বিবাহোত্তর পারিবারিক জীবনে ঢাকা শহরে আমরা প্রথম বাসা ভাড়া নিয়েছিলাম ১৯৮১ সালের দিকে। আমি তখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রকল্পে কাজ করি। আমার স্ত্রী তখন শিক্ষকতা করেন স্কলাস্টিকা স্কুলে। বিয়ে করেছি ১৯৭৮-এ। প্রথম তিন বছর আমরা বাবা-মায়ের সাথেই ছিলাম। কিন্তু আমি সব সময় মনে করতাম যে, আলাদা থাকা উচিত, স্বাধীন থাকা উচিত। এ আমার আজীবনের ইচ্ছা, এখনও একই ইচ্ছা রয়ে গেছে।
'৮১ সালের দিকে আমরা যে বাসাটা ঠিক করলাম- এবার তার গল্পে আসি। আমি তখন কাজ শুরু করেছিলাম এক হাজার পঞ্চাশ টাকা বেতনে। তারপর প্রমোশন হয়ে আয়টা আরও একটু বাড়ল। কারণ প্রকল্পের কমবেশি সমস্ত দিক আমাকেই সামলাতে হতো। আর প্রথম দিকে তেমন কাউকে পাওয়াও যায়নি। পরে অবশ্য হাসান ভাই লোক নিলেন। বেতন আমার তখন সম্ভবত আঠারোশ টাকা। সেই সময়ের জন্য চলার মতো বেতন। আর আমার স্ত্রীও বোধহয় ছয়শ পঞ্চাশ টাকার মতো বেতন পেত। তখন ও-ও প্রমোশন পেয়েছিল একটা। তাই সব মিলিয়ে দুই-আড়াই হাজার টাকার সংসার। এর বাইরে আমি পার্টটাইম টিউশনি করতাম। আমার স্ত্রীও করত। এমনই একটা সময়ে আমরা বাসা খোঁজা শুরু করলাম। যা আয়-রোজগার, তাতে হাজার টাকার বাসাতে তো যাওয়া যাবে না। খুঁজতে খুঁজতে একটা বাসা পাওয়া গেল, যেখানে দু'জনেরই যাতায়াতে খরচ কম ও সুবিধা বেশি। আমার স্ত্রীর স্কুল তখন ধানমন্ডিতে।
যে বাসা পাওয়া গেল তার ঠিকানা ১১/২। এটা জিগাতলার পাশের রাস্তাটায়। এখনও বাসাটা আছে কিনা আমি জানি না। তখন উঁচু উঁচু অনেক বাড়ি ওখানে ছিল, তবে রাস্তাঘাট ছিল খুব খারাপ। পাঁচতলা ভবনে আমাদের বাসাটা নিচতলায়। সেদিক থেকে ভাড়া একটু কম। সেই কম ভাড়ার বাড়িতে আমরা উঠলাম। যখন উঠেছি, সম্ভবত গরমকাল ছিল। তখনও বোঝা যায়নি সামনে কী পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। প্রথম নিজের বাসা, স্বামী-স্ত্রী নিজেদের মতো থাকা- এই সবকিছু মিলিয়ে ভালোই যাচ্ছিল সময়টা। কিন্তু বৃষ্টির দিন যখন এলো- কিছুদিনের মধ্যেই ঘটল ব্যাপারটা।
বাসার কাজের জন্য একটা ছোট্ট ছেলে থাকত আমাদের সাথে। সেদিন ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে সারারাত। আমরা সবাই ঘুমিয়ে আছি। এমন বৃষ্টির দিনে ঘুমটা বরং ভালোই হয়। কিন্তু হঠাৎ ওই ছেলেটার চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল। আমরা আমাদের ঘর থেকে দৌড়ে বের হয়ে এলাম। এসে দেখি ও ভয়ে কাঁপছে আর চিৎকার করে বলছে-
আমারে ভূতে ধরছে- আমারে ভূতে ধরছে।
আশ্চর্য! কী মুশকিলের কথা! কিসের ভূত! এখানে ভূত আসবে কোথা থেকে?
কিন্তু বাতি জ্বালিয়ে দেখা গেল ঘরের ভেতরে পানি ঢুকছে। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে বাসায় পানি ঢোকা শুরু করেছে। আর ছেলেটা যেখানে শুয়ে ছিল, সেখানে পানির একটা ধারা গিয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় তার শরীরে লেগেছে। অমনি সে লাফ দিয়ে উঠে বলছে- ওকে ভূত ধরছে, পানির ভূত। ওদিকে ঘর ভেসে যাচ্ছে বৃষ্টির পানিতে।
বারান্দায় গিয়ে দেখি বারান্দায় প্রচুর পানি, ওখান থেকে ধীরে ধীরে পানি ঘরের ভেতর ঢুকছে। এরপর যেটা লক্ষ্য করলাম বাথরুমের কমোড ঠেলে নিচ থেকে পানি উঠছে। আর শুধু কি পানি- সাথে সমস্ত জিনিসপাতি বের হয়ে ওপরে উঠে ভাসছে। তখন তো আর হাই কমোড নেই সব বাড়িতে, ইন্ডিয়ান কমোড। তাই শুরুতেই ভেসে গিয়ে যা-তা অবস্থা। কী করব ভেবে পাচ্ছি না। উপায়ান্তর না দেখে আমি গিয়ে একটা মগ নিয়ে বারান্দার পানি সেচা শুরু করলাম। এখন এত পানি ফেলব কোথায়! বৃষ্টি তো হচ্ছেই। তাও কিছুটা যদি কমিয়ে রাখা যায়, কারণ ঘর তো ভেসে যাচ্ছে। আমি খুবই উৎসাহের সাথে পানি সেচতে থাকলাম। মনে আছে যে, যখন আমি ভিজে ভিজে বৃষ্টির মধ্যে পানি সরাচ্ছি- আমার তাতে বেশ মজাই লাগছিল। আমার মনে হয়, মানুষের ছোটবেলার স্মৃতি যেখানটায় থাকে, নিশ্চই আমার সে অংশটা তখন জেগে উঠেছিল। বাসা ভেসে যাচ্ছে, জিনিসপত্র সব ভিজে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, এদিকে পানি সেচতে আমার সে কী আনন্দ! তবে আজকের দিনে এই বয়সে এসে বৃষ্টির মধ্যে যদি পানি সেচতে হয়, আমার মোটেও ভালো লাগার কথা নয়। কিন্তু সেই সময় আমার বৃষ্টির তোড়ের বিরুদ্ধে পানি সেচতে গিয়ে আনন্দই লেগেছিল। আমার স্ত্রী বলছিল-
কী ব্যাপার, তুমি হাসছ কেন!
বললাম-
কী আর করব। খুব মজা লাগছে আমার।
ও তো বিরক্ত হয়ে গেছে।
কিন্তু সেচে তো আর বৃষ্টির পানি আটকানো যাবে না, বাইরে থেকে তখন কাদামাটি এনে নানাভাবে বাঁধ দেওয়ার চেষ্টা করছি আমরা। এভাবেই চলতে লাগল। সে এক বিশ্রী অবস্থা। কাজকর্ম সব বন্ধ। খাওয়া-গোসল সব বন্ধ। সবচেয়ে বড় কথা, বাথরুমে যাওয়া যাচ্ছে না।
পরের দিন আবারও বৃষ্টি এলো। আমি বাড়িওয়ালাকে গিয়ে ধরলাম। বাড়িওয়ালা কি আর জানে না! ভাড়া দেওয়ার সময় আগে থেকেই এটা বলে দেওয়া উচিত ছিল তার। সে তো তখন কাঁচুমাচু করছে।
কিছুদিন পরে অবশ্য বাড়িওয়ালা রাজমিস্ত্রি এনে বাসা ঠিকঠাক করে দিয়েছিল। কিন্তু যতদিন ঠিক না হয়েছে, ততদিন গোটা বৃষ্টির মাসটা আমাদের পানির নিচেই গেছে। বাসার জিনিসপত্র এলোমেলো হয়ে গেছে। একটার ওপর একটা উঠিয়ে রেখে কোনোমতে দিন পার করছি। আর হঠাৎ করে এ অবস্থায় জিনিসপত্র নিয়ে কোথায় যাব!
আশ্চর্যের বিষয়, বাড়িওয়ালাও নিচতলাতেই থাকে। কিন্তু তার বাসাতে পানি ঢোকে না। পানি ঢোকে ভাড়াটিয়ার বাসায়। কারণ ভাড়াটিয়ার বাসার জায়গাটা অপেক্ষাকৃত নিচু। তাই বৃষ্টি হলে সব পানি ওখানেই ঢুকে যায়। বাথরুমে যাওয়া যেত না। আজকের দিনেও কেউ না কেউ এমন অবস্থায় নিশ্চয়ই পড়ছে। কিন্তু এখন আমি ভাবতে পারি না সেই দিনগুলোর যন্ত্রণার কথা।
তারপর একদিন বাড়িওয়ালার দয়া হলো, সে একটা কমোড লাগিয়ে দিল। হাই কমোড। তাতে সুবিধা যেটা হলো, তখন আর বৃষ্টি হলেও কমোড ভেসে যায় না। কিন্তু তারপর শুরু হলো আরেক সমস্যা। সেটা হলো বিদ্যুৎ। তখন তো এমনিতেও ঘন ঘন বিদ্যুৎ চলে যেত। সেই সাথে ছিল এ বাসার নিজস্ব বিদ্যুতের সমস্যা। একটা ইলেক্ট্রিশিয়ান থাকত পাশে। তাকে দিয়ে ঠিক করানো হয়েছিল। কিন্তু সে এসে কী করল- একটা সার্কিট ব্রেকার লাগিয়ে দিয়ে গেল। তখন তো আরেক ঝামেলা। দিনের মধ্যে তিন-চারবার সার্কিট ব্রেকারটা বন্ধ হয়ে যায়। ততবার গিয়ে গিয়ে বাড়িওয়ালাকে ডেকে তুলতে হয়। মহা মুশকিল।
এভাবে ওখানে বছরখানেক থেকেছিলাম আমরা। তারপর চলে এলাম মোহাম্মদপুর। আমার ব্যক্তিগত জীবনের প্রথম ভাড়া বাসায়, আমি নিজেই নোটিশ দিয়ে ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু তার পরের বাসায় আমি নোটিশ দেইনি, বরং আমাকেই বিনা নোটিশে তাড়িয়ে দিয়েছিল। তবে আজকে এসে মনে হয় তখন কম বয়স ছিল বলে, ওরকমভাবে বাসায় পানি ঢোকা সহ্য করতে পেরেছিলাম। এখন হলে সহ্য করতে পারতাম না।
মোহাম্মদপুরে অনেকদিন থেকেছি। অবশ্যই নিচতলায় নয়, দোতলায়। নজরুল ইসলাম রোড। কত নম্বর বাসা ভুলে গেছি। তবে সেখানে ছয় বছরের মতো ছিলাম। ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত। বাড়িটা ছিল একটা দখলের বাড়ি। বস্তুত মোহাম্মদপুর কিন্তু দখলের এলাকা। সেখানে বহু অবাঙালির বাড়ি বাঙালিরা দখল করেছে। একাত্তর-পরবর্তী বেশিরভাগ পুরোনো বাড়িই দখল করা। ওই সময় আমি মাত্র জাতিসংঘের কাজে যোগদান করেছি। আমাকে একটা দালাল এসে প্রায়ই বলত মোহাম্মদপুরের বাড়ি দখলের কাহিনি। সে আমাকে বলত-
আপনি এ বাড়িটা নিয়ে নেন না কেন? এই বাড়িরও তো কাগজপাতি নাই।
কিন্তু আমার এ সংক্রান্ত কোনো আগ্রহ যেহেতু ছিল না, বিরক্তই লাগত লোকটাকে। পরে বুঝলাম আমাকে দিয়েই বাসাটা বিক্রি করানোর চেষ্টা করছে। একেক বাসার একেকরকমের বিড়ম্বনা আর কি।
আমার মেয়ে তখন খুব ছোট। দু'তিন মাস বয়স। তার মধ্যে একদিন ওই দখল করা বাড়ির বাড়িওয়ালা ডেকে বলল- আপনারা বাসা ছেড়ে দেন।
আমি খুব হতভম্ব হয়ে গেছি।
কেন বাসা ছেড়ে দিতে হবে!
বলে যে- আমি এটা ভেঙে চারতলা করব ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমার যে কী রকম অদ্ভুত লেগেছিল তখন, বলে বোঝাতে পারব না। এটা যে কী একটা অসহায় অবস্থা! সবচেয়ে বড় সমস্যাটা হলো, আমার বাচ্চার বয়স তখন দু'তিন মাস।
লালমাটিয়ার একটা বাসাতে গিয়ে উঠলাম। মনে আছে, তখনকার দিনের বেবিট্যাক্সিতে করে মেয়েটাকে কম্বলে পেঁচিয়ে নিয়ে গিয়ে ওই বাসাটাতে উঠেছিলাম।
আমার যতদূর ধারণা, লোকটা ওই দালালটাকে দেখে ফেলেছিল। হয়তো ভেবেছিল যে, আমি যদি তার বাড়িটা দখল করে ফেলি। সাথে অন্য ভাড়াটিয়াদেরও সে তাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে- সে যে বলেছিল বাড়ি বানাবার জন্য ভাড়াটিয়াদের উঠিয়ে দিচ্ছে, সেই লোকের বাড়ি এই কিছুদিন আগেও আমি দেখেছি, এখনও কিন্তু একইরকম ভাঙাচোড়া পুরোনো অবস্থায় রয়ে গেছে।
লালমাটিয়ার বাড়ি থেকেও এক দিনের নোটিশে বেরিয়ে যেতে হয়েছিলে। ৩০ তারিখে এসে বলে- কালকে আপনাকে বাসা ছেড়ে দিতে হবে। সম্ভবত ১৯৯০ হবে তখন।
এরপর আবার আরেকটা বাসায় গেলাম। সেখান থেকে গেলাম আরেক বাসায়। এরপর ২০০৭ সালে কানাডা চলে গেলাম।
১৯৮১ সাল থেকে এই শহরে ভাড়া করে করেই থাকতে হয়েছে। মাঝখানে কানাডায় যখন ছিলাম, সেখানে নিজের বাসা হয়েছিল- কারণ সেখানে বাসা কেনা সহজ। খুব গরিব মানুষও ব্যাংকের মাধ্যমে বাড়ি কিনতে পারে। সে যা-ই হোক, এই ২০২২ সালে এসেও এই ঢাকা শহরে ভাড়া বাসাতেই আছি। নিকেতনে। এ বাসায় দশ বছর হয়ে গেল।