- ফিচার
- বিশ্বমঞ্চে 'চিরকুট'
বিশ্বমঞ্চে 'চিরকুট'

ম্যাডিসন স্কয়ারের সামনে 'চিরকুট'
শুরু থেকেই ভীষণ চাপে ছিলাম। প্রথমত বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্তি নিয়ে আয়োজন, দ্বিতীয়ত বিশ্বখ্যাত ব্যান্ড স্করপিয়ন্সের সঙ্গে মঞ্চ শেয়ার, আর নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে পারফর্ম। এই তিনটি বিষয় একদিকে যেমন ইতিহাস রচনার, তেমনি সৌভাগ্যের। তাই চাপমুক্ত থাকার অবকাশ ছিল না। গত ১১ বছর দেশ-বিদেশের অসংখ্য মঞ্চে পারফর্ম করছে চিরকুট। আন্তর্জাতিকভাবে বহু কনসার্টে অংশ নেওয়ার সুবাদে ব্যান্ডের পোর্টফোলিও ভারী হয়েছে। তারপরও 'গোল্ডেন জুবিলি বাংলাদেশ কনসার্ট'-এ অংশ নেওয়ার বিষয়টি একেবারেই অন্যরকম।
ঈদের কয়েকদিন আগের কথা। হঠাৎ একটি ফোন আসে। যে ফোনে আমাদের প্রস্তাব দেওয়া হয়, বিশ্বখ্যাত ব্যান্ড স্করপিয়ন্সের সঙ্গে একমঞ্চে পারফর্ম করার। জানানো হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে একটি কনসার্টের আয়োজন করা হচ্ছে। এই 'গোল্ডেন জুবিলি বাংলাদেশ' কনসার্টে পারফর্ম করবে বিশ্বখ্যাত ব্যান্ড স্করপিয়ন্স। বাংলাদেশ সরকারের আইসিটি বিভাগের অধীনে হাই-টেক পার্কের পক্ষ থেকে মূলত এই আয়োজন। সেখানে আমরা অংশ নেব কিনা জানতে চাওয়া হয়। এই প্রস্তাব পেয়ে দিনের সমস্ত ব্যস্ততা ভুলে গিয়েছিলাম। বিস্ময় আর আনন্দে বেশ কিছুটা সময় থমকে ছিলাম। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যে ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ'; যুদ্ধ-বিধ্বস্ত এদেশের তহবিল গঠন ও স্বাধীনতার বার্তা ছড়িয়ে দিতে যে কনসার্টে অংশ নিয়েছিলেন পণ্ডিত রবি শঙ্কর, বিশ্বখ্যাত ব্যান্ড বিটলসের সদস্য জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলান, লিয়ন রাসেলের মতো বিশ্ব তারকারা- সেই মঞ্চে ওঠার সুযোগ পাচ্ছে চিরকুট! বিস্ময়ের এই দোলাচলে উত্তরে 'হ্যাঁ' বলতেও তাই এক মুহূর্ত সময় ব্যয় হয়েছে। এই যে 'হ্যাঁ' বলে দেওয়া, ইতিহাসের অংশ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা- তার জন্য কতটা প্রস্তুতি নিতে হবে, সেই ভাবনাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। দুঃখজনক হলেও সত্যি, কনসার্টের জন্য আমাদের যতটা প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন ছিল ততটা প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ পাইনি। শুধু তাই নয়, কনসার্টের জন্য আমাদের বেইজ গিটারিস্টকে না পাওয়াও ছিল চিন্তার কারণ। অবশ্য এ সমস্যার সমাধান হয়ে গিয়েছিল। তাই 'গোল্ডেন জুবিলি বাংলাদেশ' কনসার্টে অংশ নিয়ে ইতিহাসের অংশ হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমাদের।
সবকিছু চূড়ান্ত হওয়ার পর স্করপিয়ন্সের অফিশিয়াল পেজে যখন চিরকুটের নাম দেখি, তখন মনে হয়েছিল, আমরা ভুল পথে হাঁটিনি। সংগীত নিয়ে আমাদের যে জার্নি, তা কিছুটা হলেও সফল হয়েছে। তাই ৬ মে কনসার্টের কাঙ্ক্ষিত দিনটির জন্য ক্ষণগণনা শুরু হয়েছিল আমাদের। ঈদের আগেই পাসপোর্ট, ভিসা নিয়ে শুরু হয়েছিল ছোটাছুটি। ঈদ নিয়ে আমাদের নানা রকম পরিকল্পনা থাকে।
শত ব্যস্ততার মাঝেও এই উৎসবের জন্য প্রতীক্ষায় থাকি আমরা। কারণ, এই উৎসব উপলক্ষে যে ছুটি মেলে তার সুবাদে ব্যস্ততা ঝেড়ে ফেলে প্রিয়জনদের সান্নিধ্যে কিছু সময় কাটানো যায়। কিন্তু এবার সেই সুযোগ হয়নি। কারণ, কনসার্টের জন্য যতটা অনুশীলন দরকার ছিল, সেটা করতে পারিনি, দ্বিতীয়ত ঈদের রাতেই আমাদের ঢাকা ত্যাগ করার তোড়জোড় শুরু হয়। অবশেষে নির্দিষ্ট দিনে আমরা পা রাখি মার্কিন মুল্লুকে। মনে নানা প্রশ্ন- কীভাবে কী করব, সবকিছু ঠিকঠাক পরিকল্পনা মাফিক হবে তো? অনেক প্রশ্নই ছিল মনের মধ্যে।
যেজন্য একটা চাপ মনের মধ্যে সবসময় ছিল, যা মঞ্চে ওঠার পরও একবিন্দু কমেনি। এই চাপ কমতে শুরু করেছে গান গাওয়া শুরু করার পর। ২০ মিনিটের পারফরম্যান্স ছিল আমাদের। আমরা মঞ্চ থেকে নেমে যাওয়ার পর পারফর্ম করতে ওঠে স্করপিয়ন্স। গেয়ে যায় একে একে তাদের কালজয়ী গানগুলো। পুরো হল তখন মুগ্ধ হয়ে তাদের পারফরম্যান্স দেখতে থাকে। সেদিন স্করপিয়ন্স তাদের পরিবেশনা দিয়ে আবারও প্রমাণ করেছে, কেন এই ব্যান্ডটি বিশ্বসেরা। কেন তাদের সৃষ্টি যুগ যুগ ধরে অগনিত শ্রোতার মন জয় করে চলেছে।
তাদের কাছে আমাদেরও অনেক কিছু শেখার আছে। খেয়াল করে দেখেছি, স্করপিয়ন্স যখন পারফর্ম শুরু করে, তখন দুই শতাধিক কর্মী, তীক্ষষ্ট নজর রাখছেন, কোথাও কোনো সমস্যা সৃষ্টি হয় কিনা। পারফরম্যান্সে এতটুকু ত্রুটি-বিচ্যুতি যেন চোখে না পড়ে, তার জন্য তাঁদের এই সতর্ক দৃষ্টি। শো শেষে স্করপিয়ন্স সদস্যরা তাঁদের দেওয়া কথা মতো আমাদের সঙ্গে দেখা করেন। আমরা তাঁদের হাতে তুলে দিই দেশ থেকে নিয়ে যাওয়া রিকশা পেইন্টের চশমাগুলো, যার একপাশে লেখা ছিল স্করপিয়ন্স, অন্য পাশে চিরকুটের নাম। এই উপহার পেয়ে ভীষণ খুশি হয়েছিলেন স্করপিয়ন্সের সদস্যরা। সবশেষে সফল একটি আয়োজন শেষ করে গন্তব্যের পথে পা বাড়াই আমরা। এই আয়োজন ছিল আমাদের জন্য একইসঙ্গে আনন্দ ও গর্বের।
মন্তব্য করুন