বাঙালি ও বাংলা সাহিত্যের অনবদ্য ব্যক্তিত্ব কাজী নজরুল ইসলাম; যিনি তাঁর বহুমাত্রিক সাহিত্যের ভাষায় ইংরেজ সরকারকে বারংবার চোখ রাঙানি দিয়ে বাঙালির মনে, ভারতবাসীর মনে স্বাধীনতার স্বপ্টম্ন এঁকে দিয়েছেন। যাঁকে সেই ত্রিশের দশকেই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বাঙালির জাতীয় কবি হিসেবে গ্রহণ করে নিয়ে বলেছিলেন, 'আমরা যখন যুদ্ধে যাব, তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব, তখনও তাঁর গান গাইব।' পরবর্তী সময়ে বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশে তিনি জাতীয় কবি হিসেবেই অধিষ্ঠিত। সেই আজীবনের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বের নানাদিক নিয়ে বহু বই রচিত হয়েছে। ২০১৮ সালে প্রকাশিত কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা রচিত 'নজরুলের শ্রেষ্ঠত্ব' গ্রন্থটি তার মধ্যে বিশেষভাবে মূল্যায়িত হতে পারে। গ্রন্থটি মূলত বিভিন্ন সময়ে নজরুলকে নিয়ে মুহম্মদ নূরুল হুদার লেখা প্রবন্ধ-নিবন্ধের নির্বাচিত সমাহার। যেখানে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা কবি নজরুলের কাব্য-কর্মজীবন ও ভাবজগৎকে আলোচনা করতে গিয়ে তিরিশি ঘরানার মানদণ্ডে তাঁর কাব্য মূল্যায়ন করে উল্লেখ করেছেন যে, 'আধুনিক বা আধুনিকোত্তর বাংলা কবিতা আজ অবধি মূলত তিরিশি ঘরানার পথ ধরেই সম্প্রসারিত হচ্ছে।' সেক্ষেত্রে বলা যায়, লেখক কবিকে বর্তমানের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক করে আলোচনা করেছেন। নজরুলের কবিতা সম্পর্কে মুহম্মদ নূরুল হুদা তাঁর 'নজরুলের শিল্পসিদ্ধি ও বিদ্রোহী' প্রবন্ধে লিখেছেন, 'চিত্র, উৎপ্রেক্ষা, পুরাণ ও প্রতীকের যে বহুচারী বৈপরীত্বশাসিত প্রয়োগ আধুনিক বা আধুনিকোত্তর কবিতার চরিত্রলক্ষণ, তার প্রায় সবটাই দেখি বিদ্রোহীসহ নজরুলের আরও কিছু কবিতায়।' আর নজরুলের প্রকৃতি যে আপন বেগে পথ কেটে চলার প্রকৃতি তার প্রমাণ কবির 'আর যদি বাঁশি না বাজে' গদ্য থেকেই পাওয়া যায়। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা প্রসঙ্গে বলেন যে, তিনি সেটির প্রথম তিন পঙ্‌ক্তির বাইরে তাঁর নিবিড়পাঠ প্রসারিত করেননি এবং এই তিন লাইনকে ভাঙতে গিয়েই আরও গভীরে চলে গিয়েছেন বারবার আর তিনি যখনই 'বল বীর' পাঠ করেন তখনই নিজেকে বীররূপে কল্পনা করতে থাকেন, যার শির (মান-মর্যাদা) এতটাই উন্নত যে পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গের উচ্চতাও কম বলে কল্পনা হতে থাকে। লেখক নজরুলকে বৈশ্বিক দৃষ্টিতে অবলোকন করতে গিয়ে তাঁর 'আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নজরুলচর্চা প্রসঙ্গে' লেখায় বিখ্যাত লোকবিজ্ঞানী হেনরি গ্লাসির বরাত দিয়ে 'বিদ্রোহী' কবিতাকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম দুটি কবিতার একটি বলে উল্লেখ করেন।
'বিদ্রোহী পাঠ করে কোনো কবিতাপাঠক তাৎক্ষণিকভাবে আক্রান্ত হয়নি, এমন কথা নজরুলের কঠোরতম সমালোচকের মুখেও আজ অবধি শোনা যায়নি'- নিরপেক্ষ নজরুল প্রবন্ধে লেখক নজরুলের কাব্যক্ষমতাকে সংজ্ঞায়িত করতে আরও বলেছেন, 'বল বীর- এই সম্বোধনে তিনি আমাকে আমার পরিচয়টা জানিয়ে দিচ্ছেন।' অর্থাৎ একটি কবিতা কীভাবে একজন পাঠককে তথা একজন মানুষকে আত্মপরিচয়ে আন্দোলিত করে তুলতে পারে 'বিদ্রোহী' তার অনন্য উদাহরণ। এ পরিচয় তো কেবল নিজের নয় বরং বাঙালির, হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে তোলা আবহমান বাংলার।
তবে 'নজরুলের শ্রেষ্ঠত্ব' গ্রন্থটিতে লেখক নজরুলের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরতে গিয়ে নজরুলকে যেন কিছু কিছু জায়গায় প্রকারান্তরে সংকুচিত করে তোলেন। অর্থাৎ লেখক বারবার তাঁকে একটি বিশেষ গণ্ডিতেই আবদ্ধ করে ফেলেন। বইয়ের প্রারম্ভে লেখক নিজেও সে প্রসঙ্গ হিসেবে লিখে দিয়েছিলেন, 'একই প্রসঙ্গ বিভিন্ন রচনায় ফিরে ফিরে আসায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুনরাবৃত্তি পরিহার করা সম্ভব হয়নি।' যা বইজুড়েই লক্ষ্য করা যায়। নজরুলকে নিয়ে করা কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার এই বইতে বিদ্রোহী কবিতার অসংখ্য উদ্ধৃতি লক্ষণীয়; যা কাজী নজরুল ইসলামের বহুমাত্রিকতার অন্য দিকগুলো পাঠকের কাছে যথাযথভাবে ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে অনেকটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে বইকি। অথবা সম্ভবত লেখক নজরুলকে 'বিদ্রোহী'র জন্যই বিশেষভাবে শ্রেষ্ঠ বলে অভিহিত করতে চেয়েছেন।
নজরুলের রচনার স্থানিক, কালিক ও বিশ্বজনীন আবেদন উপলব্ধি করে তার স্বজন-বান্ধব-স্বদেশিরাই শুরু করেছেন ইংরেজি অনুবাদ। আবার ব্রিটিশ শাসকের মাইনে পাওয়া অনুবাদকরা যাঁরা বাঙালি কিন্তু ইংরেজি ভাষায় কিছুটা দক্ষতা অর্জন করেছিল তাঁরাও নজরুলের রচনার অনুবাদ কিংবা সারসংক্ষেপ করে প্রচার করতেন। যেহেতু তাঁরা কবি-সাহিত্যিক ছিলেন না এবং রূপক কিংবা চিত্রকল্প তাঁদের খুব বেশি আত্মস্থ হতো না, তাই তাঁদের অনুবাদগুলো যথেষ্ট মানসম্পন্ন ছিল না বলে লেখক অভিযোগ করেন তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধে। কাজী নজরুল ইসলামকে বারবার তাঁর লেখনীর কারণে ইংরেজ সরকারের রোষানলে পড়তে হয়েছে আর যখনই নজরুলের রচনা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে বা নজরুলকে কারান্তরে পাঠানো হয়েছে, তখনই আরও দ্বিগুণ বেগে ফুঁসে উঠেছিল নজরুলের সৃষ্টিফণা; তথা নজরুল অনুরাগীর মধ্যেও।
বইটিতে স্থান পাওয়া 'নজরুল সুন্দর' প্রবন্ধে মুহম্মদ নূরুল হুদা নজরুলের বহুমাত্রিক কাজের আলোচনা করেছেন যেখানে নজরুলের গান, কবিতা, গদ্য সমস্তকিছু নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। লেখক বলছেন, 'তিনি সংহতি ও সম্প্রসারণের অন্তর্বয়নে অন্য এক ধরনের, বলা যায় নজরুলীয় ধরনের স্থিতিস্থাপক কবিতার স্রষ্টা।' একবিংশ শতাব্দীতে যেসব ক্ষেত্রে নজরুল উত্তরোত্তর প্রাসঙ্গিক হবেন বলে প্রফেসর ল্যাংলি ২০০৬ সালে এক কনফারেন্সে বলেন সেগুলি হলো- উন্নয়ন, বহুসংস্কৃতিবাদ, জাতীয়তা, আন্তর্জাতিকতা, বৈশ্বিকতা, উত্তরাধুনিকতা, পরিবেশচিন্তা, নারীবাদ, মানবপ্রকৃতি, মানব শক্তিমত্তা ইত্যাদি। মুহম্মদ নূরুল হুদা নারীবাদ প্রসঙ্গে কবির 'নারী' কবিতাটিকে উৎকৃষ্ট নারীবাদী কবিতা বলে অভিহিত করেন। এমন বহুবিধ অভিধা ও বিশ্নেষণে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা আমাদের জাতীয় কবির সৃষ্টি ও অস্তিত্বের শ্রেষ্ঠত্বকে পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন এই গ্রন্থে।