সমকাল :রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক পণ্যবাজারে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। আন্তর্জাতিক ব্যবসার ধরন পাল্টে যাচ্ছে। উৎপাদন, সরবরাহ সবই ব্যাহত হচ্ছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের করণীয় কী?
সায়মা হক বিদিশা :বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ম্ফীতি। জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম অনেক বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কিছু করার নেই। জ্বালানির দাম বাড়লে সব ক্ষেত্রেই তার প্রভাব পড়ে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার জ্বালানির বাড়তি দাম সমন্বয় করবে, নাকি জনগণের স্বার্থে ভর্তুকি বাড়াবে। দাম সমন্বয়ের পক্ষে হয়তো অনেক যুক্তি আছে। তবে আমি মনে করি, করোনার প্রভাবে সাধারণ মানুষের হাতে নগদ টাকা কমে গেছে। ফলে দাম সমন্বয় না করাই ভালো। এখন স্বল্প ও মধ্য মেয়াদে মূল্যস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সবচেয়ে গুরুত্ব পাওয়া উচিত।

সমকাল :সামগ্রিকভাবে দেশে মূল্যস্ম্ফীতি বেড়েছে। এ অবস্থায় নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়ছে। নতুন অর্থবছর শুরু হতে যাচ্ছে। সরকারের বাজেটে এ বিষয়ে কী ধরনের উদ্যোগ থাকা উচিত।
সায়মা হক বিদিশা :আমদানিনির্ভর পণ্যে শুল্ক্ক কাটছাঁট করার দরকার পড়বে। এরই মধ্যে ভোজ্যতেল, চিনির মতো কিছু ক্ষেত্রে সরকার শুল্ক্ক কমিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত আরও কিছু দিন অব্যাহত রাখা দরকার। যদিও এতে রাজস্ব সংগ্রহ চাপে পড়বে। তা সত্ত্বেও বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এই ছাড় অব্যাহত রাখা দরকার। তবে সরকারের রাজস্ব সংগ্রহের চেষ্টাও থাকতে হবে। সে জন্য ব্যক্তি খাতের আয়করে ব্যাপক সংস্কার দরকার। করের আওতা বাড়াতে হবে। সব টিআইএনধারীর রিটার্ন দাখিল নিশ্চিত করতে হবে। মূল্যস্ম্ফীতি সামলাতে গিয়ে রাজস্বে যাতে ধস না নামে, তা মাথায় রাখতে হবে। সম্পদকর আদায় করা এবং আয়করের ধাপে পরিবর্তন আনা যেতে পারে। আনুষ্ঠানিক লেনদেন যথাসম্ভব ডিজিটাল ব্যবস্থায় নিয়ে আসতে হবে। আয়কর সংগ্রহে যেসব দুর্বলতা রয়েছে সেগুলো কাটিয়ে ওঠা এখন খুবই জরুরি। এতে মূল্যস্ম্ফীতি সহনীয় রাখা এবং বৈষম্য কমানোর পাশাপাশি রাজস্ব সংগ্রহ ঠিক রাখা যাবে।

সমকাল :ব্যবসায়ীরা বৈশ্বিক পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে তা প্রমাণিতও। অবৈধ মজুত, বাড়তি দাম নেওয়ার ঘটনা ঘটছে। সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনার জন্য আপনার পরামর্শ কী?
সায়মা হক বিদিশা :মূল্যস্ম্ফীতি বা পণ্যমূল্য নিয়ে আমরা যত কথা বলছি, বাজার ব্যবস্থার দুর্বলতা, অসাধু ব্যবসায়ীদের তৎপরতা নিয়ে তত বলছি না। আমাদের বাজারের মনিটরিং শক্তিশালী নয়। কিন্তু মনিটরিং শক্তিশালী করা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। মজুত আইন ঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। এক সময় চালের বড় আড়তদারদের হাতে অনেক ক্ষমতা ছিল। গত ছয় মাস চাল মজুত ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। এতে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। কিন্তু চালের বাজার আর ভোজ্যতেলের বাজার এক রকম নয়। ভোজ্যতেলের বাজার গুটিকয়েক ব্যবসায়ীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। বলা হচ্ছে, সয়াবিন ও পাম অয়েলের সরবরাহ আছে। কিন্তু বাজারে নেই। সরবরাহ থাকলে বাজারে থাকবে না কেন। এ ক্ষেত্রে কারা সম্পৃক্ত, কোন পর্যায়ে গিয়ে পণ্য সরবরাহ হচ্ছে না, সেগুলো বের করা দরকার। যারা সুস্থ প্রতিযোগিতার পরিবেশ ব্যাহত করে বাজার অস্থিতিশীল করবে, তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। বর্তমানেও বাজারে মনিটরিং হচ্ছে, তবে তা হচ্ছে এডহক ভিত্তিতে। এটি এডহক ভিত্তিতে রাখা যাবে না। কৃষি, বাণিজ্য ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ও জরুরি। সঠিক তথ্য-উপাত্তও জরুরি। বাজার মনিটরিং বা মূল্যস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো সংস্থা দায়িত্বপ্রাপ্ত নয়। একটি সংস্থা বা কমিশন করা যেতে পারে বা প্রতিযোগিতা কমিশনকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।

সমকাল :সামনে নতুন মুদ্রানীতি আসছে। কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন?
সায়মা হক বিদিশা :মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিষয় যেমন থাকে, তেমনি প্রবৃদ্ধির বিষয়টিও সম্পৃক্ত। ফলে অর্থ প্রবাহ কমিয়ে মূল্যস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হবে। ফলে মুদ্রানীতি খুব বেশি সংকোচনমূলক করা যাবে না, আবার সম্প্রসারণমূলক করাও ঠিক হবে না। মুদ্রানীতিতে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ থাকতে হবে। অর্থনীতির এটি একটি চিরন্তন সমস্যা যে, একটি এগোলে আরেকটিতে টান পড়ে। মূল্যস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান উভয় খাতকে সমর্থন জোগায় এমন মুদ্রানীতি করতে হবে।

সমকাল :সার্বিক বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়ে জোর দিতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। উৎপাদন বাড়াতে সরকার কী ধরনের উদ্যোগ নিতে পারে?
সায়মা হক বিদিশা :কোন কোন ক্ষেত্রে সংকট সৃষ্টি হয়, তা এরই মধ্যে চিহ্নিত। ফলে এসব ফসল এবং অন্যান্য অপ্রচলিত আমদানিনির্ভর ফসলের উৎপাদন বাড়াতে সরকারকে প্রণোদনা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। বীজ, সেচসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রণোদনা দিতে হবে। এ জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার।

সমকাল :টাকার মান কমছে। কমেছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত। সুদহারও কিছুটা বেড়েছে। রেমিট্যান্স কমেছে। বাণিজ্য ঘাটতি রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছেছে। সরকার বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে সতর্ক। এডিপি বাস্তবায়নেও কাটছাঁট করা হচ্ছে। সামগ্রিক অর্থনীতিতে এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় আপনার পরামর্শ কী?
সায়মা হক বিদিশা :বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে সবকিছু মসৃণভাবে চলবে, তা আশা করা ঠিক নয়। তবে সতর্ক হতে হবে। কীভাবে রপ্তানির ক্ষতি কমানো যায় বা বাজার সম্প্রসারণ করা যায়, সে উদ্যোগ নিতে হবে। আমদানি বাড়ছে, তবে দেখা দরকার আমদানি ব্যয় কোথায় বাড়ছে। পুঁজি পণ্যের আমদানিসহ প্রকৃত আমদানি বাড়লে অসুবিধা নেই। ওভার ইনভয়েসিং হচ্ছে কিনা সেটা দেখাও এখন গুরুত্বপূর্ণ। কারণ করোনার দুটি বছরে অনানুষ্ঠানিক লেনদেন অনেকটা বন্ধ ছিল। এখন সেগুলো বেড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। রেমিট্যান্স আয় বাড়ানোর জন্য বিদেশে কর্মী পাঠানো বাড়াতে হবে। চেষ্টা করতে হবে দক্ষ কর্মী পাঠাতে। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
সাক্ষাৎকার নিয়েুেুছন শেখ আবদুল্লাহ