিতা' করলেন যিনি; যিনি বললেন, তিনি বিরক্ত হন নাই; তাকে গ্রহণ করব, যদি আদৌ ১০০ শুক্রবার বাংলাদেশি দুপুরে আমি কারো কারো দরজায় নক দিয়ে বসি। তাকে 'মুখোশধারী' সাব্যস্ত করার নৈতিক অহংকারের থেকে আমার জন্য অনেক জরুরি তার এই 'মুখোশ'-এর সাথে যোগাযোগের আরামখানি কবুল করা। আমাদের সকল মুখোশই জিব্রানের চুরি যাওয়া মুখোশ। মুখোশ হারিয়ে জিব্রান সাহেব মুক্তির স্বাদ পেতে পারেন, আমাদের জন্য মুখোশগুলো একেকটা যোগাযোগ-আউটলেট।

চার।। নতুন নতুন দরবেশ আর সাভারের যোগেশ

ছদ্মবেশ পদটির ল্যাজা বা সাফিক্স হিসেবে যে 'বেশ' আছে, তার সাথে দরবেশ পদটির ল্যাজা 'বেশ'-এর কোনোই সম্পর্ক নাই। কখনো ছিল না। আগামীতে যদি থাকতে থাকে; সেটার কারণ আমি হবো না। ফলে আজকে এই দুই পদের একত্র একানুচ্ছেদ প্রয়োগ আমার জন্য কেবলই সামান্য সাহিত্যচর্চা উত্তেজনা মাত্র। ব্যক্তিজীবনে আমি বা এই সাহিত্যপাতার পাঠকেরা দরবেশ খুব যে একটা বেশি দেখেছেন, বা আদৌ দেখেছেন, তার কোনো সম্ভাবনা নাই। বরং, এফডিসির জীবিতকালে দু'চারজন দরবেশ বড় বড় পুঁতির মালা গলায় করে জটিলতম সময়ে গাছতলায় ধোঁয়া-কুণ্ডলিত অবস্থায় বসে থাকতেন। নায়ক বা নায়িকাকে পথের দিশা দিতেন। ভৌগোলিক পথ দিতেন সামান্যই, দার্শনিক (আসলে ঐশী) পথ দিতেন অধিক। সেসব দরবেশকে কেউ ছদ্মবেশী ভেবে বসতেন না। সাহিত্য-চলচ্চিত্রে ছদ্মবেশী দরবেশ বলতে ওয়ালীউল্লাহ সাহেবের কীর্তি হিসেবে মজিদই কেবল মনের মধ্যে ঘুরঘুর করতে থাকেন। অধুনাকালে, এফডিসি বিলুপ্তপ্রায় বলে, বাচ্চাকাচ্চাদের দরবেশ চেনার নূ্যনতম সুযোগও হারিয়ে গেছে। লোকশ্রুতি অনুযায়ী, এখনকার নবীন প্রজন্ম দরবেশ বলতে কিছুই প্রায় চেনেন না; বা যা চেনেন তা জনদরবারে অকহতব্য। তাদের থেকে একটু বয়স্ক প্রজন্মের কিছু লোক কালেভদ্রে দরবেশ শব্দটির এমন ধরনের প্রয়োগ ঘটান যে, নবীনদের পক্ষে মাথামুণ্ডু বোঝার কোনো অবকাশও থাকে না। বলা চলে যে, অধুনা ঢাকার ভাষাপ্রবাহে দরবেশ কথাটির মনোপোলাইজেশন ঘটেছে। আর সন্দেহ নাই যে, তা ছদ্মবেশ কথাটিরই অনুরণন বহন করতে থাকে।

ছদ্মবেশ কথাটির নেতি-প্রকরণ আমার খুবই অপছন্দের। ছদ্মত্ব নিয়ে অনুসন্ধানটাই আসলে আমার অপছন্দের। সেটা এই কারণে নয় যে, আমি সকল কিছুতে 'খাঁটিত্ব' পেতে থাকি। এই কারণে যে, 'খাঁটিত্ব' নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই এবং অবশ্যই এই কারণে যে, ছদ্ম অনুসন্ধানকারীদের উদ্যোগ প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে খাপছাড়া, আপন-পর ভেদাভেদমূলক এবং বেহুদা নৈতিকতাপন্থি; কিছুতেই জনরাজনৈতিক উপলব্ধিসম্পন্ন নয়। লক্ষণীয় যে, প্রায়শ (পুরুষদের) লাগানো গোঁফ-দাড়ি নিয়ে মানুষের যে পরিমাণ আপত্তি; লাগানো চুল নিয়ে কাছাকাছি কোনো আপত্তিও কাজ করে না। তাহলে এই পড়ন্তকালে অমিতাভ বচ্চন আর ব্রডকাস্ট-যৌবন সালমান খান বা হর্ষ ভোগলে মাথায় চুল লাগিয়ে শান্তিতে থাকতে পারতেন না। চুল ও দাড়ির মধ্যে এই ভেদবিচার থেকেই বোঝা সম্ভব যে; ছদ্মত্ব অনুসন্ধান কতটা ফাঁপা।

বেশভূষার জগত আরো বিচিত্র, অথচ সরল। বেশভূষা স্মারকের মতো। মনুমেন্ট-সম। আপনার গায়ে লেগে আছে, অথচ যেন বা ঊর্ধ্বাকাশে দীপ্যমান একটা মিনার; আপনার অস্তিত্ব/সত্তার ঘোষণা দিয়ে চলেছে; আপনার মস্তিস্কে যা-ই থাক না কেন। আমি যে কোটটা পরেছি কিছুকাল, তা জওহর কোট নামেই লোকজন চিনতেন। কলকাতাতে তো বটেই। আজ সেই কোটখানাই পরা কোলকাতাতে বিস্তর প্রতিপক্ষতাময় (হবে); আজ তা মোদি কোট। এটার আর যে কোনো ব্যঞ্জনা ঢাকা শহরে নেই; তা এটার রং বিশুদ্ধ কালো-নয় বলে কেবল নয়; আমার পোশাক-দর্শকদের বড় অংশই আমাকে সেই ব্যঞ্জনায় কল্পনা করতে পারেন না বলে। এবং বিশ্বাস করুন, তারা এর থেকে অধিক পারেন আমাকে মোদিভক্ত ভাবতে, মনের গহীনে, গোপন কুঠুরিতে; অব্যক্তভাবে; কিন্তু পারেন, অনেকেই।

সাভারের পথে যেতে-যেতে, কর্মক্ষেত্রে যাবার পথে, বাসের পথের দু'ধারে আমি অজস্র ফেস্টুন দেখি। সারাবছর দেখি। বছরে কয়েকটা জাতীয় দিবসে সেগুলোর মাত্রা বাড়ে। হাজারে-হাজার। একেকটা ফেস্টুুন, চারটা করে নূ্যনতম বাঁশখণ্ড, অন্তত পাঁচটা করে মুখ, সাতটাও হতে পারে, কোনো কোনোটাতে তেরোটা, যার মধ্যে তিনটা মুখ চেনা। এর মধ্যে বড়মুখের মালিকরা নতুন করে আবার হাতাকাটা কোট বানিয়েছেন। চকচক করছে। খানিকটা নিশ্চয়ই স্ট্ক্রিন প্রিন্টের গুণ। আমি এগুলোকে ছদ্মবেশ ভাবি না। বেশ। ভূষা। বেশভূষা ভাবি। সমকালীন বেশভূষা। কোনো ছদ্মত্ব নেই, কেবল ঘোষণা আছে। যুতসই, স্পষ্ট ঘোষণা। তারপর ভাবি, যোগেশের মিষ্টান্ন দোকানে আজ কতই না মিষ্টি বিক্রি হবে! ভান-ভনিতাহীন জ্যান্ত মিষ্টি, জ্যান্ত লোকেরা খাবেন, জ্যান্ত নেতার পদপ্রাপ্তির আশায় দোয়া বা শুভাশিস জানাবেন। সকলই প্রকাশ্য অর্থ।