- ফিচার
- নারী :অর্ধেক কপালজুড়ে রোদ
নারী :অর্ধেক কপালজুড়ে রোদ

গত ৯ জুন ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। একদিকে সরকারের প্রবল উন্নয়নের অগ্রযাত্রা আর বিপরীতে কোন কোন খাতে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে নারী উন্নয়নে ২ লাখ ২৯ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকার জেন্ডার বাজেট পেশ করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সংসদে বাজেট বক্তৃতায় এ প্রস্তাব করেন। এই বরাদ্দ গত অর্থবছরের তুলনায় ৩০ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা বেশি।
নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে নারী উন্নয়ন-সংক্রান্ত কার্যক্রম ও অগ্রাধিকার রয়েছে এমন ৪৪টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে আওতাভুক্ত করে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে জেন্ডার বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। দেশের প্রতিটি নারী এর সুফলভোগী হবেন ভাবতে ভালো লাগছে। বাজেটের বরাদ্দ বৃদ্ধি নারীর এই এগিয়ে যাওয়াকে সুগম করবে বলে আশা করছি।
অর্থমন্ত্রী ২০২২-২৩ অর্থবছরের যে বাজেট ঘোষণা করেছেন, তাতে বিভিন্ন পণ্যের সম্পূরক শুল্ক্ক, আমদানি শুল্ক্ক অথবা মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) কমানো হয়েছে। ফলে দাম কমতে পারে ছোট রেস্তোরাঁর খাবার, হুইলচেয়ার, মুড়ি, চিনির। হাঁস-মুরগি, গবাদি পশুর খাবার তৈরির উপকরণে করছাড় দিয়েছে সরকার। এতে এসব পণ্যের উৎপাদন ব্যয় কমতে পারে। কিন্তু নারীর চাহিদার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত কোনো পণ্য এ তালিকায় নেই।
জেন্ডার বাজেট কী? জেন্ডার বাজেট নারীর জন্য আলাদা কোনো বাজেট নয় কিংবা বাজেটে নারীর জন্য কতটা বরাদ্দ দেওয়া হলো, তা নয়। জেন্ডার বাজেট হচ্ছে বাজেটে বরাদ্দ ও বাস্তবায়নে নারীর ইস্যুগুলো ইক্যুইটির ভিত্তিতে বিবেচনায় নেওয়া হয় কিনা? কারণ এখনও সমাজে নারী ও পুরুষের চাহিদা ভিন্ন। এই ভিন্ন চাহিদাকে বরাদ্দ ও বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় কিনা- সেটা দেখাই জেন্ডার বাজেট। নারী ও পুরুষের ওপর বাজেটের যে পৃথক প্রভাব এবং নারী-পুরুষের চাহিদার যে ভিন্নতা, তাকে আমলে নিয়ে বাজেট বরাদ্দকে বোঝায়।
বাজেটে নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ বৃদ্ধি বা জেন্ডার বাজেটিং নিয়ে অর্থনীতিবিদ, নারী অধিকার কর্মীদের ভাবনা জানতে কথা বলেছিলাম কয়েকজনের সঙ্গে। তাঁরা সবাই বলেছেন, ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতনকে আমলে নিতেই হবে, না হলে বরাদ্দ বাড়ানো বা নারী উন্নয়নে গৃহীত কোনো পদক্ষেপই কাজে আসবে না।
মুক্তিযোদ্ধা ও নারী নেত্রী রোকেয়া কবীর বলেন, 'করোনার প্রাদুর্ভাবের পর নারীর জন্য বেশ কিছু নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। অথচ আগামী বাজেটে সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় নারী ও শিশু নেই। স্বাস্থ্য, প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন, কৃষি, শিক্ষা ও দক্ষতা, পল্লি উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান, গৃহনির্মাণ, খাদ্য বিতরণ প্রভৃতি অগ্রাধিকারের ভিড়ে হারিয়ে গেছে নারী ও শিশুর বিষয়টি। বয়স্কভাতা, বিধবাভাতা, স্বামী নিগৃহীতদের জন্য ভাতা, ভিজিডির আওতায় খাদ্য ও আয় বৃদ্ধিমূলক কাজে সহায়তা, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা, দরিদ্র মায়েদের মাতৃত্ব ভাতা, কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মায়েদের ভাতাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি বারবার তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু
এগুলো কোথায় কীভাবে খরচ হচ্ছে বা হচ্ছে কিনা তার কোনো মনিটরিং নেই। মনিটরিংয়ের জন্য একটি অথরিটি থাকতে হবে; যাতে এই বাজেট কোথায় কীভাবে খরচ হচ্ছে, তা ট্র্যাক করা যায়।' তিনি শিক্ষা কারিকুলামকে জেন্ডার সংবেদনশীল করার ওপর গুরুত্ব দেন। কারণ কারিকুলাম জেন্ডার সংবেদনশীল না হলে বরাদ্দ বাড়িয়ে নারীর অবস্থানের উন্নতি করা যাবে না। তিনি আরও বলেন, 'কেবল নারী সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য ৬ মাস মাতৃত্বকালীন ছুটির ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু বেরসরকারি খাতে বা এনজিওতে এ সুবিধা নেই। এটার জন্য সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে দরকষাকষি করতে হবে। নারীর ন্যায়বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের সংখ্যা বাড়াতে হবে, সক্ষমতা ও জনবল বৃদ্ধি করতে হবে। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার বাড়াতে হবে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে অসহায় নারীদের আইনি সহায়তা বাড়াতে হবে। সার্বিকভাবে নিরাপত্তা বাড়াতে হবে। এমন সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা ছাড়া কেবল বরাদ্দ বাড়িয়ে নারীর ক্ষমতায়ন ও মর্যাদা বৃদ্ধি করা যাবে না।'
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক শরমিন্দ নিলোর্মী বলেন, 'গত দুই বছর জেন্ডার বাজেট সংক্ষিপ্ত ছিল। সামষ্টিক অর্থনীতির সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেও ২০২২-২৩ অর্থবছরে জেন্ডার বাজেট প্রণয়নকে স্বাগত জানাচ্ছি। জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদনে কোন কোন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে, এর মেথডলজি কী ছিল, সীমাবদ্ধতা কী ছিল, এসডিজির কত নাম্বার ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত তা তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু গত অর্থবছরের যে জেন্ডার বাজেট ছিল তার কোন খাতে কতটা খরচ হয়েছে, তা সংক্ষেপে উল্নেখ করা হয়েছে। যেমন- গত অর্থবছরে শ্রম ও কর্মশক্তি মন্ত্রণালয়ের কারখানা অধিদপ্তর ৩ হাজার ৫৯২টি ডেকেয়ার সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছে। এটা কি পাবলিক এক্সপেনডিচারে হয়েছে না প্রাইভেট পাবলিক পার্টনারশিপে হয়েছে তার কোনো উল্নেখ নেই। আশা করছি, রিভাইজড বাজেটে সেটা সংক্ষিপ্ত হলেও থাকবে।' তিনি আরও বলেন, 'নারীর ক্ষমতায়ন ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধিতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবায়ন ও ইমপ্যাক্টের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।'
নারী আন্দোলনের কর্মী ও জেন্ডার বিশেষজ্ঞ রেখা সাহা বলেন, জেন্ডার বাজেটিং দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল। সেদিক থেকে এটা একটা অর্জন। প্রতি বছরই বরাদ্দ বেড়েছে। কিন্তু বরাদ্দের বাস্তবায়ন কীভাবে হচ্ছে, অন্য মন্ত্রণালয়গুলোর প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় নারীর ইক্যুইটি, অগ্রাধিকার কতটুকু বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে সেটার কোনো মনিটরিং নেই। সরকার এখনও সিডও সনদের ধারা ২ ও ১৬-এর গ অনুমোদন করেনি। ২০১১ সালে প্রণীত নারী উন্নয়ন নীতিমালার কর্মপরিকল্পনা হলেও বাস্তবায়ন করেনি। এগুলোর বাস্তবায়ন না হওয়া নারীর সংবিধানে প্রাপ্ত অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ফলে এগুলোর বাস্তবায়ন না করে কেবল বরাদ্দ বাড়িয়ে নারীর বঞ্চনা ও অসাম্যকে তুলে ধরা যাবে না। এ ছাড়া নারীর ব্যক্তিজীবনের অসাম্য দূর করার লক্ষ্যে নারী সমাজের যে দাবি 'ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোর্ট', সেটারও বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে সামাজিক ও পারিবারিকভাবে নারী তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এসব বঞ্চনা নীতি ও চর্চায় রেখে শুধু বরাদ্দ বাড়িয়ে নারীর ক্ষমতায়ন হবে না।
মেয়েরা এখন অনেক বেশি স্বনির্ভর। তবু চিত্র একেবারে পাল্টে যায়নি। দীর্ঘদিনের নারী আন্দোলনের কর্মী সুফিয়া আখ্তার বলেন, 'শেষ পর্যন্ত লিঙ্গ রাজনীতি ও নারীর শরীর নারীর অধস্তনতায় গিয়ে শেষ হয় নারীর সামাজিক পরিচয়। নারীর অবস্থানের ইতিবাচক পরিবর্তন ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের জন্য কোনো কর্মসূচির প্রতিফলন বাজেটে আমরা দেখতে পাই না। নারীর পোশাক ও চলাচল নিয়ে যে নতুন নির্যাতনের ক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে, সেটাকে অ্যাড্রেস না করে কেবল বরাদ্দ বাড়িয়ে এর সুফল পাওয়া যাবে না। সমাজে নারীর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির জন্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড যেগুলো এখন প্রায় বন্ধ আছে সেগুলো বাড়াতে হবে। প্রায় ৪৪টি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে জেন্ডার বাজেট ক্রসকাটিং হিসেবে আছে কিন্তু সব ক্ষেত্রে জেন্ডার বাজেটের প্রতিফলন দেখতে পাই না। যেমন দেখতে পাই শিক্ষায়। গত এক দশকে বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি ও ইতিবাচক পদক্ষেপের ফলে শিক্ষায় ও কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে জেন্ডার বাজেটিংয়ের প্রতিফলন পাওয়া যায় না। মনিটরিংও নেই।'
লেখক : উন্নয়নকর্মী
নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে নারী উন্নয়ন-সংক্রান্ত কার্যক্রম ও অগ্রাধিকার রয়েছে এমন ৪৪টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে আওতাভুক্ত করে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে জেন্ডার বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। দেশের প্রতিটি নারী এর সুফলভোগী হবেন ভাবতে ভালো লাগছে। বাজেটের বরাদ্দ বৃদ্ধি নারীর এই এগিয়ে যাওয়াকে সুগম করবে বলে আশা করছি।
অর্থমন্ত্রী ২০২২-২৩ অর্থবছরের যে বাজেট ঘোষণা করেছেন, তাতে বিভিন্ন পণ্যের সম্পূরক শুল্ক্ক, আমদানি শুল্ক্ক অথবা মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) কমানো হয়েছে। ফলে দাম কমতে পারে ছোট রেস্তোরাঁর খাবার, হুইলচেয়ার, মুড়ি, চিনির। হাঁস-মুরগি, গবাদি পশুর খাবার তৈরির উপকরণে করছাড় দিয়েছে সরকার। এতে এসব পণ্যের উৎপাদন ব্যয় কমতে পারে। কিন্তু নারীর চাহিদার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত কোনো পণ্য এ তালিকায় নেই।
জেন্ডার বাজেট কী? জেন্ডার বাজেট নারীর জন্য আলাদা কোনো বাজেট নয় কিংবা বাজেটে নারীর জন্য কতটা বরাদ্দ দেওয়া হলো, তা নয়। জেন্ডার বাজেট হচ্ছে বাজেটে বরাদ্দ ও বাস্তবায়নে নারীর ইস্যুগুলো ইক্যুইটির ভিত্তিতে বিবেচনায় নেওয়া হয় কিনা? কারণ এখনও সমাজে নারী ও পুরুষের চাহিদা ভিন্ন। এই ভিন্ন চাহিদাকে বরাদ্দ ও বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় কিনা- সেটা দেখাই জেন্ডার বাজেট। নারী ও পুরুষের ওপর বাজেটের যে পৃথক প্রভাব এবং নারী-পুরুষের চাহিদার যে ভিন্নতা, তাকে আমলে নিয়ে বাজেট বরাদ্দকে বোঝায়।
বাজেটে নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ বৃদ্ধি বা জেন্ডার বাজেটিং নিয়ে অর্থনীতিবিদ, নারী অধিকার কর্মীদের ভাবনা জানতে কথা বলেছিলাম কয়েকজনের সঙ্গে। তাঁরা সবাই বলেছেন, ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতনকে আমলে নিতেই হবে, না হলে বরাদ্দ বাড়ানো বা নারী উন্নয়নে গৃহীত কোনো পদক্ষেপই কাজে আসবে না।
মুক্তিযোদ্ধা ও নারী নেত্রী রোকেয়া কবীর বলেন, 'করোনার প্রাদুর্ভাবের পর নারীর জন্য বেশ কিছু নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। অথচ আগামী বাজেটে সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় নারী ও শিশু নেই। স্বাস্থ্য, প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন, কৃষি, শিক্ষা ও দক্ষতা, পল্লি উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান, গৃহনির্মাণ, খাদ্য বিতরণ প্রভৃতি অগ্রাধিকারের ভিড়ে হারিয়ে গেছে নারী ও শিশুর বিষয়টি। বয়স্কভাতা, বিধবাভাতা, স্বামী নিগৃহীতদের জন্য ভাতা, ভিজিডির আওতায় খাদ্য ও আয় বৃদ্ধিমূলক কাজে সহায়তা, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা, দরিদ্র মায়েদের মাতৃত্ব ভাতা, কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মায়েদের ভাতাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি বারবার তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু
এগুলো কোথায় কীভাবে খরচ হচ্ছে বা হচ্ছে কিনা তার কোনো মনিটরিং নেই। মনিটরিংয়ের জন্য একটি অথরিটি থাকতে হবে; যাতে এই বাজেট কোথায় কীভাবে খরচ হচ্ছে, তা ট্র্যাক করা যায়।' তিনি শিক্ষা কারিকুলামকে জেন্ডার সংবেদনশীল করার ওপর গুরুত্ব দেন। কারণ কারিকুলাম জেন্ডার সংবেদনশীল না হলে বরাদ্দ বাড়িয়ে নারীর অবস্থানের উন্নতি করা যাবে না। তিনি আরও বলেন, 'কেবল নারী সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য ৬ মাস মাতৃত্বকালীন ছুটির ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু বেরসরকারি খাতে বা এনজিওতে এ সুবিধা নেই। এটার জন্য সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে দরকষাকষি করতে হবে। নারীর ন্যায়বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের সংখ্যা বাড়াতে হবে, সক্ষমতা ও জনবল বৃদ্ধি করতে হবে। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার বাড়াতে হবে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে অসহায় নারীদের আইনি সহায়তা বাড়াতে হবে। সার্বিকভাবে নিরাপত্তা বাড়াতে হবে। এমন সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা ছাড়া কেবল বরাদ্দ বাড়িয়ে নারীর ক্ষমতায়ন ও মর্যাদা বৃদ্ধি করা যাবে না।'
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক শরমিন্দ নিলোর্মী বলেন, 'গত দুই বছর জেন্ডার বাজেট সংক্ষিপ্ত ছিল। সামষ্টিক অর্থনীতির সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেও ২০২২-২৩ অর্থবছরে জেন্ডার বাজেট প্রণয়নকে স্বাগত জানাচ্ছি। জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদনে কোন কোন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে, এর মেথডলজি কী ছিল, সীমাবদ্ধতা কী ছিল, এসডিজির কত নাম্বার ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত তা তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু গত অর্থবছরের যে জেন্ডার বাজেট ছিল তার কোন খাতে কতটা খরচ হয়েছে, তা সংক্ষেপে উল্নেখ করা হয়েছে। যেমন- গত অর্থবছরে শ্রম ও কর্মশক্তি মন্ত্রণালয়ের কারখানা অধিদপ্তর ৩ হাজার ৫৯২টি ডেকেয়ার সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছে। এটা কি পাবলিক এক্সপেনডিচারে হয়েছে না প্রাইভেট পাবলিক পার্টনারশিপে হয়েছে তার কোনো উল্নেখ নেই। আশা করছি, রিভাইজড বাজেটে সেটা সংক্ষিপ্ত হলেও থাকবে।' তিনি আরও বলেন, 'নারীর ক্ষমতায়ন ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধিতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবায়ন ও ইমপ্যাক্টের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।'
নারী আন্দোলনের কর্মী ও জেন্ডার বিশেষজ্ঞ রেখা সাহা বলেন, জেন্ডার বাজেটিং দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল। সেদিক থেকে এটা একটা অর্জন। প্রতি বছরই বরাদ্দ বেড়েছে। কিন্তু বরাদ্দের বাস্তবায়ন কীভাবে হচ্ছে, অন্য মন্ত্রণালয়গুলোর প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় নারীর ইক্যুইটি, অগ্রাধিকার কতটুকু বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে সেটার কোনো মনিটরিং নেই। সরকার এখনও সিডও সনদের ধারা ২ ও ১৬-এর গ অনুমোদন করেনি। ২০১১ সালে প্রণীত নারী উন্নয়ন নীতিমালার কর্মপরিকল্পনা হলেও বাস্তবায়ন করেনি। এগুলোর বাস্তবায়ন না হওয়া নারীর সংবিধানে প্রাপ্ত অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ফলে এগুলোর বাস্তবায়ন না করে কেবল বরাদ্দ বাড়িয়ে নারীর বঞ্চনা ও অসাম্যকে তুলে ধরা যাবে না। এ ছাড়া নারীর ব্যক্তিজীবনের অসাম্য দূর করার লক্ষ্যে নারী সমাজের যে দাবি 'ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোর্ট', সেটারও বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে সামাজিক ও পারিবারিকভাবে নারী তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এসব বঞ্চনা নীতি ও চর্চায় রেখে শুধু বরাদ্দ বাড়িয়ে নারীর ক্ষমতায়ন হবে না।
মেয়েরা এখন অনেক বেশি স্বনির্ভর। তবু চিত্র একেবারে পাল্টে যায়নি। দীর্ঘদিনের নারী আন্দোলনের কর্মী সুফিয়া আখ্তার বলেন, 'শেষ পর্যন্ত লিঙ্গ রাজনীতি ও নারীর শরীর নারীর অধস্তনতায় গিয়ে শেষ হয় নারীর সামাজিক পরিচয়। নারীর অবস্থানের ইতিবাচক পরিবর্তন ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের জন্য কোনো কর্মসূচির প্রতিফলন বাজেটে আমরা দেখতে পাই না। নারীর পোশাক ও চলাচল নিয়ে যে নতুন নির্যাতনের ক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে, সেটাকে অ্যাড্রেস না করে কেবল বরাদ্দ বাড়িয়ে এর সুফল পাওয়া যাবে না। সমাজে নারীর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির জন্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড যেগুলো এখন প্রায় বন্ধ আছে সেগুলো বাড়াতে হবে। প্রায় ৪৪টি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে জেন্ডার বাজেট ক্রসকাটিং হিসেবে আছে কিন্তু সব ক্ষেত্রে জেন্ডার বাজেটের প্রতিফলন দেখতে পাই না। যেমন দেখতে পাই শিক্ষায়। গত এক দশকে বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি ও ইতিবাচক পদক্ষেপের ফলে শিক্ষায় ও কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে জেন্ডার বাজেটিংয়ের প্রতিফলন পাওয়া যায় না। মনিটরিংও নেই।'
লেখক : উন্নয়নকর্মী
মন্তব্য করুন