
জন্মদিন ও স্মৃতিকাতর সময়
সকাল থেকেই মুষলধারে বৃষ্টি। বৃষ্টির এমন অঝোর ধারাপাতে মনে হয়, আষাঢ় বুঝি আজকেই নিজেকে উজাড় করে সব ঢেলে দেবে! এমনিতে বর্ষাকাল আমার খুব প্রিয়। বৃষ্টি আরও! হয়তো এই আষাঢ়েই জন্মেছিলাম বলে...
যখন এসেছিলাম তখনও কি খুব বৃষ্টি হয়েছিল; গর্ভধারণকালে সেই ব্যথামোচনের দিনটি কেমন ছিল- জানতে চাইলে মা কিছুতেই মনে করতে পারে না। স্মৃতি হাতড়ে হয়তো কিছু মনে করতে গিয়েও অপরাধীর মতো হঠাৎ হেসে ফেলে। আমিও মা'কে ঘাঁটাই না। শুধু মনে মনে ভেবে নিই, হ্যাঁ, সেদিন অনেক বৃষ্টি ছিল! বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই। মামাবাড়িতে গোয়ালঘরের পাশেই বাংলাঘর। এর কোনো ঘরে পৃথিবীতে মাত্র জন্ম নেওয়া আমি তারস্বরে হয়তো কেঁদে উঠি! বাইরে সন্ধ্যার গায়ে গায়ে ঝুপঝুপে বৃষ্টির ছাঁট ভাসায় গ্রামকে, উঠানে থৈ থৈ পানি। এমন কাদা-পানিতে লেপ্টে একাকার হয়ে বাড়ির সবাই সদ্য নবজাতককে দেখতে ছুটে যায়...
এসব ভাবতে ভাবতে খোলা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে দেখি, বৃষ্টি আরও বাড়ছে। আমার বৃষ্টিপ্রবণ মন বৃষ্টির দিকে আরও ঝুঁকে থাকে। হাত বাড়াই বড় বড় দানাদার বৃষ্টির ফোঁটায়! কী চাই আমি, কী চাই না? পৃথিবী এমনিতে এমন নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে, প্রবল বৃষ্টির তোড় এই কঠিন পরিস্থিতিতে একটি সমাপ্তিরেখা তো টেনে দিতেই পারে। আমি তাই চোখ বুজে বৃষ্টির কাছে নতমুখে ধ্যানস্থ হই...বৃষ্টি আরও পড়ো, ইস্পাতের মতো আরও প্রবল হও, কঠিন হও, কেটে কেটে যাও, যা পাও জীবাণু, জীবাশ্মকণা, অতি মারণাস্ত্র- সমস্ত কিছু ধ্বংস করো তোমার তরল গরলে...
জীবন ক্রমশ জটিল হয়ে যাচ্ছে...জীবন বৃষ্টির মতো ধুন্ধুমার পড়ে না, যখন ঘনিয়ে আসে সৃষ্টির তাল-লয় সবকিছুরই একে একে ছন্দপতন হয়। জীবন নতুন কিছু গড়ে দেয়, আবার কেড়েও নেয় সর্বস্ব! জীবনকে তাই ভয় পাই। প্রার্থনা করি, হে জীবন, ঠিক আছে ভরপুর বৃষ্টি দাও, গর্ভধারিণীকে একটু স্বস্তিও দিও! আমার তো পৃথিবীতে এটুকুই সম্বল...
আয় বৃষ্টি ঝেঁপে...
বাতাসের ঘূর্ণি আর বৃষ্টির দাপটে দোতলার খোলা বারান্দাটা কেমন মুহুর্মুহু দুলে ওঠে। এই দুলুনিতে নিজেকে কোনোমতে সামলে নিয়ে সবচেয়ে ছোট আমি তড়বড়িয়ে 'আয় বৃষ্টি ঝেঁপে, ধান দেবো মেপে' বলতে বলতে বড় দু'জনের মতোই বারান্দার বাইরে হাত বাড়িয়ে দিই- যদি বৃষ্টির দুই-এক ফোঁটা হাতের পাতায় এসে পড়ে! বৃষ্টির সোঁদা গন্ধ নাকে নিতে দারুণ লাগে, মুখে-গলায় লাগালে আশ্চর্য ঠান্ডা-শীতলভাব অনুভব হয়। বড়, মেজো তখন আমার পাগল পাগল অবস্থা দেখে দাঁত বের করে 'হি হি' হাসে। ওদের দেখাদেখি আমিও রেলিংয়ের বাইরে হাত ও শরীর দুটোই শূন্যের দিকে বাড়িয়ে দিই। বড়জন ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি ধাক্কা দিয়ে আমাকে বারান্দার মেঝেতে ফেলে দেয়। ততক্ষণে আরও শনশনানো, মটমটিয়ে বয়ে যাওয়া ঝোড়ো বাতাসের কাঁপুনিতে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে। ডানে-বাঁয়ে, সোজা-বেঁকে যাওয়া বৃষ্টির সুঁচালো ছাঁটেরা বারান্দার দিকে ধেয়ে আসে। ভিজিয়ে দেয় নিমেষেই। এই ঝুমবৃষ্টিতে হাসতে হাসতে আমরা তিনজনই মেঝেতে গড়াগড়ি খাই। বৃষ্টি একটু কমলে নিচে অবাক হয়ে দেখি- কোনটি রাস্তা, কোনটি ডোবা তা আর বোঝার উপায় নেই! ঝড় থেকে বাঁচতে তাড়াহুড়োয় একটি রিকশা আসতে গিয়ে যাত্রীসহ ডোবায় পড়ে যায়, ওদিকে আরেকটি কিশোর ছেলে সাঁকোর ওপর থেকে ডোবায় লাফ দিতে গিয়ে কংক্রিটের রাস্তায় ব্যথা পেয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, এমনকি একটি পথকুকুরও বুকসমান রাস্তার পানি থেকে বৃষ্টির স্রোতে ডোবায় ভেসে যায়।
দোতলার ওপর থেকে এসব দৃশ্য দেখে বড়, মেজো দাঁত বের করে 'হি হি' হাসে, মজা পেয়ে আনন্দে হাততালি দেয়। আর অসহায় কুকুর, যাত্রিসমেত রিকশা কিংবা সেই কিশোর ছেলেটির জন্যে আমার শিশুমন কেমন হু-হু করে ওঠে! শেষে নিজেকে শান্ত রাখতে কাগজ কেটে নৌকা বানাই, সেই কাগজের নৌকা ওপর থেকে পানিতে ছুঁড়ে দিই। কতগুলো ডুবে যায়, কতগুলো কাত হয়ে থাকে, ছড়িয়ে থাকা সাদা ফুলের মতো কয়েকটি আবার পানির ওপর তড়তড়িয়ে ভেসে যায়। সেই অভূতপূর্ব দৃশ্য আমি খাতায় আঁকতে থাকি...
একসময় আকাশের বজ্রহুংকার থামে, ঝড় বন্ধ হয়, ভূমণ্ডলে বৃষ্টি কমে আসে। রাস্তার পানিও ধীরে ধীরে ডোবার দিকে নেমে যেতে থাকে। ভরা বর্ষার ছবি আঁকতে আঁকতে দোতলার বারান্দা থেকে হঠাৎ খেয়াল করি, রাস্তায় জমে থাকা গোড়ালি সমান পানিতে কালো মতো কয়েকটি কী যেন খলবলিয়ে, মহা আনন্দে উঁচুতে উঠে আসছে। খাতা, পেন্সিল সব রেখে 'মাছ, মাছ' বলে চিৎকার দিয়ে আমি এক ছুটে রেলিংয়ের কাছে চলে যাই। রেলিংয়ের ওপর থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি, সত্যিই ইতস্তত কিছু মাছ ডোবা থেকে রাস্তায় উঠে আসছে! বড়-ও এগিয়ে এসে মুখ বাড়িয়ে এ দৃশ্য দেখে, এরপর রান্নাঘর থেকে বড় গামলা নিয়ে সদর দরোজা খুলে বেরিয়ে যায়। নিচে গিয়ে রাস্তার পানিতে উঁবু হয়ে কায়দামতো কপাৎ করে একটি মাছ ধরে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলে, 'এগুলো কই মাছ'! নিচ থেকে বড়'র কিশোর গলার চেঁচানি শুনে কিনা জানি না, মা-ও হাতের কাজ ফেলে তড়িঘড়ি বারান্দায় এসে হাজির। ওপর থেকে হাত ইশারায় বড়কে বাসায় ফিরে আসতে বলে। ততোক্ষণে সে রাস্তার অগভীর পানি থেকে মাছ তুলে গামলায় রাখতে শুরু করে। কিন্তু গামলায় নিতে না নিতেই মাছগুলো আবার ততধিক হাস্যকরভাবে লাফ দিয়ে দিজ্ঞ্বিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এদিকে আকাশে আবারও আঁধার-কালো মেঘ জমতে থাকে। ছড়িয়ে পড়ে বজ্রবিদ্যুতের স্ম্ফুলিঙ্গ। শুরু হয় ইলশেগুঁড়ি ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। বড়'র দেখাদেখি এই বৃষ্টিতেও আশপাশের ছেলেপেলেরা মাছ ধরতে রাস্তায় নামে। বৃষ্টির তীব্রতা আরও বাড়লে আমরা ওকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে আসতে বলি। এমন ধারালো বৃষ্টি আর ছেলেপিলেদের আনন্দোল্লাসে ভয় পেয়েই হয়তো মাছগুলো দিজ্ঞ্বিদিকে হারিয়ে যায়। বড় তবুও কোনোমতে কাপড়ের পুঁটুলিতে জড়িয়ে বড় বড় দুটো কই মাছ নিয়ে আসে। কিন্তু ওর হাতের গামলাটি একেবারে রিক্ত-শূন্য।
বৃষ্টিদিনে, মরণের হাতছানি
আমাদের বাড়ির খোলা জায়গার ওপাশে আল্পনাদি, কাঞ্চনদাদের একতলা বাড়ি। তাদের বাড়ির ওপাশে দিগন্ত বিস্তৃত খোলা জায়গা। এই মাঠের পাশে যে কমিউনিটি সেন্টার আর মুগদাপাড়ার কাঁচা প্রশস্ত রাস্তা- সেটি আমাদের দোতলার বারান্দা থেকেও দেখা যায়। শুকনো সময়ে যেখানে ধানের চাষ করা হয়, বর্ষা মৌসুমে সেটিই আবার বৃষ্টির পানিতে টইটম্বুর প্রকাণ্ড এক বিল হয়ে যায়! দুরন্ত ছেলেপেলেরা রাস্তার ঘেষোজমিতে কোনোমতে প্যান্টটা খুলে রেখে অবাধে সেখানে সাঁতরে বেড়ায়। একদিন মায়াকানন মসজিদ থেকে ক্ষণে ক্ষণে মাইকিং হলো- তুষার আর ননীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! স্কুল ছুটির পর থেকেই নাকি এরা দু'জন হাওয়া। সেদিনও আকাশ খুব মেঘলা ছিল। টানা কয়েকদিনের বিরতিহীন ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে আশপাশের ডোবা-বিলের পানিও রাস্তায় উঠে আসে। সন্ধ্যার আগে আগে সমস্ত ঝড়-বৃষ্টিকে ছাপিয়ে বিলের পূর্বদিকে, আহমেদবাগের ঘাটে একসঙ্গে অনেকের চিৎকার শুনতে পাওয়া যায়। আমরা তাড়াতাড়ি ছাতা নিয়ে ছাদে উঠি। তুষার আর ননীর নিথর দেহটা কারেন্ট জালে আটকে ছিল! আহা, স্কুল ছুটির পর নিশ্চয়ই বৃষ্টির পানিতে ভিজে বিলের মধ্যে সাঁতার কাটতে গিয়েছিল... এরপর থেকে সন্ধ্যায় বা রাতে সামনের বিলের দিকে তাকালে কেমন ভয় ভয় করে! শুধু তুষার আর ননীই নয়, এরকম ভরা বৃষ্টির দিনে সাঁতার কাটতে গিয়ে ডুবে যায় আরও কিছু শিশু-কিশোর। প্রায় এক-দুই সপ্তাহ পরপরই মসজিদে-মসজিদে ছেলে হারানোর মাইকিং শোনা যায়। এগুলো শুনে শুনে আমার শিশুমনের অস্থির চিন্তাগুলো এমন ছিল, এই ঝিরঝিরে বৃষ্টিদিনগুলো ছেলেগুলোকে বোবায় পাওয়ার মতো বিলের কাছে টেনে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিত না তো!
চা বাগানে পাথুরে বৃষ্টি
শুধু বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান ছাড়া অরুর সাথে আমার প্রায় কিছুই মেলে না! অরু আমার মতো গোবেচারা সিঙ্গেল ব্যাচেলর নয়। ওর স্টেডি বয়ফ্রেন্ড আছে, একসাথে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ায়, অফিসশেষে ক্যান্ডল নাইট ডিনার করে, বৃহস্পতিবারে নাইট ক্লাবেও ঢুঁ দেয়। এদিকে আমার জীবন মানেই আমার পরিবার- মা, ভাই-বোন, পোষা পাখি আর ছোট্ট ছাদবাগান! অরু একদিন সেখানেও নাক গলায়, "তোর লাইফটা এভাবে একেবারে হেল হয়ে যাচ্ছে রে! চল, চল পালাই...সোজা চা বাগানে চলে যাই!" আমি চোখ কপালে তুলে বলি, "তোর বয়ফ্রেন্ড?" অরু তাচ্ছিল্যের সাথে বলে, "ও দেশে নেই। তাছাড়া আমরা কিছুদিন সেপারেশনে আছি।" আমার আর কিছু বলার নেই, আমি বাক্যহারা। এরকম বয়ফ্রেন্ডের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ হলে মা মনে হয় হার্টফেল করত!
দু-একটি জামাকাপড় ট্রলিতে ভরেছি কি ভরিনি, অরু সেগুলো আবার আলমারিতে ছুঁড়ে দিয়ে বলে, 'বাইরে তাকিয়ে দ্যাখ, কীরকম ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছে...আর তুই কীসব সালোয়ার-কামিজ নিচ্ছিস! জ্যাকেট, স্কার্ট এসব নে।'
অগত্যা কী আর করা। ব্যাগপত্র নিয়ে ওর ঝকঝকে টয়োটা প্রিয়ারস্ে উঠে বসি। অন্যসময়ে ধানীলঙ্কার মতো ফস্ করে রেগে গেলেও অরু একদম মাথা ঠান্ডা রেখে গাড়ি চালায়, নতুন নতুন রাস্তার ওপর গাড়ি উঠিয়ে দেয়।
আজকের সকালের হাইওয়ে একেবারে সুনসান, ফাঁকা। ঢাকা ছেড়ে হাইওয়েতে উঠেও হালকা ঝিরঝিরে বৃষ্টি পেয়েছি আমরা। বৃষ্টিতে দু'পাশের সবুজ ধুয়ে-মুছে আরও সবুজ, নতুন পাতার মতো জেগে উঠেছে। যদিও আকাশ ঢেকে আছে কাঠ কয়লার ঘনকালো মেঘে। এরই ফাঁকে ফাঁকে টং দোকানে চলতে থাকে আমাদের চা-শিঙাড়া-সমুচা বিরতি।
গাড়ি যখন শ্রীমঙ্গল পেরিয়ে মৌলভীবাজারের দিকে ঢোকে তখুনি বদলে যায় বৃষ্টির স্বরূপ। এতো বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা আমরা দু'জনের কেউ কখনও দেখিনি। যেন আকাশ থেকে কেউ আমাদের নিশানা করে পাথর ছুড়ছে! অরুকে তাড়াতাড়ি কোনো বড় গাছের নিচে কিংবা রিসোর্টে থামতে অনুরোধ করি। অথচ সামনে কোনো রিসোর্ট বা আশ্রয়দায়ী গাছ না থাকায় এই দুর্যোগেও বেচারি গাড়ি চালিয়ে যেতে থাকে। আমাদের জন্যে আরও বড় বিপদ অপেক্ষা করছিল। এতক্ষণ তাও আমরা কিছুটা হলেও বাইরের দৃশ্য দেখতে পাচ্ছিলাম! লাউয়াছড়ার কাছে এসে রাস্তা এমনভাবে ভারি বৃষ্টিতে ঢাকা ছিল, যেন ওপাশে কালো পর্দা টাঙানো হয়েছে...
এ পথে আর গাড়ি নিয়ে এগোনো প্রায় অসম্ভব! কাজেই এই প্রচণ্ড বৃষ্টিঝড় পেছনে ফেলে অরু আবার ঢাকার পথে গাড়ি ঘুরিয়ে দেয়...
সকাল থেকেই মুষলধারে বৃষ্টি। বৃষ্টির এমন অঝোর ধারাপাতে মনে হয়, আষাঢ় বুঝি আজকেই নিজেকে উজাড় করে সব ঢেলে দেবে! এমনিতে বর্ষাকাল আমার খুব প্রিয়। বৃষ্টি আরও! হয়তো এই আষাঢ়েই জন্মেছিলাম বলে...
যখন এসেছিলাম তখনও কি খুব বৃষ্টি হয়েছিল; গর্ভধারণকালে সেই ব্যথামোচনের দিনটি কেমন ছিল- জানতে চাইলে মা কিছুতেই মনে করতে পারে না। স্মৃতি হাতড়ে হয়তো কিছু মনে করতে গিয়েও অপরাধীর মতো হঠাৎ হেসে ফেলে। আমিও মা'কে ঘাঁটাই না। শুধু মনে মনে ভেবে নিই, হ্যাঁ, সেদিন অনেক বৃষ্টি ছিল! বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই। মামাবাড়িতে গোয়ালঘরের পাশেই বাংলাঘর। এর কোনো ঘরে পৃথিবীতে মাত্র জন্ম নেওয়া আমি তারস্বরে হয়তো কেঁদে উঠি! বাইরে সন্ধ্যার গায়ে গায়ে ঝুপঝুপে বৃষ্টির ছাঁট ভাসায় গ্রামকে, উঠানে থৈ থৈ পানি। এমন কাদা-পানিতে লেপ্টে একাকার হয়ে বাড়ির সবাই সদ্য নবজাতককে দেখতে ছুটে যায়...
এসব ভাবতে ভাবতে খোলা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে দেখি, বৃষ্টি আরও বাড়ছে। আমার বৃষ্টিপ্রবণ মন বৃষ্টির দিকে আরও ঝুঁকে থাকে। হাত বাড়াই বড় বড় দানাদার বৃষ্টির ফোঁটায়! কী চাই আমি, কী চাই না? পৃথিবী এমনিতে এমন নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে, প্রবল বৃষ্টির তোড় এই কঠিন পরিস্থিতিতে একটি সমাপ্তিরেখা তো টেনে দিতেই পারে। আমি তাই চোখ বুজে বৃষ্টির কাছে নতমুখে ধ্যানস্থ হই...বৃষ্টি আরও পড়ো, ইস্পাতের মতো আরও প্রবল হও, কঠিন হও, কেটে কেটে যাও, যা পাও জীবাণু, জীবাশ্মকণা, অতি মারণাস্ত্র- সমস্ত কিছু ধ্বংস করো তোমার তরল গরলে...
জীবন ক্রমশ জটিল হয়ে যাচ্ছে...জীবন বৃষ্টির মতো ধুন্ধুমার পড়ে না, যখন ঘনিয়ে আসে সৃষ্টির তাল-লয় সবকিছুরই একে একে ছন্দপতন হয়। জীবন নতুন কিছু গড়ে দেয়, আবার কেড়েও নেয় সর্বস্ব! জীবনকে তাই ভয় পাই। প্রার্থনা করি, হে জীবন, ঠিক আছে ভরপুর বৃষ্টি দাও, গর্ভধারিণীকে একটু স্বস্তিও দিও! আমার তো পৃথিবীতে এটুকুই সম্বল...
আয় বৃষ্টি ঝেঁপে...
বাতাসের ঘূর্ণি আর বৃষ্টির দাপটে দোতলার খোলা বারান্দাটা কেমন মুহুর্মুহু দুলে ওঠে। এই দুলুনিতে নিজেকে কোনোমতে সামলে নিয়ে সবচেয়ে ছোট আমি তড়বড়িয়ে 'আয় বৃষ্টি ঝেঁপে, ধান দেবো মেপে' বলতে বলতে বড় দু'জনের মতোই বারান্দার বাইরে হাত বাড়িয়ে দিই- যদি বৃষ্টির দুই-এক ফোঁটা হাতের পাতায় এসে পড়ে! বৃষ্টির সোঁদা গন্ধ নাকে নিতে দারুণ লাগে, মুখে-গলায় লাগালে আশ্চর্য ঠান্ডা-শীতলভাব অনুভব হয়। বড়, মেজো তখন আমার পাগল পাগল অবস্থা দেখে দাঁত বের করে 'হি হি' হাসে। ওদের দেখাদেখি আমিও রেলিংয়ের বাইরে হাত ও শরীর দুটোই শূন্যের দিকে বাড়িয়ে দিই। বড়জন ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি ধাক্কা দিয়ে আমাকে বারান্দার মেঝেতে ফেলে দেয়। ততক্ষণে আরও শনশনানো, মটমটিয়ে বয়ে যাওয়া ঝোড়ো বাতাসের কাঁপুনিতে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে। ডানে-বাঁয়ে, সোজা-বেঁকে যাওয়া বৃষ্টির সুঁচালো ছাঁটেরা বারান্দার দিকে ধেয়ে আসে। ভিজিয়ে দেয় নিমেষেই। এই ঝুমবৃষ্টিতে হাসতে হাসতে আমরা তিনজনই মেঝেতে গড়াগড়ি খাই। বৃষ্টি একটু কমলে নিচে অবাক হয়ে দেখি- কোনটি রাস্তা, কোনটি ডোবা তা আর বোঝার উপায় নেই! ঝড় থেকে বাঁচতে তাড়াহুড়োয় একটি রিকশা আসতে গিয়ে যাত্রীসহ ডোবায় পড়ে যায়, ওদিকে আরেকটি কিশোর ছেলে সাঁকোর ওপর থেকে ডোবায় লাফ দিতে গিয়ে কংক্রিটের রাস্তায় ব্যথা পেয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, এমনকি একটি পথকুকুরও বুকসমান রাস্তার পানি থেকে বৃষ্টির স্রোতে ডোবায় ভেসে যায়।
দোতলার ওপর থেকে এসব দৃশ্য দেখে বড়, মেজো দাঁত বের করে 'হি হি' হাসে, মজা পেয়ে আনন্দে হাততালি দেয়। আর অসহায় কুকুর, যাত্রিসমেত রিকশা কিংবা সেই কিশোর ছেলেটির জন্যে আমার শিশুমন কেমন হু-হু করে ওঠে! শেষে নিজেকে শান্ত রাখতে কাগজ কেটে নৌকা বানাই, সেই কাগজের নৌকা ওপর থেকে পানিতে ছুঁড়ে দিই। কতগুলো ডুবে যায়, কতগুলো কাত হয়ে থাকে, ছড়িয়ে থাকা সাদা ফুলের মতো কয়েকটি আবার পানির ওপর তড়তড়িয়ে ভেসে যায়। সেই অভূতপূর্ব দৃশ্য আমি খাতায় আঁকতে থাকি...
একসময় আকাশের বজ্রহুংকার থামে, ঝড় বন্ধ হয়, ভূমণ্ডলে বৃষ্টি কমে আসে। রাস্তার পানিও ধীরে ধীরে ডোবার দিকে নেমে যেতে থাকে। ভরা বর্ষার ছবি আঁকতে আঁকতে দোতলার বারান্দা থেকে হঠাৎ খেয়াল করি, রাস্তায় জমে থাকা গোড়ালি সমান পানিতে কালো মতো কয়েকটি কী যেন খলবলিয়ে, মহা আনন্দে উঁচুতে উঠে আসছে। খাতা, পেন্সিল সব রেখে 'মাছ, মাছ' বলে চিৎকার দিয়ে আমি এক ছুটে রেলিংয়ের কাছে চলে যাই। রেলিংয়ের ওপর থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি, সত্যিই ইতস্তত কিছু মাছ ডোবা থেকে রাস্তায় উঠে আসছে! বড়-ও এগিয়ে এসে মুখ বাড়িয়ে এ দৃশ্য দেখে, এরপর রান্নাঘর থেকে বড় গামলা নিয়ে সদর দরোজা খুলে বেরিয়ে যায়। নিচে গিয়ে রাস্তার পানিতে উঁবু হয়ে কায়দামতো কপাৎ করে একটি মাছ ধরে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলে, 'এগুলো কই মাছ'! নিচ থেকে বড়'র কিশোর গলার চেঁচানি শুনে কিনা জানি না, মা-ও হাতের কাজ ফেলে তড়িঘড়ি বারান্দায় এসে হাজির। ওপর থেকে হাত ইশারায় বড়কে বাসায় ফিরে আসতে বলে। ততোক্ষণে সে রাস্তার অগভীর পানি থেকে মাছ তুলে গামলায় রাখতে শুরু করে। কিন্তু গামলায় নিতে না নিতেই মাছগুলো আবার ততধিক হাস্যকরভাবে লাফ দিয়ে দিজ্ঞ্বিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এদিকে আকাশে আবারও আঁধার-কালো মেঘ জমতে থাকে। ছড়িয়ে পড়ে বজ্রবিদ্যুতের স্ম্ফুলিঙ্গ। শুরু হয় ইলশেগুঁড়ি ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। বড়'র দেখাদেখি এই বৃষ্টিতেও আশপাশের ছেলেপেলেরা মাছ ধরতে রাস্তায় নামে। বৃষ্টির তীব্রতা আরও বাড়লে আমরা ওকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে আসতে বলি। এমন ধারালো বৃষ্টি আর ছেলেপিলেদের আনন্দোল্লাসে ভয় পেয়েই হয়তো মাছগুলো দিজ্ঞ্বিদিকে হারিয়ে যায়। বড় তবুও কোনোমতে কাপড়ের পুঁটুলিতে জড়িয়ে বড় বড় দুটো কই মাছ নিয়ে আসে। কিন্তু ওর হাতের গামলাটি একেবারে রিক্ত-শূন্য।
বৃষ্টিদিনে, মরণের হাতছানি
আমাদের বাড়ির খোলা জায়গার ওপাশে আল্পনাদি, কাঞ্চনদাদের একতলা বাড়ি। তাদের বাড়ির ওপাশে দিগন্ত বিস্তৃত খোলা জায়গা। এই মাঠের পাশে যে কমিউনিটি সেন্টার আর মুগদাপাড়ার কাঁচা প্রশস্ত রাস্তা- সেটি আমাদের দোতলার বারান্দা থেকেও দেখা যায়। শুকনো সময়ে যেখানে ধানের চাষ করা হয়, বর্ষা মৌসুমে সেটিই আবার বৃষ্টির পানিতে টইটম্বুর প্রকাণ্ড এক বিল হয়ে যায়! দুরন্ত ছেলেপেলেরা রাস্তার ঘেষোজমিতে কোনোমতে প্যান্টটা খুলে রেখে অবাধে সেখানে সাঁতরে বেড়ায়। একদিন মায়াকানন মসজিদ থেকে ক্ষণে ক্ষণে মাইকিং হলো- তুষার আর ননীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! স্কুল ছুটির পর থেকেই নাকি এরা দু'জন হাওয়া। সেদিনও আকাশ খুব মেঘলা ছিল। টানা কয়েকদিনের বিরতিহীন ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে আশপাশের ডোবা-বিলের পানিও রাস্তায় উঠে আসে। সন্ধ্যার আগে আগে সমস্ত ঝড়-বৃষ্টিকে ছাপিয়ে বিলের পূর্বদিকে, আহমেদবাগের ঘাটে একসঙ্গে অনেকের চিৎকার শুনতে পাওয়া যায়। আমরা তাড়াতাড়ি ছাতা নিয়ে ছাদে উঠি। তুষার আর ননীর নিথর দেহটা কারেন্ট জালে আটকে ছিল! আহা, স্কুল ছুটির পর নিশ্চয়ই বৃষ্টির পানিতে ভিজে বিলের মধ্যে সাঁতার কাটতে গিয়েছিল... এরপর থেকে সন্ধ্যায় বা রাতে সামনের বিলের দিকে তাকালে কেমন ভয় ভয় করে! শুধু তুষার আর ননীই নয়, এরকম ভরা বৃষ্টির দিনে সাঁতার কাটতে গিয়ে ডুবে যায় আরও কিছু শিশু-কিশোর। প্রায় এক-দুই সপ্তাহ পরপরই মসজিদে-মসজিদে ছেলে হারানোর মাইকিং শোনা যায়। এগুলো শুনে শুনে আমার শিশুমনের অস্থির চিন্তাগুলো এমন ছিল, এই ঝিরঝিরে বৃষ্টিদিনগুলো ছেলেগুলোকে বোবায় পাওয়ার মতো বিলের কাছে টেনে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিত না তো!
চা বাগানে পাথুরে বৃষ্টি
শুধু বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান ছাড়া অরুর সাথে আমার প্রায় কিছুই মেলে না! অরু আমার মতো গোবেচারা সিঙ্গেল ব্যাচেলর নয়। ওর স্টেডি বয়ফ্রেন্ড আছে, একসাথে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ায়, অফিসশেষে ক্যান্ডল নাইট ডিনার করে, বৃহস্পতিবারে নাইট ক্লাবেও ঢুঁ দেয়। এদিকে আমার জীবন মানেই আমার পরিবার- মা, ভাই-বোন, পোষা পাখি আর ছোট্ট ছাদবাগান! অরু একদিন সেখানেও নাক গলায়, "তোর লাইফটা এভাবে একেবারে হেল হয়ে যাচ্ছে রে! চল, চল পালাই...সোজা চা বাগানে চলে যাই!" আমি চোখ কপালে তুলে বলি, "তোর বয়ফ্রেন্ড?" অরু তাচ্ছিল্যের সাথে বলে, "ও দেশে নেই। তাছাড়া আমরা কিছুদিন সেপারেশনে আছি।" আমার আর কিছু বলার নেই, আমি বাক্যহারা। এরকম বয়ফ্রেন্ডের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ হলে মা মনে হয় হার্টফেল করত!
দু-একটি জামাকাপড় ট্রলিতে ভরেছি কি ভরিনি, অরু সেগুলো আবার আলমারিতে ছুঁড়ে দিয়ে বলে, 'বাইরে তাকিয়ে দ্যাখ, কীরকম ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছে...আর তুই কীসব সালোয়ার-কামিজ নিচ্ছিস! জ্যাকেট, স্কার্ট এসব নে।'
অগত্যা কী আর করা। ব্যাগপত্র নিয়ে ওর ঝকঝকে টয়োটা প্রিয়ারস্ে উঠে বসি। অন্যসময়ে ধানীলঙ্কার মতো ফস্ করে রেগে গেলেও অরু একদম মাথা ঠান্ডা রেখে গাড়ি চালায়, নতুন নতুন রাস্তার ওপর গাড়ি উঠিয়ে দেয়।
আজকের সকালের হাইওয়ে একেবারে সুনসান, ফাঁকা। ঢাকা ছেড়ে হাইওয়েতে উঠেও হালকা ঝিরঝিরে বৃষ্টি পেয়েছি আমরা। বৃষ্টিতে দু'পাশের সবুজ ধুয়ে-মুছে আরও সবুজ, নতুন পাতার মতো জেগে উঠেছে। যদিও আকাশ ঢেকে আছে কাঠ কয়লার ঘনকালো মেঘে। এরই ফাঁকে ফাঁকে টং দোকানে চলতে থাকে আমাদের চা-শিঙাড়া-সমুচা বিরতি।
গাড়ি যখন শ্রীমঙ্গল পেরিয়ে মৌলভীবাজারের দিকে ঢোকে তখুনি বদলে যায় বৃষ্টির স্বরূপ। এতো বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা আমরা দু'জনের কেউ কখনও দেখিনি। যেন আকাশ থেকে কেউ আমাদের নিশানা করে পাথর ছুড়ছে! অরুকে তাড়াতাড়ি কোনো বড় গাছের নিচে কিংবা রিসোর্টে থামতে অনুরোধ করি। অথচ সামনে কোনো রিসোর্ট বা আশ্রয়দায়ী গাছ না থাকায় এই দুর্যোগেও বেচারি গাড়ি চালিয়ে যেতে থাকে। আমাদের জন্যে আরও বড় বিপদ অপেক্ষা করছিল। এতক্ষণ তাও আমরা কিছুটা হলেও বাইরের দৃশ্য দেখতে পাচ্ছিলাম! লাউয়াছড়ার কাছে এসে রাস্তা এমনভাবে ভারি বৃষ্টিতে ঢাকা ছিল, যেন ওপাশে কালো পর্দা টাঙানো হয়েছে...
এ পথে আর গাড়ি নিয়ে এগোনো প্রায় অসম্ভব! কাজেই এই প্রচণ্ড বৃষ্টিঝড় পেছনে ফেলে অরু আবার ঢাকার পথে গাড়ি ঘুরিয়ে দেয়...
মন্তব্য করুন