
টরন্টো শহরের সামার শুধু অপূর্ব বললে কম হয়, বলা উচিত স্বর্গীয়। চারদিকে সবুজের সমারোহ লেক ওন্টারিওর উথালপাথাল ঢেউ। এমন মাতাল করা দিনে অনুরুদ্ধ রশিদের মতো চার্মিং লোকের সঙ্গে দেখা যদি হয় তাহলে আর যায় কই।
আফরিনা মহসিনের অন্তরে যেন ঝিলিক দিয়ে উঠল। কে এই লোক!
বরেণ্য লেখিকা তাসলিমা হাসানকে আফরিনা জিজ্ঞেস করল-
ভাবি, ওই যে বাটিকের পাঞ্জাবি পরা লোকটি কে, চেনেন?
-চিনব না কেন, অনুরুদ্ধ রশিদ। কবিতা লেখে, ভালো আবৃত্তি করে এবং ব্যাংকে নাকি ভালো চাকরি করে। কেন তোমার ভালো লেগেছে?
-ধ্যাৎ, কী যে বলেন! আজকাল বাটিকের পাঞ্জাবি পরতে তেমন কাউকে দেখা যায় না। পরেছে লোকটা, তাই জনতে চাইলাম।
-আলাপ করিয়ে দেব?
-আরে না!
তাসলিমা হাসান তবু হাত তুলে ইশারায় অনুরুদ্ধকে কাছে ডাকলেন।
-এই অনুরুদ্ধ, ও হচ্ছে আফরিনা মহসিন। ছোট থেকে মা-বাবার সাথে মন্ট্রিয়লে ছিল। সবে টরন্টো এসেছে। ডাউনটাউন হিলটন হোটেলে কাজ করে। তোমার বাটিকের পাঞ্জাবি দেখে মুগ্ধ। জানতে চায় এই বাটিক কানাডায় কই পেলে?
তাসলিমা হাসানের কথা শেষ হওয়ার আগেই আরফিনা বাধা দিয়ে বলে উঠল-
অনেকদিন পর বাটিক দেখে ভালো লাগল বলেছি, মুগ্ধ হয়েছি বলিনি।
অনুরুদ্ধ কিছু না বলে মিটিমিটি হাসছিল, আর আফরিনা মহসিনকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখছিল। ভেতরে তার মন বলছে- এতদিন কোথায় ছিলে আফরিনা। তোমাকেই তো খুঁজছি!
বাইরে থেকে অনুরুদ্ধকে তেমন পুলক দেখাল না।
আফরিনা বুঝল ছেলের বেশ ইগো আছে। তাই সে আর কথা না বাড়িয়ে হাঁটা দিল পুডিং নিতে ডাইনিংয়ের দিকে। বেশ ক'পা এগিয়ে যেতে পেছন থেকে অনুরুদ্ধের ভারী ও আবৃত্তি চর্চিত কণ্ঠে শুনল-
আফরিনা জানবেন না কানাডার এই টরন্টোতে আমি এই বাটিক পাঞ্জাবি পেলাম কোথায়?
আফরিনা কাছে এলো না, যেখানে ছিল সেখানে দাঁড়িয়ে বলল-
বলেন, জানা থাকলে ভালো।
অনুরুদ্ধ বুঝল, মেয়েটা বেশ টেটনা আছে। হওয়াটাই স্বাভাবিক। কানাডায় বড় হয়েছে, পড়াশোনা করেছে, ভালো চাকরি করে, এ দেশের নাগরিক। একটু হাই হওয়াই স্বাভাবিক। যা-ই হোক, সে পেয়ে গেছে তার মেয়ে, যে কোনোভাবে খাতির জমাতে হবে।
-শিল্পী সাধনা ইসলামের নাম শুনেছেন? তার স্বামীও শিল্পী, নাম কামাল কবির।
-না শুনি নাই।
-না শোনারই কথা। সাধনা ইসলাম বাটিক পেইন্টিং করে বেশ নাম করে ছিলেন সেই সত্তর দশকে। আজও কেউ আর বাটিকে পেইন্টিং করে দেখাতে পারেনি। তারা দু'জন টরন্টোতে মেয়ের কাছে বেড়াতে এসেছেন। মেয়ের জামাই পরিচিত মানুষ। সেই সুবাদে ওদের বাসায় গিয়েছিলাম। শিল্পী মানুষ ভালো লাগল বলে পাঞ্জাবিটি আমাকে গিফট করে করে দিলেন।
-বাহ, মানিয়েছে আপনাকে।
-সত্যি, থ্যাঙ্কস।
আফরিনা মহসিনও মনে মনে ভাবছে যেমন ছেলে সে খুঁজছিল তা পেয়ে গেছে। অনুরুদ্ধ রশিদ ঠিক তাই! কানাডার নাগরিক, এখানে পড়াশোনা করে ভালো চাকরি করছে। বাড়তি কবি এবং আবৃত্তি করে। আফরিনা কণ্ঠে আবেগ মিশিয়ে বলল।
-আপনার কণ্ঠ বেশ ভালো।
-সত্যি, থ্যাঙ্কস!
-দুর! আপনার সত্যি আর থ্যাঙ্কস ছাড়া অন্য কোনো শব্দ নেই?
-সরি, আপনাকে দেখার পর থেকে জানি না কেন এমন হচ্ছে। কী বলব না বলব ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।
-সত্যি, থ্যাঙ্ক ইউ।
-আফরিনা, এবার কিন্তু আপনি সত্যি আর থ্যাঙ্কস বললেন।
এবার আফরিনা মহসিন খিলখিল করে হেসে উঠল।
এভাবেই এর পরে জমে উঠেছিল তাদের ভাব।
একদিন সন্ধ্যায় অফিস ছুটির পর টরন্টোর ব্লোর অ্যান্ড ইয়াং স্ট্রিট সাবওয়ে স্টেশনে দেখা দু'জনের।
পরস্পরের প্রশ্নের উত্তরে দু'জনেই বলল-
অফিস থেকে ফিরছি। একজন হিলটন হোটেল আর অন্যজন হাডসন বে।
-গাড়ি আনেন নাই?
-ডাউনটাউনে গাড়ি নিয়ে আসা খুবই ঝামেলার, পার্কিং ফি দশগুণ, পাওয়াও মুশকিল, রাস্তায় জ্যামের জন্য ধীরগতিতে চালাতে হয়। এসবের চেয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড সাবওয়েই ভালো।
-কী গাড়ি চালাও আফরিনা?
-ছোট মার্সিডিজ স্পোর্টস। তুমি?
-বিএমডব্লিউ এসইউভি বন্ধুদের নিয়ে লংড্রাইভ আমার খুব পছন্দ তাই বড় গাড়ি চাই।
দু'জনেই মনে মনে খুশি যা ভেবেছিল ঠিক তাই। দু'জনই চার কদম আরও এগিয়ে গেল পরস্পরের হৃদয়ে। এরপর ব্লোর অ্যান্ড ইয়াং সাবওয়ে স্টেশনে দেখা হলে ওপরে গ্রাউন্ডে উঠে টিম হর্টনে কফি সঙ্গে আড্ডা দেওয়া শুরু। আরও পরে টরন্টো ডাউনটাউনের পথে পথে রংবেরঙের চায়নিজ, মেক্সিকান, ব্রাজিলিয়ান, ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে ডিনারের সঙ্গে আড্ডা। প্রতিযোগিতা যেন পরস্পরকে বেশি ভালোবাসে। আফরিনা একদিন বলল-
চলো আগামী উইকএন্ডে তোমার বিএমডব্লিউ এসইউভিতে করে লংড্রাইভে যাই।
-হায়! কী কপাল দেখ, তুমি চাইলে লংড্রাইভে যেতে এদিকে বন্ধুকে ক্যালগ্যারি যেতে গাড়িটা দিলাম মাত্র। তোমার মার্সিডিজে দু'জনের কোজি হবে।
-আমারও একই অবস্থা! চালাই কম। পড়েই থাকে মন্ট্রিয়ল থেকে ছোট ভাই এসে দুই সপ্তার জন্য নিয়ে গেল গাড়িটা।
-থাক গাড়ি। আমরা 'গো বাসে' যাই চলো হ্যামিলটন। ছোট্ট হলেও মজার শহর, মাত্র ঘণ্টা দুই লাগবে। আমার ইউনিভার্সিটি ম্যাকমাস্টার সেখানে। কানাডার সবচেয়ে বড় ও পুরোনো বোটানিক্যাল গার্ডেনও সেখানে। খুব ঘুরব। রাতে যে কোনো হোটেলে থেকে পরদিন ফিরব টরন্টো।
মেনে নিল আফরিনা। শত বছরের গাছের ছায়াতে ঘুরল তারা বোটানিক্যাল গার্ডেনে। দেখল গোটা শহর। এমনকি ভারতীয় বংশোদ্ভূত শিল্পী ইয়ঙ্গো ভার্মার স্টুডিওতে তার যোনীমুখ বিমূর্ত পেইন্টিংও দেখল। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে ফিরে এলো হোটেলে। স্বপ্নের মতো কাটল তাদের সে রাত। একসঙ্গে সেই রাতে পরস্পরকে চরম আদর দিয়ে যেন প্রমাণ করতে চাইল দু'জন তৈরি হয়েছে দু'জনার জন্য। পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে গো বাসের ডিপোতে যেতে যেতে আফরিনা বলল-
তুমি তো একবারও বললে না তোমার ইউনিভার্সিটি ম্যাকমাস্টারের ক্যাম্পাসে যাওয়ার কথা! এতটা বছর এখানে ছাত্র ছিলে আর ক্যাম্পাস তোমাকে টানে না। তুমি কি এখানেই গ্র্যাজুয়েশন আর মাস্টার্স করেছ?
-ক্যাম্পাস টানবে না কেন! আমি তো ভাবলাম গেলে তুমি বোর হবে, তাই যাইনি। সবে তো ঘোরাঘুরি শুরু জীবনটা শুরু করি একসঙ্গে। তারপর সারা কানাডা ঘুরব।
আফরিনা সব ভুলে জড়িয়ে ধরল অনুরুদ্ধকে।
-তুমি কি বলছ বিয়ের কথা?
-হ্যাঁ! বিয়ে করে ফেলি। তবে আমার বাবা তার বন্ধুর মেয়ে ঠিক করছেন তিনি মানবেন না।
-আমারও মন্ট্রিয়লে বাবা-মা পাত্র ঠিক করে রেখেছেন। তাহলে কী হবে?
-একমাত্র রাস্তা খোলা একা একা শুধু দু'জনে গিয়ে কোর্টে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করে ফেলা। দু'জনই ভাবছে কত সহজে তাদের কাজ সমাধান হয়ে যাচ্ছে। দু'জনেরই ডেপুটেশন তলোয়ার মাথায় ঝুলছে। দু'জনই ভাবছে, একমাত্র থাকার বৈধতা জুটতে পারে যদি কানাডীয় নাগরিক কাউকে বিয়ে করতে পারে। দু'জনই ভাবছে, বিয়েটা হয়ে যাক তারপর মাফ চেয়ে সব খুলে বলবে। দু'জন পরস্পরকে এতটা ভালোবাসে যে অসুবিধা হয়তো হবে না। দু'জনই ট্যুরিস্ট ভিসায় এসে দুই হাত তুলে থাকার আশ্রয় অ্যাসাইলাম চেয়ে ব্যর্থ হয়েছে। বারবার তিনবার রিজেক্ট হলে আর উপায় নেই ডিপোর্ট করা ছাড়া। শুধু ওরা পরস্পরের সত্যিটা জানে না। ছদ্মবেশী প্রেমিক নিজেকে সাজিয়েছে কানাডার নাগরিক হিসেবে। মিথ্যার যত বেলুন সব ফুলিয়ে বলেছে। ছদ্মবেশী প্রেমিকাও একই কাজ করেছে। তাদের ছদ্মবেশ এতই নিখুঁত ছিল যে দু'জন দু'জনের আসলটা বুঝে ওঠেনি। দু'জনই প্রথমে বাঙালি সদ্য পাস আইনজীবী ধরেছিল। কেস রিজেক্ট হওয়ায় সিনিয়র পাকিস্তানি বা ইন্ডিয়ান আইনজীবী দ্বিতীয়বারও কেস হারলে শেষবার বড়ই উৎকণ্ঠার সঙ্গে সাদা জুইসি আইনজীবী ধরেও তেমন কাজ হয়নি। দু'জনই বুড়োবুড়ি কানা লুলা যা পায় তাকেই বিয়ে করতে হন্যে হয়ে ঘুরে ব্যর্থ হয়েছে। মাথায় হাত চাপড়ে ভেবেছে কানাডিয়ান নাগরিকদের কী হলো, কেউ বিয়েতে কেন রাজি নয়।
এমনই থাকো, খাও দাও ফুর্তি কর কিন্তু বিয়ে নয়। হতাশের শেষ দেয়ালে পিঠে ঠেকতেই পরস্পরকে পেল তারা।
বিয়ে রেজিস্ট্রির দিনক্ষণ ঠিক হলো।
আফরিনা আর নিজেকে সামলাতে পারল না। ভাবল যে আমাকে এত ভালোবাসে তাকে আগেভাগে জানানোই ভালো। সব শুনে সে বিয়ে করবে না, এমন ছেলে নয় অনুরুদ্ধ। ওর তো কিছু যায় আসে না। সে তো এ দেশের নাগরিক।
সব শুনে অনুরুদ্ধ দুই হাতের দশ আঙুল দিয়ে নিজের চুল আঁকড়ে টেনে ধরে মাথা নিচু করে। ডাঙায় তোলা মাছের মতো মুখ দিয়ে হাপুসহাপুস করে শ্বাস নিতে লাগল। আফরিনার মাথায় যখন ঢুকল ব্যাপারটা হতভম্ব্ব হয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। এতবড় প্রতারক ছদ্মবেশীকে সে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করতে পারেনি। তাহলে শেষবারও সে রিজেক্ট হয়ে গেল। নিজের হিল দেওয়া জুতো অনুরুদ্ধের দিকে ছুড়ে মেরে চিৎকার করল-
ছদ্মবেশী প্রতারক তোকে আমি ছাড়ব না! কোথায় তার ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি, কোথায় তার বিএমডব্লিউ এসইউভি।
-এই, তুই কী! এক ছদ্মবেশী লেডি প্রতারক। দেশে নাম গিয়া আমার বড় পুলিশ কর্মকর্তা বন্ধুবান্ধব আছে তোরে যদি জেলে না ঢুকাই!
-আহা রে মানিকচাঁদ, আমারও বড় আমলা গামলা নিয়া পেছনে ঘোরে। তোর হাত-পা ভাঙ্গিয়ে বাটার মোড়ে ভিক্ষা করামু।
তাদের দু'জনের সবই গুবলেট হলেও দেশে ডেপুটেশন ফ্লাইট একই হওয়া সত্যি অবাক ব্যাপার। এয়ার হোস্টেজ সামলাতে হিমশিম, ক্যাপ্টেন পর্যন্ত মাইক্রোফোনে শান্ত হয়ে সিটে বসতে বললেন। কে হয় শান্ত। শেষ পর্যন্ত কোথায় কোন কোনায় থেকে উঠে এলেন এক ছদ্মবেশী মহাপ্রতারক সাদা দাড়ি সাদা চুল সাদা সুট লাল টাই। হাতের দশ আঙুলে দশ পাথুরে আংটি। তাদের দু'জনের মাথায় হাত রেখে বলল-
হতাশ হলে চলবে না মাই চাইল্ড! তোমাদের দু'জনের কপালে আবার বিদেশ ভ্রমণ, বিদেশি নাগরিকত্ব সব যোগ এখনও আছে। তবে তোমাদের যৌথ চেষ্টায় তা হবে। দু'জনই সাদা সুট বাবার কথায় শান্ত হয়ে নিজেদের সিটে গিয়ে বসে পড়ল। দু'জনই ভাবছে আইডিয়া খারাপ নয় দেশে গিয়ে আবার শুরু করতে হবে পাল্টা উড়াল, তবে একসঙ্গে, অন্য কোনো ছদ্মবেশে।
মন্তব্য করুন