গত ১৬ থেকে ১৮ জুন ভারতের হিমাচল প্রদেশের রাজধানী শিমলায় অনুষ্ঠিত হয় দেশটির অন্যতম শীর্ষ 'উন্মেষ আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসব'। দেশ-বিদেশের অন্তত ৪২৫ জন সাহিত্যিক সেখানে অংশগ্রহণ করেন। বুকারজয়ী সাহিত্যিক গীতাঞ্জলী শ্রী, গীতিকার গুলজার, অভিনেত্রী ও সাহিত্যিক দীপ্তি নাভাল, ক্লাসিক্যাল নৃত্যশিল্পী সোনাল মানসিংহ, লেখক প্রসূন জোশি, ঐতিহাসিক বিক্রম সম্পদ, সংগীত পরিচালক বিশাল ভরদ্বাজ, ঔপন্যাসিক এস এল বীরপ্পাসহ অনেক প্রখ্যাত সাহিত্যিক এ মিলনমেলায় যুক্ত হন। ভারতের কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, সাহিত্য একাডেমি এবং হিমাচল প্রদেশের ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ সম্মিলিতভাবে তিন দিনব্যাপী সাহিত্য উৎসবটির আয়োজন করেছে। এ সাহিত্য উৎসবে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা, গবেষণাপত্র প্রকাশ, আবৃত্তি ও গল্প পাঠ করা হয়েছে। এতে বিভিন্ন সেশনে আদিবাসী সাহিত্য, এলজিবিটিকিউ আন্দোলনকর্মীদের লেখা, হিমাচলের লোকসংগীত, নারী লেখক, শিশু সাহিত্যসহ বিভিন্ন আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
তৃতীয় দিনের সমাপনী সেশনে 'ভারতীয় ভাষায় নারীর লেখা' শীর্ষক আলোচনায় অংশ নিয়ে গীতাঞ্জলি শ্রী বলেছেন, সাহিত্যে নারীকে আলাদা করা একেবারেই ভুল, নারীরাও লিখছেন একই অক্ষরেখায়। লেখক লেখকই। সাহিত্য ও লেখালেখিতে নারী, পুরুষ ও হিজড়ায় বিভক্ত করা ঠিক নয়। এভাবে ভাগ করলে অবিচার করা হয়। একজন লেখক যখন লেখেন তখন তিনি কেবলই লেখক।
তিনি আরও বলেন, পুরস্কার একটি স্বীকৃতি দেয়। এটা একক ব্যক্তির পরিশ্রম নয়। আমি যে পুরস্কার পেয়েছি তার পেছনে অনেক কিছু আছে। যে পরিবেশে আপনি বাস করেন, আপনার কাছের মানুষ, আরও অনেক কিছু এর অন্তর্ভুক্ত। প্রতিটি পুরস্কার একটি আলোর দিকনির্দেশ করে। আমি বুকার পুরস্কার জিতেছি; কিন্তু আমার চারপাশে আরও ভালো সাহিত্যকর্ম রয়েছে। সাহিত্যের প্রতি মানুষের অতটা আবেগ বা ধৈর্য নেই, যতটা চলচ্চিত্র ও ক্রিকেটের ক্ষেত্রে আছে। যখনই আমার নাম নেওয়া হবে, বুকার পুরস্কার যোগ হবে। লোকেরা এই বইটিও পড়বে না, পরের বইটির কথা তো ছেড়েই দিন। সাহিত্য ও বইয়ের মানে সাহিত্যবলয় পর্যন্তই থাকবে। বুকার পুরস্কার বা অন্যান্য পুরস্কার। এটি একটি আলো বা মশালের মতো, যা দেখায় যে, অনুর্বর জমিতে আপনার মাস্টারপিসটি একা নয়, আরও অনেক আছে।
তিনি আরও বলেন, দেশে মূলত অনুবাদের মাত্র দুটি গ্রুপ রয়েছে। প্রথমত, ইংরেজি এবং দ্বিতীয়ত ভারতের স্থানীয় ভাষা। আমরা যদি কোনো রচনা পড়তে চাই, তবে আমাদের ইংরেজিতে বা কিছু স্থানীয় ভাষায় পড়তে হবে। এই অবস্থার পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত এখানে কতটা সাহিত্য আছে সে সম্পর্কে দেশবাসী অজ্ঞই থাকবে।
এর আগে সাহিত্য উৎসবের দ্বিতীয় দিন (১৭ জুন) মাতিয়ে রেখেছেন গীতিকার গুলজার। সেদিন এক সেশনে গুলজার ও বিশাল ভরদ্বাজ যুগলবন্দি রং ছড়িয়েছে গোটা সাহিত্য উৎসবে। 'চলচ্চিত্রের গানে সাহিত্যিক নান্দনিকতার অন্বেষণ' শীর্ষক অধিবেশন চলাকালীন গুলজার 'ওমকারা' ছবির 'বিড়ি জালাই লে জিগার সে' গানটির কথা উল্লেখ করে বলেন, বাস্তবে একটি শ্রেণির বেদনা নিয়ে লেখা হয়েছিল এ গানটি। শোষণ এবং হতাশার কারণে ভুক্তভোগীর লিভারে আগুন ধরেছিল।
গুলজার আন্ধি ছবির একটি গানের কথাও উল্লেখ করেন, যেখানে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার হিসাব চাওয়া হয়। এক ভোট মে বড়ি তাকত হোতি হ্যায় গানটির কথাও তিনি উল্লেখ করেন। গুলজার বলেন, একটি ভোটের দুর্দান্ত ক্ষমতা রয়েছে, যা প্রতিটি ভারতীয় এখন বিবেচনা করে। আমাদের একজন সাধারণ নাগরিক এখন সব কিছু বোঝে, একটি ভোট মানে পুরো দেশের দায়িত্ব নেওয়া। জনসাধারণকে প্রতিটি মন্দকে লড়াই করতে একত্র হওয়ার ডাক ছিল ওই বার্তায়। এর ভিত্তিতে বিশাল ভরদ্বাজ হু তু তু চলচ্চিত্রের গানটি তুলে ধরেন- 'বন্দোবস্ত হ্যায়, বন্দোবস্ত হ্যায়'। বিশাল ভরদ্বাজ বলেন, এখানে তিনি একটি বার্তা দিয়েছেন যে, সাধারণ জনগণ কীভাবে প্রতিটি সমস্যার সমাধান দেয়। বর্তমানে ভারতের অনেক জায়গায় ছড়িয়ে পড়া ঘৃণা সম্পর্কে গুলজার বলেন, এটি বুঝতে হবে যে, এটি কোনো একটি, দুটি বা কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর সমস্যা নয়, বরং পুরো দেশের সমস্যা। আমার আবেদন হলো- প্রত্যেকেরই এটি সম্পর্কে সচেতন হওয়া উচিত। এর ভিত্তিতে বিশাল ভরদ্বাজ 'জাগতে রহো, জাগতে রহো' গানটি গেয়ে শোনান।