বাবার কাঁধটা হয়তো অন্য সবার চেয়ে চওড়া- তা না হলে কী করে এত দায়ভার অবলীলায় বয়ে বেড়ান। অথচ পড়ন্তবেলায় সেই বাবা কখনও অর্থনৈতিক প্রশ্নে আপনজনের মুখাপেক্ষী, কখনও বা কেবল ভালোবাসার দায়ে কাতর। এ বিষয়গুলো নিয়ে লিখেছেন বিশাখা বনলক্ষ্মী
ছেঁড়া ময়লা গেঞ্জির মধ্যে ৯০ বছরের পুরোনো ক্লান্ত শরীরটা। শীর্ণ দুটি হাতের প্রাণান্ত চেষ্টা দ্রুত ঝাল চানাচুর তৈরির। কারণ তাঁকে ঘিরেই বসে আছে জনাদশেক খুদে গ্রাহক। কিন্তু আজীবন পরিশ্রমে শ্রান্ত দুটি হাত এরই মধ্যে হারিয়েছে ক্ষিপ্রতা। এদিকে তৈরি হওয়া ঝাল চানাচুর নিয়ে খুদে ক্রেতারা একজনের পর একজন দে ছুট। কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের গজেরকুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিত্যক্ত ভবনের বারান্দায় বসে ঝাল চানাচুর বিক্রি করছেন নজরুল ইসলাম। গ্রাহকরা বিদায় হলেও খানিকটা জিরিয়ে নিতেই বসে থাকলেন তিনি। জানালেন বয়স ৯০ পেরিয়েছে। তিনি এক ছেলে ও এক মেয়ের 'হতভাগা' বাবা।
আবারও খানিকটা ঘনিষ্ঠ হয়ে চেপে ধরতেই বেরিয়ে এলো কিছু কথা। না বলা দুঃখ, জমানো কষ্ট। সন্তানের প্রতি অভিমানের কথা জানাতে চাননি। তাই এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলেন এই বাবা। বাবারা মনে হয় এমনই হয়! সন্তানের দেওয়া শত দুঃখ-কষ্ট, আঘাত জমিয়ে বুকটাকে করে রাখেন সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। কখনও কখনও সেখানে খোঁচা দিলে বেরিয়ে আসে উত্তপ্ত লাভার মতো। কখনও ঝর্ণাধারার মতো।
নজরুল ইসলামের বাড়ি কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের খলিশাকোঠাল গ্রামে। এক ছেলে ও এক মেয়ে ব্যস্ত নিজেদের সংসার নিয়ে। খোঁজ নেন না বাবা-মায়ের। নজরুল জানালেন, ৪০ বছর ধরে কাঁধে সওয়ার হয়েছে চানাচুর ও শুঁটকির ভার। এর বদৌলতেই দু'মুঠো অন্ন জোটে নজরুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী মজিরন বেগমের। ৩০ বছর আগে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেও বিয়ে করে নিজের মতো করে সংসার করছেন। পরিবার নিয়ে থাকেন রাজধানীতে। বাবা-মায়ের দিন কীভাবে কাটে তার খোঁজ নেন না ছেলেমেয়ের কেউই।
তিনি বলেন, 'জমিজমা নেই। মাত্র ১০ শতক জমিতে স্ত্রীসহ থাকি। দুর্ভাগ্য আমার একমাত্র ছেলে দেখে না। খুব কষ্ট মনে বাহে।' কথা বলতে বলতে ঝুলে পড়া চোয়াল থরথর করে কেঁপে ওঠে নজরুল ইসলামের। ধরা গলায় তিনি বলেন, '৯০ বছর বয়সের কোনো বাবা পেটের তাগিদে ভার ঘাড়ে নিয়ে চানাচুর ও শুঁটকি বিক্রি করছেন কিনা জানি না, আমি করছি। দিনে বিক্রি হয় মাত্র ১০০ থেকে ১৫০ টাকার। এর সঙ্গে আছে বয়স্ক ভাতা। জমাতে পারিনি ১ টাকাও। দুই বুড়াবুড়ির ভরণপোষণ ও ওষুধপথ্য কিনতেই অবস্থা খারাপ।'
এমন দুর্ভাগা বাবা শুধু নজরুল ইসলাম একা নন। গ্রামাঞ্চলে বা নিম্নবিত্তের সমাজে নজরুলরাই বাবাদের প্রতিনিধিত্ব করছেন। ঘরে ঘরে বয়সের ভারে নুয়ে পড়া নজরুলরা খাবারের জোগাড় এভাবেই করেন। আমৃত্যু বয়ে বেড়ান অবসরহীন জীবন।
বৈচিত্র্যময় এ পৃথিবীতে মানুষের সমস্যার ধরনও হয় ভিন্ন। বিত্তহীনের প্রয়োজন সামান্য ভরণপোষণ, খানিকটা অবসর। আবার কেউ প্রাচুর্যের মধ্যেও অখণ্ড অবসরে হাঁপিয়ে ওঠেন নিঃসঙ্গতার বোঝার চাপে।
অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক আব্দুল হাকিম (ছদ্মনাম)। আর্থিক কোনো অনটন নেই। তিন ছেলেমেয়ের কেউই থাকেন না কাছে। একমাত্র ছেলে নিজের পরিবার নিয়ে আলাদা থাকেন। মেয়েরাও নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। কেউই বাবাকে সময় দেন না। নাতি-নাতনিদের সঙ্গে সময় কাটাতে খুব পছন্দ করেন। কিন্তু তা পান না।
অসুস্থ এই বাবা একবুক অভিমান নিয়েই জীবন কাটাচ্ছেন। সন্তানদের বিরুদ্ধে তিনি কোনো অভিযোগ করেননি। তবু নীরবতার ফাঁকে ফাঁকেই অবাধ্য দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। জানান দেয়, ভেতরে জমে থাকা কষ্টের উপস্থিতি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'একা একা লাগে। কথা বলার লোক নেই। খারাপ তো লাগেই। সন্তানের চেয়ে আপনজন আর কে আছে? কিন্তু আপনজনরা যদি দূরে থাকতে পছন্দ করে, মন থেকে অনুভব না করে, তাহলে কিইবা করার থাকে। কার কাছে বিচার দেব? সব কিছুর পরও বাবা-মা চায় সন্তান ভালো থাকুক।'
সত্যিই তাই, সন্তানের বয়স বাড়লে সন্তান খানিকটা দূরেই চলে যায়। তবে বাবা-মায়ের ক্ষেত্রে আবার বিষয়টা পুরোই উল্টো। বয়স যতই বাড়ে, বাবা-মায়ের চিন্তা ততই পরিবারকেন্দ্রিক হয়। সন্তান, নাতি-নাতনি এসব নিয়েই থাকতে চান তাঁরা। এদিকে সন্তানের আলাদা ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের যে দূরত্ব (জেনারেশন গ্যাপ) তা প্রভাব ফেলে বাবা ও সন্তানের মনোজগতে। দুই বিপরীতমুখী চাওয়া তৈরি হয় দু'জনের। এতে কখনও কখনও অসন্তুষ্ট হন বাবা। তবে ব্যতিক্রমও রয়েছে।
অত্যন্ত আধুনিক মানসিকতাসম্পন্ন একজন বাবা মানজারে হাসিন মুরাদ। ৬৫ বছর বয়সেও অবসর নেননি কর্ম থেকে। নিজের জীবনকে জড়িয়ে রেখেছেন শিল্পের সঙ্গে। স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ তাঁর নেশা। প্রতিনিয়ত চিন্তার জাল বুনে চলেছে তাঁর মাথা। সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছুটছে শরীরও। তাঁর না আছে অভাব-অনটন, না আছে নিঃসঙ্গতা।
মানজারে হাসিন বলেন, 'এ ক্ষেত্রে দুই ধরনের বিষয় কাজ করতে পারে। নিম্ন আয়ের একজন বাবার ক্ষেত্রে আর্থিক চাহিদা বেশি কাজ করে। তাঁরা চান সন্তান তাঁর বৈষয়িক প্রয়োজন মেটাবে। আবার উচ্চবিত্ত বা শহুরে বাবাদের প্রয়োজন অন্য জায়গায়। এ ক্ষেত্রে পারিবারিক-সামাজিক মূল্যবোধ মুখ্য হয়ে ওঠে। এখানে দুই প্রজন্মের মধ্যে চিন্তাধারার পার্থক্য তৈরি হয়। এটি স্বাভাবিক। এটি হবেই। বাবা-মাকে ছেড়ে অন্য কোনো শহরে বা বিদেশে চলে যাচ্ছে সন্তানরা। তখন শারীরিক দূরত্ব তৈরি হয়। খানিকটা একাকিত্ব অনুভব হয়। যখন সন্তান বড় হচ্ছে, তাঁদের প্রয়োজনের দিকটাও বাবা-মায়ের বিবেচনায় নেওয়া দরকার। অনেক সময় কর্মক্ষেত্র, পারিবারিক ও সামাজিক বিষয়ে রূঢ় বাস্তবতার শিকার তারাও হয়। তাই সব সময় শারীরিকভাবে পাশে থাকতে এবং প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে না। সেসবও বাবা-মায়ের বিবেচনা করা দরকার।' সন্তানদের জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করার বিষয়েও দ্বিমত পোষণ করেন তিনি।
বয়সের সঙ্গে বাবা-সন্তানের সম্পর্কের মাত্রা পরিবর্তন হয়। সন্তান বড় হতে হতে তার নিজস্বতা তৈরি হয়। সেখানে কারও হস্তক্ষেপ পছন্দ করে না। আবার বাবাও মনে করেন, সন্তান তাঁর কথা শুনছে না। অনেক বাবা মনে করেন, তাঁর প্রতি সন্তানের পারিবারিক, আর্থিক ও সামাজিক দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু সন্তান তা পালন করছে না। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের একজন বাবা বৃদ্ধ হলে ভরণপোষণের প্রত্যাশা করেন। তবে অনেক ছেলেমেয়েই তাদের সে দায়িত্ব পালন করে না। আবার মধ্য বা উচ্চবিত্তরা চায় একটু যত্ন, সময় বা ইচ্ছার মূল্যায়ন।
বাবা-সন্তানের দ্বিমুখী প্রত্যাশার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক রাশেদা ইরশাদ নাসির বলেন, 'নিম্ন আয়ের একজন বাবা ও উচ্চবিত্ত পরিবারের বাবার চাওয়া হয়তো আলাদা, তবে ফলাফল একই। প্রত্যেক সন্তানের নিজস্ব পরিবার বা জগৎ গড়ে ওঠে। তারা তখন নিজের পরিবার নিয়েই ব্যস্ত হয়ে উঠছে। এভাবেই চলে আসছে পারিবারিক-সামজিক ব্যবস্থা। ভবিষ্যতে আরও হবে। বাবা-মাকে দেখা সন্তানের নৈতিক দায়িত্ব। নানা বাস্তবতার কারণে তা পালন করা সব সময় হয়ে ওঠে না। এ ক্ষেত্রে যাদের আর্থিক টানাপোড়েন আছে, তারা বাবা-মাকে বোঝা মনে করছে। কারণ, তার বাবারও হয়তো কোনো সম্পদ নেই।'
তিনি বলেন, 'সন্তানের লেখাপড়া, আর্থিক-সামাজিক মর্যাদার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছে মানুষ। কে কী করল, সেটির সঙ্গে তুলনা করে নিজের প্রয়োজন নির্ধারিত হয়। তখন বাবা কী চাইলেন, তা আর মুখ্য বিষয় থাকে না। সন্তানের স্কুল-কোচিংয়ে দৌড়াদৌড়ি, কেনাকাটা, পার্টিতে যাওয়া এসবের কারণে বাবা-মাকে সময় দেওয়া হয় না।'
এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য রাশেদা ইরশাদ নাসির প্রতিযোগিতাপূর্ণ জীবন থেকে বেরিয়ে আরামদায়ক জীবনযাপনের অনুশীলনে জোর দেন। একই সঙ্গে মানবিক সম্পর্কের মূল্যায়নের মানসিকতা তৈরির ওপরও গুরুত্ব আরোপ করেন।