
'বাদল-দিনের প্রথম কদম ফুল' কিংবা 'যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো এক বরষায়'। বর্ষার সাথে কবে থেকে এই রোমান্টিকতার যৌথ যাত্রা শুরু? 'এমন দিনে তারে বলা যায়/এমন ঘনঘোর বরিষায়'। বর্ষা ঘিরে সাহিত্যের অধিকাংশজুড়েই এই প্রেমময় আকুতির আধিক্য।
প্রবণতাটা হিন্দি ছবিতে খুব সাধারণ, 'টিপটিপ বর্ষা পানি, পানিনে আগ লাগায়া!' অনুকরণে বাংলা চলচ্চিত্রেও পানির ফোয়ারা ছেড়ে নকল বৃষ্টিতে সাদা শাড়ি পরিহিতা নায়িকাকে ভেজানোর দৃশ্যটি এতই জনপ্রিয়, যেন মানব-মানবীর প্রেম মানেই বৃষ্টি; বৃষ্টি মানেই প্রেম।
সাহিত্য, চলচ্চিত্রায়ণের প্রভাব থেকে মাইন্ড সেটআপ কিংবা মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে শারীরবৃত্তীয় কোনো কারণ হোক, যে কোনো কারণেই একটু অবকাশে সমাজ সংসারের চাপহীন মানবমন আকাশে মেঘের ঘনঘটা দেখলেই প্রেমিকের তরে আকুল হয়- এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। মেঘমেদুর আকাশের সাথে প্রেমময় আকুলতার যেন এক অদৃশ্য অচ্ছেদ্য বন্ধন।
আকাশজুড়ে কালো মেঘ, বহু যুগের ওপার হতে আসা আঁধার। সুপারি গাছের মগডাল দুলছে মেঘের ছোঁয়ায়। জানালা গলে ঠান্ডা বাতাস হিমস্পর্শে ভুলিয়ে দিচ্ছে হাঁসফাঁস গরম। সূর্য ঢাকা পড়েছে কালো মেঘের স্তরে দিনদুপুরে, মেঘের পরে মেঘ জমে আঁধার হয়ে আসে এমন সময় হৃদয় অবশ্যম্ভাবী হাহাকার করে ওঠে প্রণয়ের জন্য।
কিন্তু এই অনুভব কাদের? কোন শ্রেণির?
বর্ষামঙ্গল, বর্ষাবরণ সব আয়োজনের অন্তরালে বড় বেদনার মতো অনুচ্চারিত যে সত্য, তা হলো এই যে এ কেবলই ঈশ্বর থাকেন যে ভদ্রপল্লিতে সেই ভদ্রপল্লির। এর বাইরে আমাদের এই প্রাচ্য সমাজের যে বিশাল শ্রমজীবী মানুষ তাঁদের কাছে বর্ষা এক অভিশাপ। এরাই সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ। ভদ্র নাগরিক সমাজ যখন নীলাম্বরিতে বর্ষাবরণে ব্যস্ত তখন সংখ্যাগরিষ্ঠের ঘরে ঘরে হাহাকার।
ঋতু পরিবর্তনের স্বাভাবিক নিয়মে আসা মৌসুমি বায়ু ঘিরে নিম্নবিত্ত মানুষের আগাম কিছু প্রস্তুতি থাকে। তারা জানে 'গাদলা'র দিন আসছে। বসতঘরের ছাউনি দেওয়া, অন্ধের যষ্টির মতো যৎসামান্য সম্পদ সামলে রাখার অনেক প্রস্তুতি থাকে তাঁদের বর্ষাকে সামাল দেওয়ার। তবু অপ্রতিরোধ্য বর্ষা ঘরের চাল ফুঁড়ে ভাসিয়ে নেয় তাঁদের সাজানো সংসার। বন্ধ হয়ে থাকে তাঁদের দিন আনি দিন খাই জীবিকা। আমরা তথাকথিত ভদ্র সমাজ যখন বর্ষা ঘিরে কাব্য করি, বিপর্যস্ত মানুষ তখন আকুল হয়ে প্রার্থনায় নত হয় বর্ষার বিদায় আকাঙ্ক্ষায়।
কারণ এ ছাড়া আর কিছু করার থাকে না তাদের। যদি প্রকৃতি কিংবা বিশ্বাসের সর্বশক্তি সদয় হয়, বর্ষা থামে, তবেই তারা ঘর থেকে বের হতে পারে জীবিকার সন্ধানে। উনুনে হাঁড়ি চড়ে।
যে শহরটিতে আমার জন্ম আর বেড়ে ওঠা, খোয়াই নদীর পাড় ঘিরে সেই গঞ্জ। হবিগঞ্জ। নদীপথে যাতায়াতের সুবিধার কারণে অধিকাংশ জনবসতি গড়ে উঠেছিল নদীর পাড় ঘিরে। হবিগঞ্জ তেমনই এক জনবসতি। নদী ঘিরে যেমন এর পত্তন, নদীই হয়ে ওঠে এর দুঃখ। ভারতের ত্রিপুরার পাহাড় থেকে এ নদীর উৎপত্তি। পাহাড়ে বৃষ্টি মানেই প্রমত্তা খোয়াই। আমার স্পষ্ট মনে আছে, সেই শৈশবে হঠাৎ মহাপ্রলয়ের শিঙ্গার মতো বেজে উঠত চোঙা মাইক। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে খোয়াই নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নির্ঘুম শহরবাসী এই খরস্রোতা ঢলের পানিকে বলত 'গোলা আইছে'। খোয়াই নদীতে গোলা আইছে। দেখতে দেখতে গোলার পানিতে তলিয়ে যেত শহর। ঘরবাড়ি। রান্নার উনুন। ভেসে যেত হাঁড়িকুড়ি, কতজনের সাজানো সংসার! আমার পরিবারের কত নির্ঘুম রাতের সাক্ষী আমি।
তারপর একদিন শহর রক্ষা বাঁধ হয়েছে। শহর ঘেঁষে বয়ে চলা নদীর গতিপথ শহরতলির মাছুলিয়া পয়েন্ট দিয়ে কেটে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আপাত রক্ষা পেয়েছে শহরবাসী। কিন্তু শহরবাসীকে রক্ষার বলি হয়েছে কত গ্রামীণ জনপদ। এখনও হয়। উজানের ঢলে যখন খোয়াই নদীতে 'গোলা' আসে, পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে ঠিক কোনো না কোনো গ্রামের দিকে পানি যাওয়ার রাস্তা কেটে দেওয়া হয়। উচ্চপদস্থ প্রশাসনিক কর্মকর্তারা রাত জেগে সিদ্ধান্ত নিয়ে শহরবাসীকে বাঁচিয়ে দেন। ভেসে যায় গ্রামবাসী। তাঁরা কই যায়, কীভাবে যায়, অপরাধ স্বীকার করে বলি- জানা হয়নি আজ পর্যন্ত।
এ বছর বৃহত্তর সিলেটবাসী দেখল স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা। পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষের অভিজ্ঞতায় এমন পানির তোড়ের স্মৃতি নেই। ডুবে যাওয়া মানুষগুলোর অভিজ্ঞতা একই রকম। দেখতে দেখতে তীব্র স্রোতে পানি ঢুকে গেছে রাস্তায়, রাস্তা পেরিয়ে উঠানে, উঠান পেরিয়ে ঘর। কোমরপানি। অভিজ্ঞতা আর প্রস্তুতির অভাবে কেউ কিচ্ছু বাঁচাতে পারেনি। কোনো পার্থিব সম্পদ নয়, কেবল নিজের প্রাণটাই বাঁচাতে চেয়েছে প্রাণপণে। এ এক বিভীষিকাময় সময় সিলেটবাসীর। যার সাথে এই নগর কিংবা জেলাবাসীর পূর্বপরিচয় ছিল না। চারদিক থেকে তেড়ে আসা তীব্র পানির স্রোত আর এর সাথে অবিরাম বর্ষণ। বৃষ্টিপ্রবণ সিলেট অঞ্চলেও এবার স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হচ্ছে।
ডুবে গেছে ঘরের বিছানা-বালিশ, রান্নার চুলা, ক্লজেটের কাপড়, বুকশেল্কেম্ফর বই। কেউ কিচ্ছু বাঁচাতে পারেনি। বিদ্যুৎকেন্দ্রে পানি ঢুকে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে চব্বিশ ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই। বন্ধ হয়ে গেছে মোবাইল নেটওয়ার্ক। সাধারণ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র হয়ে গেছে দুর্লভ। অসাধু ব্যবসায়ীদের পাঁয়তারার মুনাফার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে নিত্যপণ্য নিয়ে।
এ এক অমানবিক অবস্থা। যে অঞ্চলের ঘরে ঘরে লন্ডনি পাউন্ড উপার্জনকারীদের বসবাস, সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স জোগান দেয় যে অঞ্চল। প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে পর্যটন খাতে বিপুল আয় যে অঞ্চল থেকে আসে, সেই অঞ্চল থমকে যায় দুর্বিষহ অসহায়ত্বে। এ অবস্থা অকল্পনীয়।
ভীষণ দুর্দশায় নিম্নবর্গের মানুষ যেন রোজ কেয়ামত দেখে পানির তোড়ে। বাঁচার রাস্তা খোলা নেই। পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ সব দিকেই কেবল পানি আর পানি। এত পানি এ অঞ্চলের মানুষ এর আগে আর দেখেনি কখনও। সিলেট থেকেও ভয়াবহ অবস্থা সুনামগঞ্জের। সুনামগঞ্জ এমনিতেই যোগাযোগের ক্ষেত্রে দুর্গম। সিলেট জেলা সদর থেকে সুনামগঞ্জ জেলা সদরে যাওয়ার রাস্তাটি হয়েছে খুব বেশিদিন হয়নি। নইলে পুরো সুনামগঞ্জ পানিবেষ্টিত প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল। যে টাঙ্গুয়ার হাওড় ভ্রমণপিপাসুদের অপার সৌন্দর্যের তৃষ্ণা মেটায়, সেই টাঙ্গুয়ার হাওড়সহ একাধিক হাওড় বেষ্টন করে রেখেছে সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকা। যেসব এলাকা কোনো দুর্যোগ দুর্বিপাক ছাড়াই দুর্গম। এবারের প্রলয়ংকরী বন্যায় সেই দুর্গম অঞ্চলগুলোতে এখনও ত্রাণ পৌঁছানো যায়নি। জানা যায়নি কেমন আছে এর অধিবাসীরা। সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত প্রাণপণে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দিরাই শাল্লা এসব অঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের।
পানি ধীরে নেমে যাচ্ছে। জানমালের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে মানুষ তবু আপাত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। হয়তো আপাত বিপদ কেটে গেছে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে প্রচুর সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে মানুষ দাঁড়িয়েছে মানুষের পাশে। বরাবরের মতো সর্বশক্তি দিয়ে মানুষের পাশে মানুষ দাঁড়িয়ে প্রমাণ করেছে, সবার ওপরে মানুষ সত্য। মানুষের হাত ধরেই বেঁচে উঠছে মানুষ।
তবু শেষ কথা রয়ে যায়। এভাবে পুরো এলাকা ভাসিয়ে নেওয়ার মতো তীব্র স্রোতের পানির উৎস তবে কী? কেন এই পানি এভাবে চোখের নিমেষে পুরো অঞ্চল ডুবিয়ে দিল? আপাতভাবে যেটুকু জানা গেছে তা হলো, আসামের চেরাপুঞ্জিতে এবার ১২২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। সেই বৃষ্টির পানি প্রবল তোড়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে এসেছে এই অঞ্চলে। মূলত পানির ধর্ম ওপর থেকে নিচে গড়ানো। সেই পানি বঙ্গোপসাগরে পতিত হওয়ার গতিপথ এই সুরমা, কুশিয়ারা, মেঘনা এবং বিশাল হাওরগুলো। সেই গতিপথ রুদ্ধ করা হচ্ছে নানা অবকাঠামো নির্মাণ করে।
প্রথমত, আসামে বনাঞ্চল উজাড় করে অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে পানির দ্রুত এবং অবাধ তীব্র প্রবাহ এবং দ্বিতীয়ত, পানি প্রবাহের যাত্রাপথে নদী দখল, হাওর ভরাট করে অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ- এই দুয়ের ফল এবারের প্রলয়ংকরী বন্যা।
এই বন্যার উৎস সম্পর্কে আরও অনুসন্ধান করা না গেলে, তা প্রতিহত করার ব্যবস্থা না করা গেলে 'এই দিন দিন নয়'-এর মতো ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ দুর্ভোগ অপেক্ষা করে আছে।
প্রকৃতি মানুষ যেভাবে ধ্বংস করছে, প্রকৃতি তার নিজের মতো করে প্রতিশোধ নিচ্ছে তার ভুক্তভোগী হচ্ছে মানুষই।
পার্থক্য হয়তো এটুকুই, একদল মানুষ ধ্বংস করছে আরেক দল মানুষ মাশুল দিচ্ছে।
হুঁশ হোক মানুষের। বাঁচুক নিরপরাধ ভুক্তভোগী মানুষ।
প্রবণতাটা হিন্দি ছবিতে খুব সাধারণ, 'টিপটিপ বর্ষা পানি, পানিনে আগ লাগায়া!' অনুকরণে বাংলা চলচ্চিত্রেও পানির ফোয়ারা ছেড়ে নকল বৃষ্টিতে সাদা শাড়ি পরিহিতা নায়িকাকে ভেজানোর দৃশ্যটি এতই জনপ্রিয়, যেন মানব-মানবীর প্রেম মানেই বৃষ্টি; বৃষ্টি মানেই প্রেম।
সাহিত্য, চলচ্চিত্রায়ণের প্রভাব থেকে মাইন্ড সেটআপ কিংবা মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে শারীরবৃত্তীয় কোনো কারণ হোক, যে কোনো কারণেই একটু অবকাশে সমাজ সংসারের চাপহীন মানবমন আকাশে মেঘের ঘনঘটা দেখলেই প্রেমিকের তরে আকুল হয়- এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। মেঘমেদুর আকাশের সাথে প্রেমময় আকুলতার যেন এক অদৃশ্য অচ্ছেদ্য বন্ধন।
আকাশজুড়ে কালো মেঘ, বহু যুগের ওপার হতে আসা আঁধার। সুপারি গাছের মগডাল দুলছে মেঘের ছোঁয়ায়। জানালা গলে ঠান্ডা বাতাস হিমস্পর্শে ভুলিয়ে দিচ্ছে হাঁসফাঁস গরম। সূর্য ঢাকা পড়েছে কালো মেঘের স্তরে দিনদুপুরে, মেঘের পরে মেঘ জমে আঁধার হয়ে আসে এমন সময় হৃদয় অবশ্যম্ভাবী হাহাকার করে ওঠে প্রণয়ের জন্য।
কিন্তু এই অনুভব কাদের? কোন শ্রেণির?
বর্ষামঙ্গল, বর্ষাবরণ সব আয়োজনের অন্তরালে বড় বেদনার মতো অনুচ্চারিত যে সত্য, তা হলো এই যে এ কেবলই ঈশ্বর থাকেন যে ভদ্রপল্লিতে সেই ভদ্রপল্লির। এর বাইরে আমাদের এই প্রাচ্য সমাজের যে বিশাল শ্রমজীবী মানুষ তাঁদের কাছে বর্ষা এক অভিশাপ। এরাই সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ। ভদ্র নাগরিক সমাজ যখন নীলাম্বরিতে বর্ষাবরণে ব্যস্ত তখন সংখ্যাগরিষ্ঠের ঘরে ঘরে হাহাকার।
ঋতু পরিবর্তনের স্বাভাবিক নিয়মে আসা মৌসুমি বায়ু ঘিরে নিম্নবিত্ত মানুষের আগাম কিছু প্রস্তুতি থাকে। তারা জানে 'গাদলা'র দিন আসছে। বসতঘরের ছাউনি দেওয়া, অন্ধের যষ্টির মতো যৎসামান্য সম্পদ সামলে রাখার অনেক প্রস্তুতি থাকে তাঁদের বর্ষাকে সামাল দেওয়ার। তবু অপ্রতিরোধ্য বর্ষা ঘরের চাল ফুঁড়ে ভাসিয়ে নেয় তাঁদের সাজানো সংসার। বন্ধ হয়ে থাকে তাঁদের দিন আনি দিন খাই জীবিকা। আমরা তথাকথিত ভদ্র সমাজ যখন বর্ষা ঘিরে কাব্য করি, বিপর্যস্ত মানুষ তখন আকুল হয়ে প্রার্থনায় নত হয় বর্ষার বিদায় আকাঙ্ক্ষায়।
কারণ এ ছাড়া আর কিছু করার থাকে না তাদের। যদি প্রকৃতি কিংবা বিশ্বাসের সর্বশক্তি সদয় হয়, বর্ষা থামে, তবেই তারা ঘর থেকে বের হতে পারে জীবিকার সন্ধানে। উনুনে হাঁড়ি চড়ে।
যে শহরটিতে আমার জন্ম আর বেড়ে ওঠা, খোয়াই নদীর পাড় ঘিরে সেই গঞ্জ। হবিগঞ্জ। নদীপথে যাতায়াতের সুবিধার কারণে অধিকাংশ জনবসতি গড়ে উঠেছিল নদীর পাড় ঘিরে। হবিগঞ্জ তেমনই এক জনবসতি। নদী ঘিরে যেমন এর পত্তন, নদীই হয়ে ওঠে এর দুঃখ। ভারতের ত্রিপুরার পাহাড় থেকে এ নদীর উৎপত্তি। পাহাড়ে বৃষ্টি মানেই প্রমত্তা খোয়াই। আমার স্পষ্ট মনে আছে, সেই শৈশবে হঠাৎ মহাপ্রলয়ের শিঙ্গার মতো বেজে উঠত চোঙা মাইক। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে খোয়াই নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নির্ঘুম শহরবাসী এই খরস্রোতা ঢলের পানিকে বলত 'গোলা আইছে'। খোয়াই নদীতে গোলা আইছে। দেখতে দেখতে গোলার পানিতে তলিয়ে যেত শহর। ঘরবাড়ি। রান্নার উনুন। ভেসে যেত হাঁড়িকুড়ি, কতজনের সাজানো সংসার! আমার পরিবারের কত নির্ঘুম রাতের সাক্ষী আমি।
তারপর একদিন শহর রক্ষা বাঁধ হয়েছে। শহর ঘেঁষে বয়ে চলা নদীর গতিপথ শহরতলির মাছুলিয়া পয়েন্ট দিয়ে কেটে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আপাত রক্ষা পেয়েছে শহরবাসী। কিন্তু শহরবাসীকে রক্ষার বলি হয়েছে কত গ্রামীণ জনপদ। এখনও হয়। উজানের ঢলে যখন খোয়াই নদীতে 'গোলা' আসে, পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে ঠিক কোনো না কোনো গ্রামের দিকে পানি যাওয়ার রাস্তা কেটে দেওয়া হয়। উচ্চপদস্থ প্রশাসনিক কর্মকর্তারা রাত জেগে সিদ্ধান্ত নিয়ে শহরবাসীকে বাঁচিয়ে দেন। ভেসে যায় গ্রামবাসী। তাঁরা কই যায়, কীভাবে যায়, অপরাধ স্বীকার করে বলি- জানা হয়নি আজ পর্যন্ত।
এ বছর বৃহত্তর সিলেটবাসী দেখল স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা। পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষের অভিজ্ঞতায় এমন পানির তোড়ের স্মৃতি নেই। ডুবে যাওয়া মানুষগুলোর অভিজ্ঞতা একই রকম। দেখতে দেখতে তীব্র স্রোতে পানি ঢুকে গেছে রাস্তায়, রাস্তা পেরিয়ে উঠানে, উঠান পেরিয়ে ঘর। কোমরপানি। অভিজ্ঞতা আর প্রস্তুতির অভাবে কেউ কিচ্ছু বাঁচাতে পারেনি। কোনো পার্থিব সম্পদ নয়, কেবল নিজের প্রাণটাই বাঁচাতে চেয়েছে প্রাণপণে। এ এক বিভীষিকাময় সময় সিলেটবাসীর। যার সাথে এই নগর কিংবা জেলাবাসীর পূর্বপরিচয় ছিল না। চারদিক থেকে তেড়ে আসা তীব্র পানির স্রোত আর এর সাথে অবিরাম বর্ষণ। বৃষ্টিপ্রবণ সিলেট অঞ্চলেও এবার স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হচ্ছে।
ডুবে গেছে ঘরের বিছানা-বালিশ, রান্নার চুলা, ক্লজেটের কাপড়, বুকশেল্কেম্ফর বই। কেউ কিচ্ছু বাঁচাতে পারেনি। বিদ্যুৎকেন্দ্রে পানি ঢুকে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে চব্বিশ ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই। বন্ধ হয়ে গেছে মোবাইল নেটওয়ার্ক। সাধারণ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র হয়ে গেছে দুর্লভ। অসাধু ব্যবসায়ীদের পাঁয়তারার মুনাফার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে নিত্যপণ্য নিয়ে।
এ এক অমানবিক অবস্থা। যে অঞ্চলের ঘরে ঘরে লন্ডনি পাউন্ড উপার্জনকারীদের বসবাস, সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স জোগান দেয় যে অঞ্চল। প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে পর্যটন খাতে বিপুল আয় যে অঞ্চল থেকে আসে, সেই অঞ্চল থমকে যায় দুর্বিষহ অসহায়ত্বে। এ অবস্থা অকল্পনীয়।
ভীষণ দুর্দশায় নিম্নবর্গের মানুষ যেন রোজ কেয়ামত দেখে পানির তোড়ে। বাঁচার রাস্তা খোলা নেই। পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ সব দিকেই কেবল পানি আর পানি। এত পানি এ অঞ্চলের মানুষ এর আগে আর দেখেনি কখনও। সিলেট থেকেও ভয়াবহ অবস্থা সুনামগঞ্জের। সুনামগঞ্জ এমনিতেই যোগাযোগের ক্ষেত্রে দুর্গম। সিলেট জেলা সদর থেকে সুনামগঞ্জ জেলা সদরে যাওয়ার রাস্তাটি হয়েছে খুব বেশিদিন হয়নি। নইলে পুরো সুনামগঞ্জ পানিবেষ্টিত প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল। যে টাঙ্গুয়ার হাওড় ভ্রমণপিপাসুদের অপার সৌন্দর্যের তৃষ্ণা মেটায়, সেই টাঙ্গুয়ার হাওড়সহ একাধিক হাওড় বেষ্টন করে রেখেছে সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকা। যেসব এলাকা কোনো দুর্যোগ দুর্বিপাক ছাড়াই দুর্গম। এবারের প্রলয়ংকরী বন্যায় সেই দুর্গম অঞ্চলগুলোতে এখনও ত্রাণ পৌঁছানো যায়নি। জানা যায়নি কেমন আছে এর অধিবাসীরা। সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত প্রাণপণে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দিরাই শাল্লা এসব অঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের।
পানি ধীরে নেমে যাচ্ছে। জানমালের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে মানুষ তবু আপাত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। হয়তো আপাত বিপদ কেটে গেছে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে প্রচুর সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে মানুষ দাঁড়িয়েছে মানুষের পাশে। বরাবরের মতো সর্বশক্তি দিয়ে মানুষের পাশে মানুষ দাঁড়িয়ে প্রমাণ করেছে, সবার ওপরে মানুষ সত্য। মানুষের হাত ধরেই বেঁচে উঠছে মানুষ।
তবু শেষ কথা রয়ে যায়। এভাবে পুরো এলাকা ভাসিয়ে নেওয়ার মতো তীব্র স্রোতের পানির উৎস তবে কী? কেন এই পানি এভাবে চোখের নিমেষে পুরো অঞ্চল ডুবিয়ে দিল? আপাতভাবে যেটুকু জানা গেছে তা হলো, আসামের চেরাপুঞ্জিতে এবার ১২২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। সেই বৃষ্টির পানি প্রবল তোড়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে এসেছে এই অঞ্চলে। মূলত পানির ধর্ম ওপর থেকে নিচে গড়ানো। সেই পানি বঙ্গোপসাগরে পতিত হওয়ার গতিপথ এই সুরমা, কুশিয়ারা, মেঘনা এবং বিশাল হাওরগুলো। সেই গতিপথ রুদ্ধ করা হচ্ছে নানা অবকাঠামো নির্মাণ করে।
প্রথমত, আসামে বনাঞ্চল উজাড় করে অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে পানির দ্রুত এবং অবাধ তীব্র প্রবাহ এবং দ্বিতীয়ত, পানি প্রবাহের যাত্রাপথে নদী দখল, হাওর ভরাট করে অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ- এই দুয়ের ফল এবারের প্রলয়ংকরী বন্যা।
এই বন্যার উৎস সম্পর্কে আরও অনুসন্ধান করা না গেলে, তা প্রতিহত করার ব্যবস্থা না করা গেলে 'এই দিন দিন নয়'-এর মতো ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ দুর্ভোগ অপেক্ষা করে আছে।
প্রকৃতি মানুষ যেভাবে ধ্বংস করছে, প্রকৃতি তার নিজের মতো করে প্রতিশোধ নিচ্ছে তার ভুক্তভোগী হচ্ছে মানুষই।
পার্থক্য হয়তো এটুকুই, একদল মানুষ ধ্বংস করছে আরেক দল মানুষ মাশুল দিচ্ছে।
হুঁশ হোক মানুষের। বাঁচুক নিরপরাধ ভুক্তভোগী মানুষ।
মন্তব্য করুন