![রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [২৫ বৈশাখ ১২৬৮- ২২ শ্রাবণ ১৩৪৮; ৭ মে ১৮৬১- ৭ আগস্ট, ১৯৪১]](https://samakal.com/uploads/2022/05/online/photos/Untitled-6-samakal-627def4320de3.jpg)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [২৫ বৈশাখ ১২৬৮- ২২ শ্রাবণ ১৩৪৮; ৭ মে ১৮৬১- ৭ আগস্ট, ১৯৪১]
চিত্রশিল্পের একটি সহজাত বৈশিষ্ট্য হলো, একবার চিত্রের প্রতি অনুরক্ত হলে তা মানুষের ভিতরের নান্দনিক অনুভূতিকে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যায়। চিত্রকর হিসেবে তার অভিব্যক্তি তাকে ভিন্ন পর্যায়ে নিয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ জীবনব্যাপী সাহিত্য সাধনা করেছেন কিন্তু একটি পর্যায়ে এসে তিনি ছবির প্রতি তার আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন এবং চিত্রকর হবার বাসনা তার মধ্যে প্রোথিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ গীতিকার, কবি, কথাসাহিত্যিক এবং প্রবন্ধকার; এককথায় সাহিত্যজগতের দিকপাল। তবু চিত্রশিল্পী হিসেবে তার পরিচয় সম্পর্কে আমরা কতটা অবহিত? আজীবন সাহিত্য নিয়ে ভাবার লোক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সৃষ্টিশীলতার অনন্য শিখরে তিনি অবস্থান করেছিলেন। তার কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প এবং গান নিয়েই আলোচনা বেশি হয়।
কিন্তু চিত্রশিল্পের জগতে তার একটি স্বতন্ত্র অবস্থান ছিল। তা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে আলোচনা হয়েছে।
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে রবীন্দ্রনাথ কবিতার কাটাকুটি করতে গিয়ে ছবি আঁকায় গভীরভাবে মনোনিবেশ করেন। ১৯২৪ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত তার ছবি আঁকার সময়কাল। সত্যিই কি রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকা শখের পর্যায়ে পড়ে কিংবা কেনইবা রবীন্দ্রনাথ এত দীর্ঘ সময় পর ছবি আঁকতে গেলেন। মূলত পারিবারিক ঐতিহ্য ছিল তার ছবি আঁকার ব্যাপারে।
অবনীন্দ্রনাথ এবং গগনেন্দ্রনাথের মতো লোক, যারা ভারতীয় উপমহাদেশের চিত্রশিল্পের দিকপাল, তাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সখ্য, তাকে ছবির প্রতি আগ্রহী করে তুলেছিল।
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ যেমন সহজাত, তেমনই চিত্রশিল্পও তার সহজাত এবং বলতে গেলে চৌদ্দ বছর বয়স থেকে স্কেচবুকে তার আঁকাআঁকির কথা জীবনীকারদের তথ্যে পাওয়া যায়। ১৮৯৩ সালে সাজাদপুর থেকে তিনি ইন্দিরা দেবীকে লিখেছিলেন, 'ঐ যে চিত্রবিদ্যা বলে একটা বিদ্যা আছে তার প্রতিও আমি সর্বদা হতাশ প্রণয়ের লুব্ধ দৃষ্টিপাত করে থাকি- অন্যান্য বিদ্যার মতো তাকে তো সহজে পাবার জো নেই- তুলি টেনে টেনে একেবারে হয়রান না হলে তার প্রসন্নতা লাভ করা যায় না। চিত্রশিল্পের প্রতি তিনি অনুরক্ত ছিলেন মনেপ্রাণে।'
১৯২০ সালে যখন শান্তিনিকেতনে শিল্পকলা এবং শিল্পচর্চার আন্দোলন শুরু হয়েছিল তখন ভারতের অন্য কোনো জায়গায় শিল্পচর্চার প্রসার হয়নি। আন্তর্জাতিক ভাবনা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে পূর্ব এবং পশ্চিমের ভাবধারার সম্মিলন। ইউরোপের ইম্প্রেশনিজম, এক্সপ্রেশনিজম এবং কিউবিজম সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ পরিপূর্ণভাবে জ্ঞাত ছিলেন। অনুধাবন করেছিলেন এর গতিপ্রকৃতি। পশ্চিমের প্রভাব সত্ত্বেও তার কাজে ভারতীয় ভাব ও চরিত্র যুক্ত হয়েছিল গভীরভাবে। রবীন্দ্রনাথের ছবিতে আছে একটা কেন্দ্রীভূত অন্তর্মুখীন আবেগ। তার ছবির রেখায় পাওয়া যায় অনুভবের কম্পন, গভীর মগ্নতা। তার ছবির চেতনা, অনুভব, গভীরতা অন্য মাত্রায় উত্তীর্ণ হয়েছে। ভারতীয় রাগসংগীতের মতো তা ধীরে ধীরে কেন্দ্র থেকে বিস্তার লাভ করে আবার কেন্দ্রের দিকে ফিরে যায়।
রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকার বিষয়টি আসলে একদিনের ব্যাপার ছিল না। তিনি আজীবন সাহিত্য সাধনা করেছেন ঠিকই, কিন্তু তার চেতনায় চিত্রকলা বাসা বেঁধেছিল শৈশবেই। তিনি স্কেচবুক নিয়ে ছবি আঁকার চর্চা করতেন। রং, রেখা, ফর্ম- এসব বিষয়ে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সচেতন। ১৯০০ সালের পর থেকে রবীন্দ্রনাথের ছবিতে রেখা, রং ও ফর্ম সুনির্দিষ্ট অর্থ নিয়ে ধরা দিতে থাকে। ক্রমে তিনি ড্রইং এবং রেখা ও রঙের পারস্পেক্টিভ সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠেন। কারণ তিনি জানতেন চিত্রশিল্পে ড্রইং একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হিসেবে বিবেচিত। তার চিত্র চর্চা ও চিন্তার জগতে 'প্রকৃতি' গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হতে শুরু করে এবং মগ্নচৈতন্যের অনুসন্ধিৎসা নিয়ে চেনা-অচেনা সব বিষয়ে নিরবস্তুকরূপে পরিস্টম্ফুট হতে থাকে। শিলাইদহ-সাজাদপুর-পতিসরে অবস্থানকালেই তিনি ছবি আঁকার প্রেরণার উৎস খুঁজে নিয়েছিলেন। তেমনি জাপান ভ্রমণকালে জাপানি-চীনা চিত্রকলার সঙ্গে পরিচয় তার চিত্রচেতনার ভুবনকে সমৃদ্ধ করে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন শিল্পের জগৎটা অনেক বিশাল আর পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং বস্তুগত প্রেক্ষাপটে ছবি আঁকা বিস্তৃত চেতনার বহিঃপ্রকাশ। জাপানি চিত্রশিল্পীদের সঙ্গে তিনি একটা সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। প্রথম যাত্রায় রবীন্দ্রনাথ জাপানে তিন মাস অবস্থানকালে শিল্পী কাম্পো আরাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং ছবি বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান লাভ করেন। ১৯১৬-১৭ সালে কাম্পো আরাইয়ের শান্তিনিকেতন সফর রবীন্দ্রনাথের চিত্র চর্চার পটভূমিকে সমৃদ্ধ করে তোলে।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, 'আমার সৃষ্টিকর্মের শাখা তিনটি- সাহিত্য, গান এবং ছবি। এদের ভিতর দিয়ে আমি প্রকাশ করেছি আমাকে, আমার আনন্দকে।' এই তিনটি শিল্প শাখাকে রবীন্দ্রনাথ তার সৃষ্টিশীলতার সঠিক মাধ্যম হিসেবে চিহ্নিত করলেও সাহিত্যে ও গানে তিনি যেভাবে বেশিরভাগ সময় ব্যয় করেছেন, ছবি আঁকায় তুলনামূলকভাবে কম সময় দিয়েছেন এবং এ ক্ষেত্রে তার আবির্ভাব বিলম্বিত। ১৯২৮ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে তার অধিকাংশ ছবি আঁকা এবং তিনি প্রায় তিন হাজারের মতো ছবি এঁকেছেন। ছবিগুলো দেশে-বিদেশে প্রচুর খ্যাতি নিয়ে এসেছিল।
রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকার ব্যাপারে আর্জেন্টাইন সংস্কৃতিমনা বিদুষী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ভূমিকা অনেকটাই আশাব্যঞ্জক। ১৯২৪ সাল নাগাদ 'পূরবী' পাণ্ডুলিপি কাটাকুটিতে যে চিত্র সৌন্দর্য চোখে পড়েছিল ওকাম্পোর, তা রবীন্দ্রনাথকে ছবি আঁকার জগৎকে অনেকটাই বিস্তৃত করে দেয়। রবীন্দ্রনাথ নিজেই তার ছবি আঁকার শখ উল্লেখ করেছেন 'শেষ বয়সের প্রিয়া' হিসেবে। এর ভিত্তি গড়ে উঠেছিল ওকাম্পোর বাড়িতেই 'পূরবী' কাব্যগ্রন্থ তৈরির সময়ে। ওকাম্পো উল্লেখ করেছিলেন, 'একটি ছোট খাতায় লেখার নানা কাটাকুটিকে একত্রে জুড়ে দিয়ে তার ওপর কলমের আঁচড় কাটতে মজা পেতেন কবি। এই আঁকিবুঁকি থেকে বেরিয়ে আসত নানা রকমের মুখ, প্রাগৈতিহাসিক দানব, সরীসৃপ কিংবা নানা আবোলতাবোল।' ১৯৩০ সালে প্যারিসে রবীন্দ্রনাথের চিত্র প্রদর্শনী করার ব্যাপারে ওকাম্পোর সহযোগিতা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
রবীন্দ্রনাথের চিত্র সৃষ্টির ব্যাপারগুলো তিন পর্যায়ে আঁকা। প্রথম পর্যায় ১৮৮৯, দ্বিতীয় পর্যায় ১৮৯২, তৃতীয় পর্যায় ১৮৯৩। এগুলোতে ছিল মুখাবয়ব, পাখির ছবি, নারীমূর্তি, পেন্সিল স্কেচ, নারী-পুরুষের জোড়া আবক্ষ মূর্তি, মুখোশ ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথের স্নেহভাজন চিত্রশিল্পী মুকুল দে জানিয়েছেন, '১৯০৯ সালের এপ্রিল মাসের কোনো একদিন রবীন্দ্রনাথ তার ড্রইং খাতা খুলে নিজের আঁকা কয়েকটি পেন্সিল স্কেচ দেখিয়েছিলেন মুকুল দেকে। সেগুলোর মধ্যে ছিল কবি-স্ত্রীর প্রতিকৃতি, জলগ্রোতে ভাসমান নৌকায় তরুণীর ছবি। বুঝতে কষ্ট হয় না এগুলো তার ছবি আঁকার চেষ্টার প্রথমদিককার সৃষ্টি। ১৯১৩ সালে কলাভবন প্রতিষ্ঠার পর ছবি আঁকার যে প্রতিযোগিতা হয়েছিল সেখানে রবীন্দ্রনাথ নিজেই অংশ নিয়েছিলেন। অতএব দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকা কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, দীর্ঘদিনের চর্চার ফলশ্রুতি তার চিত্রকর্ম।
চিত্রশিল্পে রেখা এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রবীন্দ্রনাথ তার ছবিতে রেখার বুননে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। চিন্তা-চেতনার প্রকাশে তার নিজস্ব স্টাইলের পাশাপাশি তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে সামঞ্জস্যময় রেখার কৌশল দেখাতেও কার্পণ্য করেননি। রবীন্দ্রনাথ ছবি আঁকতে গিয়ে রেখার মায়ায় যেভাবে বাঁধা পড়েছিলেন তার পাণ্ডুলিপি রচনার পর্যায়ে তাতে রেখার টানেই তা বোঝা যায়। বস্তুসত্তার নিহিত রূপ প্রকাশে রেখার গুরুত্ব রবীন্দ্রনাথ বরাবর অনুধাবন করেছেন। বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় স্পষ্টতই বলেছেন, 'রবীন্দ্রনাথের শিল্পরচনার প্রধান অবলম্বন হলো রেখার বুননি।' এমনকি বলেছেন- 'যেসব ছবিতে রংই প্রধান, সেখানেও মাঝেমধ্যে রেখাপাতের নৈপুণ্য লক্ষণীয়। তার রঙিন ছবি থেকে রেখার বুননি সরিয়ে নিয়ে এর রূপের বাঁধন ও রঙের কারু আশ্রয় কতটা অবশিষ্ট থাকবে বলা কঠিন।'
রেখা এবং রঙের সমন্ব্বয়ে রবীন্দ্রনাথের ছবিগুলো এমন এক পর্যায়ে চলে যায় যেখানে ছবির প্রেক্ষিত মূর্ত হয়ে ওঠে অবিশ্বাস্যভাবে। রবীন্দ্রনাথ মূলত ছবিতে একবারে রং মেশান না। আগে পেনসিল দিয়ে ঘষে ঘষে একটা রং তৈরি করে মানানসই করে তার ওপর তিনি রং চাপান। এটি তারই ভাষ্য। তিনি আরও বলেন, 'এতে রংটা বেশ জোরালো হয়।' এতে বোঝা যায়, রবীন্দ্রনাথ রং ব্যবহার করেন অত্যন্ত পরীক্ষামূলকভাবে। ছবিতে রঙের ব্যবহার মনের আবেগ, অনুভূতিকে প্রকাশ করে। রবীন্দ্রনাথ তাই লাল, কালো এবং হলুদের প্রতি যত্নবান ছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের ছবিতে আদিমতার ধারণা বিশেষ রূপ পরিগ্রহ করে। তৎকালীন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তার মধ্যে এমন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল যে ছবির মুখাবয়বে রুক্ষ, রাগী, রহস্যময় ও আদিমতা দৃশ্যমান। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মূল্যবোধ ভেঙে পড়া, মানবিক বিশ্বের ক্রমাগত অমানবিক হয়ে ওঠা এসবের ফলে রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় এক বিরূপতার ছাপ পড়ে। ১৯৩৫-৩৬ সালের দিকে আঁকা আত্ম-প্রতিকৃতিতে এবং 'মুখ' শিরোনামে আঁকা ছবিগুলোতে তার বিরূপ ধারণার যে বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তা উপেক্ষণীয় নয়। ছবিগুলোতে রুক্ষ ও মেজাজি ভাব এবং কড়া রঙের প্রয়োগে সমকালীন অবস্থারই প্রতিফলন ঘটেছে। সমকালীন বৈশ্বিক অবস্থা যে কোনো লেখক বা সাহিত্যিককে নাড়া দেয়। এ থেকে রবীন্দ্রনাথও বাদ যাননি। তার চিত্রীমন থেকে ছবিতে এর প্রতিফলন ঘটেছে। মানবমনের গভীরে সুপ্ত আদিম প্রতীকাদির চিত্ররূপ প্রকাশ পেয়েছে রবীন্দ্রনাথের ছবিতে। তিনি এমন কথাও বলেছেন যে, 'এই সংসারটা মোটেই ভালো জায়গা নয়। চারদিক এমন দুঃখকষ্টে ঘেরা ূএমন অন্ধকার, ভালো লাগে না।' চিত্রশিল্পী যোগেন চৌধুরীর মতে, 'এক ধরনের অদ্ভুত অস্থিরতা রবীন্দ্রনাথের মধ্যে সব সময় কাজ করেছে। যে জন্য একজন অভিব্যক্তিবাদী চিত্রশিল্পীরূপে তার প্রকাশ, তার এ অস্থিরতা বাক্যের বন্ধন থেকে বেরিয়ে এসে মুক্তি পেয়েছে ছবিতে।' এক পরাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে রবীন্দ্রনাথের ভিতর বিদ্রোহী চেতনার উদ্রেক হওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার এবং চিত্রকলায়ও তা প্রকাশ পেয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ তার জীবনের একটি সময় শিলাইদহ, সাজাদপুরে কাটিয়েছিলেন। এরপর হিমালয় ভ্রমণ থেকে শুরু করে পদ্মা, ইছামতী-আত্রাই-নাগর নদীতে ভেসে ভেসে এবং বহু বিচিত্র প্রকৃতির সঙ্গে তার পরিচিতি ছবি আঁকায় অনুষঙ্গ হয়ে দেখা দেয়। এখানেই শেষ নয়, গাছগাছালি ঘেরা শান্তিনিকেতন, মাঝেমধ্যে কালিম্পং, মংপু, দার্জিলিঙের পাহাড় অরণ্যের বৈচিত্র্য নিয়ে তিনি ক্যানভাসে ঠাঁই দিয়েছেন নিসর্গের ভাবনাকে। প্রকৃতিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রাণসত্তা নানা ফর্মে ও স্বতঃস্টম্ফূর্ত আবেগে তার কলমে, তুলিতে, ব্রাশে, রঙে ও রেখায় রূপময় হয়ে ওঠে। বাংলার বর্ণময় প্রকৃতিকে তুলে ধরতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ কখনও কখনও নিসর্গ চিত্রে রঙের সমারোহ ঘটিয়েছেন। কখনও তুলি কলমের কিংবা ক্রেয়নের প্রয়োগে এক ভিন্ন জগৎ ফুটে উঠেছে। তার কিছু নিসর্গ চিত্রে হলুদের ব্যবহার শিল্পী ভ্যান গঘের হলুদ প্রীতির কথা মনে করিয়ে দেয়। এ ছাড়া তার নিসর্গ চিত্রে এসেছে কিছু আকর্ষণীয় ফুলের ছবি, কোথাও হালকা, কোথাও জোরালো রঙের টানে। লাল, হলুদ, কালো, এমনকি কোথাও নীলের আঁচড় কেটে নিঃসঙ্গ ফুল বা পুষ্পস্তবকের রূপ এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ। প্রকৃতিকে আমরা যেভাবে দেখি, রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে এর রূপময়তা বিশেষত তার মতো একজন শিল্পীর দৃষ্টিতে ভিন্ন আঙ্গিকে প্রতিভাত হয়।
চিত্রশিল্পী হিসেবে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক। এই আধুনিকতা পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য চিত্ররীতি সম্বন্ধে তার জ্ঞানান্বেষণের পরবর্তী ফলশ্রুতি। স্বদেশি চিত্রকলার প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল। তিনি বরাবর চেয়েছেন স্বদেশি চিত্রকলার চর্চাকে বৈশ্বিক পটভূমিতে রেখে তাতে স্থানিক বৈশিষ্ট্যগত চেতনার প্রকাশ ঘটাতে। তার চিত্রকর্ম কোনো ঘরানার অন্তর্ভুক্ত নয় বরং নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে প্রকাশিত, বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত। এখানেই রবীন্দ্রনাথের স্বাতন্ত্র্য বিদ্যমান।
মন্তব্য করুন