সাম্প্রদায়িকতা, উগ্রবাদের রোষানলকে প্রতিহত করে সম্প্রীতির মালা গাঁথার প্রত্যয়ে রাজধানীতে শুরু হয়েছে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর ২২তম সম্মেলন।

বুধবার রাজধানীর গুলিস্তানে মহানগর নাট্যমঞ্চে উদীচীর ২২তম জাতীয় সম্মেলনের উদ্বোধন করেন মুন্সিগঞ্জের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মন্ডল।

‘শ্রেণিভেদ ভাঙি শোষিতের রোষে, সম্প্রীতির মালা গাঁথি ভেদাভেদ নাশে’-এ প্রতিপাদ্যে তিন দিনের সম্মেলনে সারাদেশ থেকে উদীচীর প্রতিনিধিরা যোগ দিয়েছেন।

উদ্বোধনী পর্বে ‘শুরু হোক অনিয়ম ভাঙবার যাত্রা’, ‘পথে এবার নামে সাথী’, ‘মানুষ জাগবে ফের’, ‘সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার করো’, ‘দ্রব্যমূল্যের দাম কমাও’, ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই’ এসব শ্লোগানে মুখর হয়ে উঠে মহানগর নাট্যমঞ্চ।

উদ্বোধনী আয়োজনে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, নাট্যজন মামুনুর রশীদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু। এছাড়া বক্তব্য রাখেন উদীচীর সহ সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান, উদীচীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা গোলাম মোহাম্মদ ইদু এবং চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সমন্বয়কারী নিখিল দাস। সভাপতিত্ব করেন উদীচির সভাপতি অধ্যাপক ড. শফিউদ্দীন আহমেদ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন উদীচীর সাধারন সম্পাদক জামসেদ আনোয়ার তপন।

হৃদয় চন্দ্র মন্ডল বলেন, ‘দেশে মৌলবাদ, অপশক্তি, দূরাচার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সমাজে অবক্ষয় চলছে। সাম্প্রদায়িকতা সমাজে গভীরে চলে গেছে। এ নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে। রাজনীতিকিরা রাজনীতি করবেন কিন্তু আমরা যারা সাধারন মানুষ আমাদের নিজেদের জন্য, আমাদের সন্তানদের জন্য এই দেশকে, সমাজকে সুস্থ ধারায় নিযে আসতে হবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘ধর্মান্ধরা বিজ্ঞানকে ভয় পায়। কিন্তু ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের কোন বিরোধ নেই। তারা মুক্ত চিন্তা বিরোধী, শিক্ষার বিরোধী। এদের বিরুদ্ধেই আমাদের প্রধান লড়াই।’

কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, ‘আমাদের দেশে বিজ্ঞান চর্চার একজন শিক্ষক হৃদয় মন্ডলকে গ্রেপ্তার করে জেলে থাকতে হয়। বিজ্ঞান চর্চার জন্য নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। যতদিন অসাম্প্রদায়িক ও শোষণমুক্ত সমাজ গঠন হবে না ততদিন এসব চলবে। যতদিন আমরা সাংস্কৃতিকমনস্ক জাতি গঠন করতে পারবো না ততদিন শোষণমুক্ত সমাজ গঠন হবে না।’

কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, ‘দেশে উগ্রতা বেড়েছে। সাম্প্রদায়িকতা বেড়েছে। ভয়ের সংস্কৃতি চলছে। শিক্ষা সংস্কৃতির বাহন। আমাদের ধর্মান্ধ, উগ্রবাদীদের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।’

সম্মেলনে বক্তারা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ আর মুক্তিযুদ্ধের ধারায় নেই। শোষনমুক্ত, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা আজো সম্ভব হয়নি। হাজার বছরের মাটিবর্তী সহজিয়া আচার-বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও সম্প্রীতিপূর্ণ সামাজিক ব্যবস্থা থেকে মানুষকে বিচ্যুত করে ধর্ম নিয়ন্ত্রিত সমাজের দিকে ধাবিত করা হচ্ছে। বিজ্ঞাননির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তে দেশে বিভাজিত শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐক্যকে নস্যাৎ করা হচ্ছে।

আলোচনা অনুষ্ঠানের পর বের করা হয় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। উদ্বোধনী সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় শংকর সাঁওজালের গ্রন্থনা ও নির্দেশনায় বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীদের বিশেষ পরিবেশনা ‘ফিরে চাই সম্প্রীতি সাম্যের গান, পূর্ণ সংবিধান’। পরে আলোচনা শেষে ছিল বিভাগীয় শহরের শিল্পী এবং আমন্ত্রিত অতিথি শিল্পীদের পরিবেশনা।

ময়মনসিংহ বিভাগ, রংপুর বিভাগ, চট্টগ্রাম বিভাগ, বরিশাল বিভাগ, ঢাকা বিভাগের শিল্পীদের পরিবেশনার পাশাপাশি আবৃত্তি করেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী বীর মুক্তিযোদ্ধা আশরাফুল আলম, রেজিনা ওয়ালী লীনা, মিজানুর রহমান সুমন। সংগীত পরিবেশন করেন গণসংগীত শিল্পী আরিফ রহমান, উদীচীর সহসভাপতি হাবিবুল আলম। এরপরে ছিল সাজু আহমেদের পরিচালনায় ছিল কত্থক নৃত্য পরিবেশনা।