ঘরভর্তি এত মানুষ, তবু কেউ একজনও বিষয়টা টের পেল না ক্যান?
আমি এই কথা জিজ্ঞেস করতেই আম্মা রেগেমেগে একশা! মানুষ অধিক শোকে পাথর বা লোহা হয়ে যায় কিন্তু আম্মা অধিক শোকে অগ্নিগর্ভ হয়ে গেছে রাগে-ক্ষোভে! শাড়ির আঁচলটা মুখ থেকে সরিয়ে বলল-
তুই আমার সামনে থেকে যা। আমার কিন্তু খুব রাগ হচ্ছে এখন!
আম্মার সামনে থেকে আমি কিছুটা দূরে সরে আসি। আম্মা কড়া গলায় উত্তর দেয়-
কীভাবে টের পাবে ঘরের মানুষজন? চোর কবরপড়া দিয়েছে। এই কারণেই সবাই মরা মানুষের মতো ঘুমিয়েছে!
খুব আগ্রহ নিয়ে আম্মার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি-
কবরপড়া কী?
আম্মা কোনো উত্তর দেয় না। আছিয়া ফুপু আম্মার পাশেই দাঁড়ানো ছিল। সে বলল-
নতুন কবরের ওপর থেকে ঝুরঝুরা মাটি কুফুরি কালাম পড়ে বাড়ির চারপাশে ছিটিয়ে দেয় চোরে। তখন কেউ কোনো কিছু টের পায় না। সবাই মরা মানুষের মতো ঘুম দেয়!
ভোরবেলা থেকেই বাড়িতে মাতম চলছে। আমরা যে ঘরে ঘুমিয়েছিলাম সেই পশ্চিমের ঘরের সিঁধ কেটে চোর আম্মার দামি শাড়ি, আব্বার বিদেশি ঘড়ি, হাতব্যাগ, আমাদের ঈদের জন্য কেনা নতুন জামা-প্যান্টসহ আরও যা-কিছু নেওয়ার সব নিয়ে গেছে। ঈদ করার জন্য আব্বা আমাদেরকে নেত্রকোনা থেকে বাড়ি নিয়ে এসেছে। কিন্তু ঈদের ঠিক দুই দিন আগে এ রকম ঘটনা ঘটবে কেউই তো ভাবেনি। সারা গ্রামের মানুষ ছুটে আসছে আমাদের বাড়িতে। কেউ দাদাকে, কেউ বড় চাচাকে, কেউ আব্বাকে সান্ত্ব্বনা দিচ্ছে। টিনের বেড়ার নিচে যে গর্তটা করা হয়েছে ঘরের ঢোকার জন্য সেটা দিয়ে আমি সকাল থেকে দুইবার হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকেছি আর বের হয়েছি। আমি অবাক হয়ে গেলাম- এ রকম ছোট গর্ত দিয়ে চোর ঢুকল কেমন করে! বড় চাচি আমাকে বলল-
ভালো চুর অইলে বুদ্ধি থাহন লাগে!
চুরিটা দুদাই করেছে- এই বিষয়ে বাড়ির সবাই একমত। আর এ রকম ভাবার যথেষ্ট কারণও আছে।
নেত্রকোনা থেকে ট্রেনে চেপে আব্বা আমাদেরকে নিয়ে ঠাকুরকোনা স্টেশনে নামলেন। তারপর সেখান থেকে রিকশা নিয়ে ট্রলারঘাটে পৌঁছলেন। বর্ষার মাঝামাঝি সময়, কংস নদের পানি উপচে পড়ছে দুই পাড়ে। নদীর ওপর বিশাল ইটের পিলারে ভর দিয়ে রেলের যে ব্রিজটা দাঁড়িয়ে আছে একা, দূর থেকে তাকালে মনে হয় এখনই বুঝি নদীর পানিতে তল হয়ে যাবে! এত পানি নদীতে এখন!
তিনটা ছোট-বড় সাইজের স্যুটকেস নিয়ে আমরা ট্রলারে উঠলাম। একটু পরেই ঘাট থেকে ট্রলার ছেড়ে যাবে। হঠাৎ খেয়াল করলাম, ট্রলার যখন ঘাট থেকে ছেড়ে যায়-যায়, ঠিক সেই সময় বয়স্কমতন এক লোক, মুখে আধপাকা লম্বা দাড়ি, পরনে সাদা পাঞ্জাবি, মাথায় গোলাকার টুপি, অনেকটা মাদ্রাসার হুজুরের মতো দেখতে, লাফিয়ে ট্রলারে উঠল। ট্রলারের ভেতরে এত ভিড় নেই, অনেকটাই ফাঁকা পড়ে আছে। আমি আম্মার কোলে হেলান দিয়ে আছি। ট্রলার ছাড়ার অল্প সময়ের ভেতর সেই লোকটার সাথে আব্বার বেশ আলাপ জমে গেল। লোকটা আম্মাকেও চেনে! তাদের দু'জনের সাথেই সে তুমি, তুমি করে কথা বলছে। কথার ফাঁকে সে আমার নামটাও জানতে চাইল। জিজ্ঞেস করল-
কোন্‌ ক্লাসে পড়ো?
আমি বললাম-
ক্লাস ফাইভে পড়ি। আব্বাকে বলল-
কি গো মাস্টার বেডা, ঈদ কই করবা? তুমরার বাড়িত নাকি শ্বশুরবাড়িত?
আব্বা মুচকি হেসে উত্তর দিল-
আমাদের বাড়িতেই করব।
তারপর লোকটা আমার দাদার শরীরের অবস্থা এখন কেমন, হাঁটাচলা করতে পারে কিনা- তা জানতে চাইল।
বিরক্তিকর ভটভট আওয়াজ তুলে উপচেপড়া বর্ষার পানি ঠেলে ট্রলার এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের বাড়ির পথে। মাঝপথে সাবাইন্যা নামের এক ঘাটে লোকটা আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নেমে গেল। যাওয়ার সময় আমার মাথায় হাত রেখে আব্বার দিকে তাকিয়ে বলল-
মাস্টার, তুমার বাপেরে আগামীকাইল দেখতে যাইয়াম। ম্যালাদিন তুমরার বাড়িঘরে যাই না। তুমার বাপের লাহান ভালা মানুষ এই এলাকায় নাই।
লোকটা নেমে যেতেই আম্মা ফিসফিস করে আব্বাকে বলল-
কে এই লোকটা?
দুদা মিয়া। এই সাবাইন্যা গ্রামেই তার বাড়ি।
কোন্‌ দুদা মিয়া? এই নামে তো এক চোর আছে। সেই নাকি?
হুম, সেই দুদা চোরা। চুরির পাশাপাশি ডাকাতিও করত। তবে এখন মনে হয় এইসব কাজ করে না। দেখছ না কেমন মাওলানার লেবাস ধরেছে!
এই লোক তো খুব ভয়ংকর। তার দুই ছেলেও নাকি চুরি-ডাকাতির পেশায় আছে!
তা আমিও শুনেছি। বাদ দাও তো। তাকে নিয়ে আমাদের চিন্তার কিছু নেই। বয়সের কারণে হয়তো চুরি-ডাকাতি ছেড়ে দিয়ে ভালো হয়ে গেছে।
আব্বার এই কথায় আম্মা হেসে বলল-
চোর তো চোরই! মরার আগে এরা কোনোদিন ভালো হয় না। সুযোগ পেলে ঠিকই দান মেরে দেবে!
দুই.
সকালে আমি বারবাড়ির উঠানে মার্বেল নিয়ে খেলছিলাম। সাথে আছে আমার দুই চাচাতো ভাই। খেলার ফাঁকে হঠাৎ পাশ ফিরে দেখি আমার কাছাকাছি দুদা চোরা দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে কিছুটা ভড়কে গেলাম। সে আমার হাত টেনে জিজ্ঞেস করল-
আবুনি, তুমার দাদা কই?
দাদা বাড়ির ভেতরে আছে।
এই ন্যাও বাতাসা। তুমার দাদার লাইগ্যা আনছি।
গুড়ের বাতাসা নাকি এগুলো?
হুম, খেজুরগুড়ের বাতাসা। তুমি পছন্দ করো?
গুড়ের বাতাসা আমার খুব প্রিয়।
আইচ্ছা, তাইলে তুমার দাদার সাথে তুমিও খাইয়ো। অহন আমারে বাড়ির ভিত্রে লইয়া যাও। তুমার দাদার সাথে দ্যাহা করবাম।
খেলা বন্ধ রেখে আমি দুদা চোরাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে এলাম। উঠানে সবাই দাদার সাথে কোরবানির বিষয়ে শলাপরামর্শ করছে। আব্বা, বড় চাচা, আছিয়া ফুপু, আম্মা, বড় চাচি- সবাই আছে সেই আলাপে। দুদাকে দেখেই আম্মা প্রায় দৌড়ে ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। হাতের ইশারায় আব্বাকে কাছে ডেকে নিল। আমিও আব্বার পায়ে-পায়ে ঘরের ভেতর চলে এলাম। হাতে গুড়ের বাতাসার ছোট পুঁটলি। আম্মা চোখেমুখে আতঙ্ক নিয়ে আব্বাকে বলল-
আমার কিন্তু খুব ভয় করছে! দুদা মনে হয় ঈদের আগে চুরির মতলব নিয়েই বাড়িতে এসেছে। গতকাল ট্রলারে আমাদের সাথে থাকা স্যুটকেসগুলো দেখেছে। আব্বা বিরক্ত হয়ে বলল-
তোমার যত ফালতু কথা! সে এসেছে বাজানকে দেখতে।
আম্মা বিড়বিড় করে বলল-
এটাই যদি একমাত্র কারণ হয় তাহলে তো ভালোই।
এদিকে দাদা আছিয়া ফুপুকে ডেকে বলল-
মেহমানরে নাশতা-পানি দ্যাও তাড়াতাড়ি।
কিছুক্ষণ পর আমি ঘরের ভেতর থেকে ট্রে সাজিয়ে খেজুরগুড় আর চিতই পিঠা এনে মেহমানের সামনে রাখলাম। দাদা আর সেই মেহমান- দু'জনেই নাশতা খেতে খেতে খোশগল্প করতে লাগল।
ঘণ্টাখানেক পর মেহমান মানে দুদা চোরা চলে যেতেই দাদা সবাইকে ডেকে সাবধান করে দিল। বলল-
ঘরের দামি জিনিস, ঈদের শাড়ি-কাপড় তুমরা ঠেমাইয়া রাহো। দুদা নিজেই যেহেতু বাড়ি পর্যন্ত আইছে, তাইলে একটা অঘটন সে ঘটাইবই! আজকাল চুরে যেমন ধর্মের কাহিনি শুনে তেমনি সুযোগ পাইলে চুরি-ডাকাতিও করে! চুরের কোনো ঈমান-আমল নাই।
ঈদের দুই দিন আগে বাড়িতে এতবড় চুরি হওয়াতে সবার মাঝে বেশ মন খারাপের ছায়া, সবাই মনমরা। আব্বা আটপাড়া থানায় গিয়ে দুদা চোরার বিরুদ্ধে মামলা করতে চাইছে। কিন্তু বড় চাচার আপত্তি আছে তাতে। চাচা বলল-
দুদা খুব খারাপ মানুষ। তারে থানা-পুলিশও ভয় পায়। এখন আমরা যদি তার বিরুদ্ধে মামলা করি তাহলে সে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আরেক দিন সিঁধ কেটে ঘরে ঢুকে ঘুমের ভেতর সবার গলা কেটে যাবে!
দাদাও চাচার কথায় মত দিল-
দরকার নাই। আল্লা যা করেন ভালার লাইগ্যাই করেন। খারাপের সাথে আজকাল ভালামানুষ কুলাইতে পারে না। মামলা-মোকদ্দমার দরকার নাই।
অনেক ভেবেচিন্তে শেষমেশ মামলা করার চিন্তা বাদ দেওয়া হলো। ঈদের খুশিতে এই চুরির ঘটনা কিছুটা চাপা পড়ে রইল সবার মনে। তবে আব্বার সোনালি রঙের বিদেশি হাতঘড়ি আর কুমিরের চামড়ার তৈরি হাতব্যাগটার জন্য আম্মার এবং আমার খুব মন খারাপ। যদিও এর সাথে আম্মার তিনটা দামি জামদানি শাড়ি দুদা নিয়ে গেছে।
তিন.
ঈদ শেষ হওয়ার পাঁচ দিন পর আমরা বাড়ি থেকে নেত্রকোনা ফিরে যাচ্ছি। লালচান্দের বাজারের ট্রলারঘাট থেকে আব্বা আমাদের নিয়ে ট্রলারে উঠল। এখান থেকে ঠাকুরকোনা যাব, তারপর দুপুরের মেইল ট্রেনে চড়ে নেত্রকোনা। ফিরতি পথেও আমাদের ট্রলার সাবাইন্যা ঘাটে এসে থামল। তিন-চারজন যাত্রী আছে ঘাটে। ভেতরে বসে ট্রলারের ছোট জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, একটা লোক হাতে একটি খয়েরি ব্যাগ নিয়ে ট্রলারে উঠল। তারপর সরাসরি ট্রলারের ভেতরে এসে এক কোনায় বসে পড়ল। লোকটার বাম হাতে সোনালি রঙের একটি সুন্দর ঘড়ি। সূর্যের আলো জানালা দিয়ে ঢুকে সেই ঘড়ির ওপর পড়ে ঝিলিক মারছে। আব্বা-আম্মা নানান বিষয়ে গল্প করছিল। আমি আম্মার উল্টোপিঠে হেলান দিয়ে লোকটার দিকে মুখ করে বসে আছি।
হঠাৎ আমার চোখ লোকটার চোখের সাথে আটকে গেল কিছু সময়ের জন্য। যদিও আমি শুরুতে লোকটার দিকে অত মনোযোগী ছিলাম না। কিন্তু এখন পলকেই চিনতে পেরেছি তাকে। আমি ঘুরে আম্মাকে ফিসফিস করে বললাম-
দ্যাখো, দ্যাখো, দুদা চোরা! আমার মৃদু আওয়াজে বলা কথাটাও যেন দুদা চোরা শুনতে পেল। সে মুহূর্তেই বসা থেকে ব্যাগটা নিয়ে উঠে পড়ল। তারপর ধমকের সুরে ট্রলারের চালকের সহকারীকে বলল-
অ্যাই ট্রলার থামা। বাড়িত ভুল কইরা টেহা থুইয়া আইছি। আমি পরের ট্রলারে যাইয়াম।
আম্মা একলাফে উঠে গিয়ে দুদা চোরার ডান হাতটা চেপে ধরল। তা দেখে অন্য যাত্রীরা খুব অবাক হয়ে গেল। আম্মা দুদার হাত ধরে রেখে চেঁচিয়ে বলছে-
এই ব্যাগ আপনি কোথায় পেলেন? এই ব্যাগ তো আমার! ঈদের ঠিক দুই দিন আগে আমাদের বাড়িতে চুরি হয়েছে। সেই চুরি যাওয়া জিনিসের ভেতর এই ব্যাগটা আর একটা হাতঘড়ি আছে।
দুদা আম্মাকে উল্টো ধমক লাগাল-
মানী মাইনষের ইজ্জতের উপ্রে বদনামের কালি দিতাছ! তুমার অত বড় আস্পর্দা!
কিন্তু আম্মা দারুণ সাহসী হয়ে গেছে। দুদার বাম হাতের কবজিতে ঘড়িটা ধরে বলল-
এই ঘড়িটাও আমাদের!
দুদা এইবার আর কোনো কথাই বলল না। তবে দু'চোখের তাকানি দিয়ে আম্মাকে যেন খুন করে ফেলবে- এ রকমভাবে সে তাকিয়ে আছে। ট্রলার নদীর বুক কেটে-কেটে ভটভট আওয়াজের বাদ্য বাজিয়ে ঠাকুরকোনার দিকে ছুটে যাচ্ছে। ভেতরে অন্য যাত্রীরা দুদা চোরাকে ঘিরে আছে। পাল্টাপাল্টি কথাবার্তা, বাগ্‌বিতণ্ডা চলছে। একজন যাত্রী সবার কথা থামিয়ে দিয়ে আব্বাকে বলল-
ভাইসাব, পুরা ঘটনাটা আমরা আফনের মুখ থাইক্যা শুনবার চাই। এই ব্যাগ আর ঘড়ি কি আসলেই আফনেরার?
আব্বা কিছুটা দম নিয়ে সবার জন্য বলল-
এই ব্যাগটার ভেতরে ডানদিকের কোনায় সাদা ছোট কাপড়ের টুকরায় লেখা আছে- মেইড ইন ইন্দোনেশিয়া। আমার এক বন্ধু কয়েক মাস আগে ইন্দোনেশিয়া থেকে ব্যাগটা এনেছে আমার জন্য। আর ক্যাসিও কোম্পানির এই ঘড়িটাও বাইরে থেকে আনা। আমার ছোট শ্যালক এক মাস আগে দুবাই থেকে এনেছে। এই ঘড়ির চেইনের নিচে দুইদিকে তিনটা স্টার দেওয়া আছে।
আব্বার এই কথা শুনে যাত্রীদের সবাই একসাথে বলে উঠল-
দেখি তো, এইলার কথার সাথে মিল আছে কিনা!
আম্মা দুদার হাত থেকে ব্যাগ আর ঘড়ি নিয়ে সবাইকে দেখতে বলল। সবাই দেখে নিশ্চিত হলো এবং আব্বার দিকে তাকিয়ে একবাক্যে বলল-
এই জিনিসের আসল মালিক দুদা না, আফনেরাই।
যদিও দুদা নিজেকে বাঁচানোর জন্য একেক সময় একেক কথা বলে যাচ্ছে। একবার বলছে, সে এগুলো অন্যজনের কাছ থেকে এক হাজার টাকায় কিনেছে। আরেকবার বলছে, তার বড় ছেলে নেত্রকোনা থেকে কিনে এনেছে এই ব্যাগ আর ঘড়ি।
আম্মা এইবার দুদাকে বলল-
আমার তিনটা জামদানি শাড়ি আপনার বাড়িতেই আছে। কেননা আমাদের বাড়িতে চুরিটা আপনিই করেছেন। সারা এলাকার মানুষ আপনাকে এক নামে চেনে- দুদা চোরা! চুরি করার এক দিন আগেও আপনি আমাদের বাড়িতে গেছেন গুড়ের বাতাসা নিয়ে। আমার শ্বশুরের সাথে উঠানে বসে কাঁঠাল আর চিতই পিঠা খেয়েছেন। কী, খান নাই? চুপ করে আছেন কেন? কথা বলেন।
দুদা কোনো কথা বলে না। পাথরের মতো নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আম্মার কথা শেষ হয় না। শাড়ির আঁচলে মুখ মুছে নিয়ে বলল-
সেদিন আপনি আমাদের বাড়িতে গেছিলেন খোঁজ নিতে কীভাবে চুরিটা করলে আপনার সুবিধা হয়, তাই-না? অথচ আপনার চেহারা আর লেবাস দেখলে মনে হয় আপনি হয়তো মাওলানা।
দুদার সারা শরীর ঘামছে। সে খুব অসহায় হয়ে গেছে হাতেনাতে এভাবে চুরির মালামালসহ ধরা পড়ার কারণে। তবু সে রাগে-অপমানে ফোঁসফোঁস করছে ঢোঁড়াসাপের মতো। আম্মার দিকে তাকিয়ে বলল-
তুমরা আমারে গেরামের দশজনের সামনে বেইজ্জতি করলা। কামডা ভালা করো নাই। এর ফল পাইবা কয়েক দিনের ভিত্রে। দরকার পড়লে আমি মার্ডার করবাম এই অপমানের বদলা লওনের লাইগ্যা!
আম্মা দুদার দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলল-
বুইড়া চোরের কত বড় গলা! ঠাকুরকোনা নেমে আমি আপনাকে পুলিশের হাতে দেব। ট্রলারের সবাই সাক্ষী, আপনার কাছে আমার বাড়ির চুরি যাওয়া মাল পাওয়া গেছে। আপনার লজ্জা-শরম নাই? এই বয়সেও আগের মতো চুরি-ডাকাতি করেন এখনও।
ঠাকুরকোনা এসে একে একে সব যাত্রী ট্রলার থেকে নেমে পড়ল। তবে দুইজন যাত্রী দুদাকে দু'পাশ থেকে ধরে রেখেছে। একজন আব্বাকে বলল-
ভাইসাব, চলেন এই চুরের সর্দাররে পুলিশের কাছে দিয়া দেই। এর নাম আমরাও বাপ-চাচার মুখে শুনছি। কিন্তু আইজ নিজের চউক্ষে দেখলাম। চেহারা দেইখ্যা বুঝা যায় না এই বুইড়া যে অত বড় চুর!
আব্বা নরম মনের মানুষ। দুদার অসহায় মুখ দেখে তার খুব মায়া হলো। আব্বা বলল-
থাক, থানা-পুলিশ করব না। তবে তার নামে থানায় একটা জিডি করে রাখব- যাতে ভবিষ্যতে আমাদের বাড়িতে কারও কোনো ক্ষতি বা চুরি হলে তাকে ধরা যায়। আম্মা হাতের ইশারায় আব্বাকে থামিয়ে বলল-
এক শর্তে তাকে ছাড়ব। সে দুই কান ধরে এই চুরির জন্য সবার সামনে ক্ষমা চাক এখন! চুরি যাওয়া দুইটা জিনিস কেবল ফেরত পেয়েছি। কিন্তু আমার শখের শাড়িগুলো তো আর ফেরত পাব না।
যে দুইজন দুদাকে ধরে রেখেছিল তারা আম্মার প্রস্তাবে সম্মতি দিল-
হ্যাঁ আফা, একদম ঠিক কথা কইছুইন। দুই হাতে কান ধইরা মুখে স্বীকার করতে অইব এই বুইড়ার।
উপায় না দেখে কান ধরে দুদা বিড়বিড় করে করে বলল-
জি, কথা সত্য। চুরি আমিই করেছি। সাথে আছিল আমার বড় পোলা। শাড়ি তিনডা আমি নগদ ট্যাহায় বেইচ্যা দিছি। ঘড়ি আর ব্যাগডা রাখছিলাম নিজের ব্যবহারের লাইগ্যা। আইজ আমি রওনা দিছিলাম আমার বেয়াইর বাড়িত যাওনের লাইগ্যা। কিন্তু আল্লার ইশারায় আমার শাস্তি এইভাবে চলতি পথে পাইলাম।
হঠাৎ দুদা আমার মাথায় হাত রেখে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল- এই আবুডা আমার নাতির লাহান। আমি এর মাথা ছুঁইয়া ওয়াদা করতাছি, আইজ থাইক্যা আর কুনুদিন আমি চুরি-ডাকাতি করতাম না। আমার দুই পোলারেও এই পাপের পথ থাইক্যা ফিরাইয়া আনবাম। যা পাপ করনের করছি। অহন এই পাপের প্রাশ্চিত করতাম চাই!
আমাদের ট্রেনের সময় হয়ে গেছে। রিকশা নিয়ে ট্রলারঘাট থেকে দ্রুত স্টেশনে চলে এলাম। আব্বা দুদাকে পুলিশে না দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। ট্রেনের ভেতর সারাটা পথ আমার কেবল দুদার কথা মনে পড়ছিল। তার কান্নাভেজা অপমানিত মুখ আমার চোখের সামনে ট্রেনের দুলুনির মতো করে দুলছিল। আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম-
চোর কি কখনও ভালো হয় না?
আম্মা আমার দিকে কিছুটা সময় তাকিয়ে থেকে বলল-
তোর মনে হয় দুদা চোরার জন্য খারাপ লাগছে, তাইনা? খারাপ লাগার কিছু নেই। চোর চোরই, চোর কখনও ভালো হয় না! এরা ধরা পড়ার পর মাইরের হাত থেকে বাঁচার জন্য ভালো হয়ে যাওয়ার ভান করে।
আমি মনে মনে বললাম-
কী জানি, হয়তো আম্মার কথাই ঠিক!
চার.
বিশ-বাইশ দিন পর দাদা আমাদের নেত্রকোনার বাসায় বেড়াতে এল গ্রামের বাড়ি থেকে। রাতের খাবারের পর দাদা আমাদের সবাইকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসল। তারপর তার ব্যাগ থেকে একটা বড় প্যাকেট বের করে আম্মার হাতে দিয়ে বলল-
বউমা, এইডা খুইল্যা দ্যাহো। আম্মা খুব আগ্রহ নিয়ে প্যাকেটটা খুলল। তিনটা জামদানি শাড়ি দলামোচড়া করে ভাঁজ করা আছে প্যাকেটের ভেতর। আম্মা যেন খুশিতে পাগল হয়ে যাবে! জোরে জোরে বলতে লাগল-
আরে, এগুলো তো আমার চুরি-যাওয়া সেই শাড়ি!
দাদা বলল-
হ্যাঁ, তুমার চুরি-করা শাড়ি দুদা কয়েক দিন আগে আমার কাছে ফিরত দিয়া গ্যাছে। আমার হাতেপায়ে ধইরা মাফও চাইছে। কানতে কানতে কইছে, আর কুনুদিন চুরি করতাম না ভাই। বয়স অইছে, ঠাস কইরা এক দিন মইরা যাইয়াম। আফনের বাড়িত চুরির পর থাইক্যা আমার উপ্রে আল্লার গজব নাজিল অইছে! কয়েক দিন আগে আমার বড় নাতিডা পুস্কনিত ডুইব্যা মরছে!
আমরা অবাক হয়ে দাদার কথা শুনছি। দাদা বলতে লাগল-
অহন দুদার মনে অইছে, তার ম্যালাদিনের পাপের কারণেই আদরের নাতিডা এইবায় মরছে। তার অন্তরে এই ঘটনায় বিরাট পরিবর্তন আইছে। সে মসজিদে গিয়া ইমাম সাহেবের কাছে তওবা করছে। সে অহন ভালা মানুষ অইয়া গেছে। এই কারণেই চুরি-করা শাড়ি ফিরত দিয়া গ্যাছে। দাদার মুখে এই ঘটনা শুনে সবারই মন খুব ভার হয়ে গেল। আমি আম্মার দিকে তাকিয়ে বললাম-
দুদা আগে চোর ছিল। এখন কিন্তু সে আর চোর না। আম্মা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল-
হুম, একটা সময়ের পর সব অপরাধীই নিজের ভুল বুঝতে পারে, সেটা যেভাবেই হোক। দুদাও তা বুঝতে পেরেছে। তাছাড়া কেউ যদি দিনের পর দিন ভালো কাজ করে, তার কিন্তু কখনও ক্লান্তি আসে না। কিন্তু যে সব সময় খারাপ কাজের সাথে জড়িত থাকে, একটা সময়ে এই খারাপ কাজের জন্য ক্লান্তি, বিতৃষ্ণা চলে আসে তার দেহমনে। সে তখন খারাপ কাজ ছেড়ে ভালো পথে আসতে চায়।
আব্বা আজ বেঁচে নেই, আম্মাও বয়সের ভারে খুব একটা চলাফেরা করতে পারে না। অনেক বছর হলো দাদা মারা গেছে। নেত্রকোনা থেকে কয়েক দিনের জন্য গ্রামের বাড়ি এসেছি আম্মাকে সাথে করে। মনের আনন্দে হারিয়ে যাওয়া শৈশবের সেই পথগুলো দিয়ে একা একা ইচ্ছেমতো হেঁটেছি। সেদিন এমনি করে স্মৃতিমাখা পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সড়কের শেষমাথায় সেই সাবাইন্যার ঘাট পর্যন্ত এসে থেমেছি। এখন আর সেই ট্রলারঘাট নেই, দুদাও বেঁচে নেই। কিন্তু দুদার কথা মনে পড়ে গেল। সেই সাথে আমার শৈশবে আমাদের বাড়িতে তার চুরি করার ঘটনাটাও চোখের সামনে ভেসে এলো!