![সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী [জন্ম :২৩ জুন, ১৯৩৬]](https://samakal.com/uploads/2022/06/online/photos/Untitled-67-samakal-62b4ac7c9d4cc.jpg)
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী [জন্ম :২৩ জুন, ১৯৩৬]
অতি শ্রদ্ধেয় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে আমরা একজন প্রাবন্ধিক হিসেবে চিনি। পুঁজিবাদ এবং সামন্তবাদবিরোধী এই লেখক আমাদের লেখার জগতে জাজ্বল্যমান এক সূর্য। তাঁর ক্ষুরধার কিন্তু সাহিত্যের আরকে জারিত প্রবন্ধগুলো পড়তে আমাদের শুধু ভালোই লাগে না, আমরা তাঁর বক্তব্যের বলিষ্ঠতায় প্রভাবিত হই। প্রথম জীবনে কঠোর আদর্শবাদী এই লেখক একজন কথাসাহিত্যিক হিসেবেই হয়তো সাহিত্যের জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। এবং একজন ধ্রুপদি কথাসাহিত্যিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে তাঁর কোনো বাধা ছিল না। কিন্তু এই সমাজের ক্রম অবনতি, অসাম্য, অবিচার তাঁকে প্রবন্ধের মাধ্যমে একজন বিদ্রোহী সত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তবুও তার ফাঁকে ফাঁকে তাঁর মৌলিক গল্প বলার সত্তাটি হারিয়ে যায়নি, বরং সেটি ধারালো চকচকে ছুরির মতো মাঝে মাঝে ঝলসে উঠেছে।
তিনি একটিমাত্র গল্পের বই লিখেছেন বিগত নব্বই দশকের দিকে, যেটি পরে নতুন কলবরে ২০০১ সালে আরও কয়েকটি গল্পের সংযোগে নতুনভাবে প্রকাশিত হয়। 'ভাল মানুষের জগৎ'-এ তাঁর মোট ৯টি গল্প স্থান পেয়েছে। তবে তাঁর প্রবন্ধের বইগুলো পড়ে আমার এটাও ধারণা যে অনেক লেখা, যা তিনি প্রবন্ধের আকারে বা কথকতা রূপে সংযোজিত করেছেন, তাদের সামান্য অদলবদল করে অনায়াসে গল্পের জগতে স্থান দেওয়া যেত।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর গল্পের বইটির নাম 'ভাল মানুষের জগৎ'। ৯টি গল্পের সমাহারে এই বইটি সজ্জিত। অধিকাংশ গল্পের ভেতরে আছে মানুষের যাপিত জীবনের সঙ্গে আদর্শের সংঘাত এবং জীবনের বাস্তবতার কাছে সেই আদর্শের মাথা নত হয়ে যাওয়া। শুধু বাস্তবতা নয়, মানুষের মনের লোভও সেই পতনের মূলে। মানুষের মনোজগতের বর্ণনায় লেখক যে সিদ্ধহস্ত, জটিল-কুটিল চিন্তাভাবনায় যে মানুষের মনোজগৎ ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়, বা প্রতিনিয়ত যাচ্ছে, প্রায় প্রতিটি গল্পেই তার ছাপ আছে। জটিল চিন্তাভাবনার কারণেই কোনো গল্পই তার সংক্ষিপ্ত নয়, বরং কলেবর নিয়েই তারা প্রকাশিত। আরও আছে পরিবারকে সুখে রাখতে গিয়ে নিজের আদর্শকে অর্থের কাছে জলাঞ্জলি দেওয়া, যদিও পরিবার বলেনি তাদের জন্যে আদর্শকে বিসর্জন দিতে। এটি পরিবারের প্রতি পুরুষেরই আত্মনিবেদন। যাকে এক কথায় আনুগত্য বা ভালোবাসা বলা যায়। যে জন্য 'হারাবার কিছু নেই' গল্পের নায়ক মনে মনে তার স্ত্রীর বিদ্রুপের হাসিও উপেক্ষা করে মনে মনে বলতে পারে 'হাসো মেয়ে, তুমি হাসতে শেখো। দুনিয়াটা যে কত কঠিন বস্তু সে তো তুমি জানো না। দোয়া করি, কোনোদিন যাতে জানতে না হয়।'
মেয়েটি তার স্ত্রী চিনু, যে তাকে বামপন্থি জেনেই এককালে বিয়ে করেছিল, তাহলে দুনিয়াটা যে কেমন কঠিন বস্তু চিনু কেন জানবে না? যদি না জানতে চায় তাহলে একজন বিপ্লবীর সঙ্গে জীবনের গাঁটছড়া বাঁধা কেন?
অথচ বিয়ের আগে বা বিয়ের পর পরই সেই নায়কের চরিত্র ছিল এরকম, 'আমি ছিলাম চরমপন্থী, আমার দুর্বার আস্থা ছিল শ্রেণী সংগ্রামে, সেই পথে সর্বহারার একনায়কত্বে। ... ভেঙে চুরমার করে দেবো না আমরা বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থাকে? আমরা হচ্ছি জাত বিপ্লবী। মরলেও মরি না।'
স্ত্রী চিনু এইসব সাহসী কথা শুনেই গল্পের নায়ককে ভালোবেসেছিল। চিনুর কোনো পরিবর্তন হয়নি, কিন্তু পরিবর্তন হয়েছে গল্পের নায়কের। বাস্তব জীবনের সংস্পর্শে এসে পরিবর্তন হয়েছে তার নিজের চরিত্রের। নিজের মনের ক্রমাগত সংঘাত ও আত্মমসালোচনাও তাকে ফেরাতে পারেনি নতুন গাড়ির স্বপ্টম্ন বা বিয়েবার্ষিকীতে ব্যাংকক ঘুরে আশার লোভ থেকে। যদিও এই লোভ সে ঢেকে রাখতে চেয়েছে স্ত্রী চিনুকে সুখী দেখতে পাওয়ার কল্পনায়, 'চিনু কোনো চিন্তা নেই আমাদের। হীরের আংটি ইনশা আল্লাহ আমিই পরাবো তোমার ফর্সা আঙুলে।' অথচ এ হীরের আংটি চিনু কখনো চায়নি। পুরুষেরই মনোবাসনা এটি তার প্রিয় নারীকে সাজাবার শখে। অথচ এই মানুষটি মাত্র কিছুদিন আগেই ছিল বিপ্লবী। কে ঘটালো এই পরিবর্তন? কেন ঘটল? দারিদ্র্য? কিন্তু দারিদ্র্য ছিল বলেই তো মানুষের স্বপ্টম্ন ছিল সমাজ বদলের। এভাবে বদল ঘটাতে তো কেউ চায়নি। গল্পের নায়িকাও নয়।
গল্পের চিনু নায়ককে কোনোদিন বলেনি যে তার হীরের একটি আংটি দরকার। এটি দরকার হলে চিনু কোনোদিন তাকে বিয়েই করত না। একদিকে নিজের আদর্শ, আরেকদিকে জাগতিক জীবনের সুখে থাকার বাসনা, এই দুই বৈপারীত্বে কেটে গেছে বা যাচ্ছে গল্পের নায়কের জীবন, যা মূলত এই মধ্যবিত্ত সমাজের পুরুষের জীবনই বটে। তাদের কর্মক্ষেত্র, তাদেরই জাগতিক জীবনের প্রতিযোগিতা যেখানে নারীর স্থান খুব কম।
তাঁর শেষ গল্পের নাম হচ্ছে, 'কোনো দাম নেই'। নিম্নবিত্তের চরম দারিদ্র্যের একটি প্রতিচ্ছবি। যে গল্পটি পড়লে মনে হতে পারে মানুষ কি আদতেই এত গরিব হতে পারে? যতই সে নিম্নবিত্তের হোক না কেন। কিন্তু হতে যে পারে, এটিই জীবনের চরম সত্য।
কিন্তু এই সত্যকেও লুকিয়ে রাখার জন্য গল্পের নায়ক রকিব উদ্দিনের আপ্রাণ চেষ্টা। এমন কি নিজের স্ত্রীর সঙ্গেও গভীর এই আক্ষেপ ও হতাশা সে ভাগ করে নিতে পারে না। আধুনিক মননশীলতার যে লক্ষণ সেই লক্ষণ তাকে আক্রান্ত করে। আর তা হচ্ছে, জীবনের একাকীত্ব। এবং সেই একাকীত্বকে নীরবতা ও নির্জনতার মোড়কে লুকিয়ে রাখা। ফলে, 'বড্ড অসহায় সে। এতো লোক অথচ কেউ নেই চারদিকে। কোনো সঙ্গী নেই, বন্ধু নেই কোনো। লুকোনোর জায়গা নেই। উপায় নেই। কে যেন চিৎকার করে বলছে, 'দেখো, একটা বাইরের লোক এসেছে এখানে, পায়ে যার জুতো নেই, পকেটে যার টিকেট (বাড়ি ফেরার) নেই।'
এর ফলে রকিব উদ্দিনের মনে হলো তার ছেঁড়াখোঁড়া অপাংক্তেয় স্যান্ডেল জোড়াটিই, যা বস্তুতপক্ষে নৈর্ব্যক্তিক ও অসার একটি বস্তু, বুঝি 'সব চেয়ে আপন, সবচেয়ে কাছের।'
এটিই এই চরিত্রের সবচেয়ে অধোগতির লক্ষণ। সবচেয়ে দুর্বলতা। তা হলো এমন একটি বস্তুকে নিজের আপন করে নেওয়া বা আপন মনে ভাবা, যে কোনো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারে না, যার কোনো প্রতিবাদ নেই। যে নায়কের চরিত্রের চেয়েও বেশি দুর্বল, বেশি অসহায়।
এই বইটির নাম 'ভাল মানুষের জগৎ'। মানব জীবনের অভিনব এক গল্প। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ভালো মানুষেরা ব্যবহূত হয়ে থাকে। তাদেরই প্রিয়জনদের হাতে। কখনও বা বাইরের জগতের মানুষের কাছেও। ভালো মানুষেরা সবই বোঝে, সব জানে, কিন্তু জেনেবুঝেও তারা ভালো মানুষের মতোই থেকে যায়। তাদের কোনো বিদ্রোহ নেই, কোনো প্রতিবাদ নেই, সতর্কতা আছে কিন্তু কোনো আদিষ্ট লক্ষ্যে তা পরিচালিত হয় না। তাদের এই ভালো মানুষজনিত অপারগতাই সংসারে তাদের বিদ্রুপের বা উপহাসের পাত্র করে তোলে। যে গৃহিণী সুন্দরী কাজের মেয়ের হাতে স্বামীকে ছেড়ে দিয়ে বাপের বাড়ি যায়, যার মনে বিন্দুমাত্র স্বামী সম্পর্কে সন্দেহ হয় না, সত্যি বলতে এটি গৃহিণীর তরফ থেকে স্বামীর প্রতি তাচ্ছিল্য ছাড়া তো আর কিছুই নয়। স্বামীর পুরুষত্বের প্রতি অবমাননা ছাড়া আর কিছু নয়। তবু ভালো মানুষেরা সেই বাড়িতেই গৃহিণী ছাড়া ফিরে যায়। একসময় তারা ফিরে যেতে চায় তাদের বাল্যের নিষ্পাপ জগতে, যে জগতে মা আছে, অকৃত্রিম ভালোবাসা আছে, কিন্তু সেখানেও আর ফিরতে পারে না। কারণ, যাদের কাছে ফিরবে, তারাও চায় না সে ফিরুক।
এই বইয়ের প্রথম গল্পটির নাম হচ্ছে 'সীমান্তে'। বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী কন্যার দেশে ফেরার বৃত্তান্ত। গল্পটি আমাদের বাংলাদেশের সাহিত্যে অপূর্ব একটি সংযোজন। একদা আদর্শবান মেয়েটি, বাংলার নাড়ি ছিঁড়ে বেরোনো মেয়েটি ক্রমে ক্রমে পাশ্চাত্য সমাজের জলবায়ু, আবহাওয়া, বিদেশি স্বামী ও সন্তানের ভেতর দিয়ে বিদেশের মাটিকেই আপন বলে আঁকড়ে ধরে রাখা এবং দেশের মাটিতে ফিরে আসবার ভয়, অসুস্থ হবার ভয়, এবং শেষমেশ টিকিট করেও দেশে ফিরে না আসা, মাঝপথ পর্যন্ত দেশে এসে আবার স্বস্থানে ফিরে যাওয়া অর্থাৎ বিদেশ- অপূর্ব এপিক একটি গল্প। এখানেও আছে বাস্তবতার সঙ্গে আপস করে নেওয়া অতি সহজেই এক জীবনের গল্প। বস্তুত বিদেশে পা রাখা কোনো সন্তানই অবশেষে দেশে ফেরে না, এর মূলে আর যাই থাক, বিদেশের রাষ্ট্রকাঠামো এবং তাদের সমাজের খোলামেলা জীবনযাপনের স্বাচ্ছন্দ্য যে মানুষকে আকৃষ্ট করে এতে করে কোনো সন্দেহ নেই, বিশেষ করে সেইসব মানুষ, যারা আমাদের মতো দেশ থেকে সেখানে প্রথম পা রাখে। বরং পাশ্চাত্যের মানুষেরা এসে আমাদের দেশে স্থায়ী হতে পারে, কিন্তু প্রাচ্যের মানুষের পক্ষে পাশ্চাত্যের আপাত স্বচ্ছ জীবন ছেড়ে নিজ দেশে ফিরে আসা কঠিন।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর পুরো বইটির মনোজগতজুড়েই এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করে গেছে। ফলে তাঁর সমগ্র গল্পমালাতে এক ধরনের মনোবেদনা, ইংরেজিতে যাকে বলে প্যাথোজ, কাজ করে গেছে। আমরা যারা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে তাঁর অসংখ্য লেখার মাধ্যমে চিনি ও জানি, আমাদের কাছে লেখকই যেন বারবার গল্পগুলোর মাধ্যমে ধরা দেন। আপসহীন মনোভাব নিয়েও আপসের বেড়াজালে তার চরিত্ররা নিজেদের আবদ্ধ দেখতে পায়। এর একটি কারণ হয়তো এককালে আমরাও তাঁর গল্পের আদর্শবান নায়কদের মতোই ছিলাম, কিন্তু বাস্তবের নিষ্ঠুর কশাঘাত আমাদের সকলকেই প্রায় বিচ্যুত করেছে।
তাঁর গল্পের ভাষা অত্যন্ত সাবলীল, সূক্ষ্ণ এবং চিন্তা-চেতনায় গভীরতা ধারণকারী।
কথাসাহিত্যিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর গল্প লেখার এখানেই সার্থকতা যে এই লেখাগুলো হয় আমাদের সমাজেরই দর্পণ, যেখানে মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত তাদের মুখ দেখতে পায়।
লেখকের জন্মদিনে তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করে আমার মতো সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধার্ঘ্য।
এই সঙ্গে আমরা স্মরণ করি লেখকপত্নী নাজমা জেসমিন চৌধুরীকেও, যাঁর সান্নিধ্যে কেটেছে লেখকের দীর্ঘ ও সুখী দাম্পত্য জীবন।
তিনি একটিমাত্র গল্পের বই লিখেছেন বিগত নব্বই দশকের দিকে, যেটি পরে নতুন কলবরে ২০০১ সালে আরও কয়েকটি গল্পের সংযোগে নতুনভাবে প্রকাশিত হয়। 'ভাল মানুষের জগৎ'-এ তাঁর মোট ৯টি গল্প স্থান পেয়েছে। তবে তাঁর প্রবন্ধের বইগুলো পড়ে আমার এটাও ধারণা যে অনেক লেখা, যা তিনি প্রবন্ধের আকারে বা কথকতা রূপে সংযোজিত করেছেন, তাদের সামান্য অদলবদল করে অনায়াসে গল্পের জগতে স্থান দেওয়া যেত।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর গল্পের বইটির নাম 'ভাল মানুষের জগৎ'। ৯টি গল্পের সমাহারে এই বইটি সজ্জিত। অধিকাংশ গল্পের ভেতরে আছে মানুষের যাপিত জীবনের সঙ্গে আদর্শের সংঘাত এবং জীবনের বাস্তবতার কাছে সেই আদর্শের মাথা নত হয়ে যাওয়া। শুধু বাস্তবতা নয়, মানুষের মনের লোভও সেই পতনের মূলে। মানুষের মনোজগতের বর্ণনায় লেখক যে সিদ্ধহস্ত, জটিল-কুটিল চিন্তাভাবনায় যে মানুষের মনোজগৎ ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়, বা প্রতিনিয়ত যাচ্ছে, প্রায় প্রতিটি গল্পেই তার ছাপ আছে। জটিল চিন্তাভাবনার কারণেই কোনো গল্পই তার সংক্ষিপ্ত নয়, বরং কলেবর নিয়েই তারা প্রকাশিত। আরও আছে পরিবারকে সুখে রাখতে গিয়ে নিজের আদর্শকে অর্থের কাছে জলাঞ্জলি দেওয়া, যদিও পরিবার বলেনি তাদের জন্যে আদর্শকে বিসর্জন দিতে। এটি পরিবারের প্রতি পুরুষেরই আত্মনিবেদন। যাকে এক কথায় আনুগত্য বা ভালোবাসা বলা যায়। যে জন্য 'হারাবার কিছু নেই' গল্পের নায়ক মনে মনে তার স্ত্রীর বিদ্রুপের হাসিও উপেক্ষা করে মনে মনে বলতে পারে 'হাসো মেয়ে, তুমি হাসতে শেখো। দুনিয়াটা যে কত কঠিন বস্তু সে তো তুমি জানো না। দোয়া করি, কোনোদিন যাতে জানতে না হয়।'
মেয়েটি তার স্ত্রী চিনু, যে তাকে বামপন্থি জেনেই এককালে বিয়ে করেছিল, তাহলে দুনিয়াটা যে কেমন কঠিন বস্তু চিনু কেন জানবে না? যদি না জানতে চায় তাহলে একজন বিপ্লবীর সঙ্গে জীবনের গাঁটছড়া বাঁধা কেন?
অথচ বিয়ের আগে বা বিয়ের পর পরই সেই নায়কের চরিত্র ছিল এরকম, 'আমি ছিলাম চরমপন্থী, আমার দুর্বার আস্থা ছিল শ্রেণী সংগ্রামে, সেই পথে সর্বহারার একনায়কত্বে। ... ভেঙে চুরমার করে দেবো না আমরা বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থাকে? আমরা হচ্ছি জাত বিপ্লবী। মরলেও মরি না।'
স্ত্রী চিনু এইসব সাহসী কথা শুনেই গল্পের নায়ককে ভালোবেসেছিল। চিনুর কোনো পরিবর্তন হয়নি, কিন্তু পরিবর্তন হয়েছে গল্পের নায়কের। বাস্তব জীবনের সংস্পর্শে এসে পরিবর্তন হয়েছে তার নিজের চরিত্রের। নিজের মনের ক্রমাগত সংঘাত ও আত্মমসালোচনাও তাকে ফেরাতে পারেনি নতুন গাড়ির স্বপ্টম্ন বা বিয়েবার্ষিকীতে ব্যাংকক ঘুরে আশার লোভ থেকে। যদিও এই লোভ সে ঢেকে রাখতে চেয়েছে স্ত্রী চিনুকে সুখী দেখতে পাওয়ার কল্পনায়, 'চিনু কোনো চিন্তা নেই আমাদের। হীরের আংটি ইনশা আল্লাহ আমিই পরাবো তোমার ফর্সা আঙুলে।' অথচ এ হীরের আংটি চিনু কখনো চায়নি। পুরুষেরই মনোবাসনা এটি তার প্রিয় নারীকে সাজাবার শখে। অথচ এই মানুষটি মাত্র কিছুদিন আগেই ছিল বিপ্লবী। কে ঘটালো এই পরিবর্তন? কেন ঘটল? দারিদ্র্য? কিন্তু দারিদ্র্য ছিল বলেই তো মানুষের স্বপ্টম্ন ছিল সমাজ বদলের। এভাবে বদল ঘটাতে তো কেউ চায়নি। গল্পের নায়িকাও নয়।
গল্পের চিনু নায়ককে কোনোদিন বলেনি যে তার হীরের একটি আংটি দরকার। এটি দরকার হলে চিনু কোনোদিন তাকে বিয়েই করত না। একদিকে নিজের আদর্শ, আরেকদিকে জাগতিক জীবনের সুখে থাকার বাসনা, এই দুই বৈপারীত্বে কেটে গেছে বা যাচ্ছে গল্পের নায়কের জীবন, যা মূলত এই মধ্যবিত্ত সমাজের পুরুষের জীবনই বটে। তাদের কর্মক্ষেত্র, তাদেরই জাগতিক জীবনের প্রতিযোগিতা যেখানে নারীর স্থান খুব কম।
তাঁর শেষ গল্পের নাম হচ্ছে, 'কোনো দাম নেই'। নিম্নবিত্তের চরম দারিদ্র্যের একটি প্রতিচ্ছবি। যে গল্পটি পড়লে মনে হতে পারে মানুষ কি আদতেই এত গরিব হতে পারে? যতই সে নিম্নবিত্তের হোক না কেন। কিন্তু হতে যে পারে, এটিই জীবনের চরম সত্য।
কিন্তু এই সত্যকেও লুকিয়ে রাখার জন্য গল্পের নায়ক রকিব উদ্দিনের আপ্রাণ চেষ্টা। এমন কি নিজের স্ত্রীর সঙ্গেও গভীর এই আক্ষেপ ও হতাশা সে ভাগ করে নিতে পারে না। আধুনিক মননশীলতার যে লক্ষণ সেই লক্ষণ তাকে আক্রান্ত করে। আর তা হচ্ছে, জীবনের একাকীত্ব। এবং সেই একাকীত্বকে নীরবতা ও নির্জনতার মোড়কে লুকিয়ে রাখা। ফলে, 'বড্ড অসহায় সে। এতো লোক অথচ কেউ নেই চারদিকে। কোনো সঙ্গী নেই, বন্ধু নেই কোনো। লুকোনোর জায়গা নেই। উপায় নেই। কে যেন চিৎকার করে বলছে, 'দেখো, একটা বাইরের লোক এসেছে এখানে, পায়ে যার জুতো নেই, পকেটে যার টিকেট (বাড়ি ফেরার) নেই।'
এর ফলে রকিব উদ্দিনের মনে হলো তার ছেঁড়াখোঁড়া অপাংক্তেয় স্যান্ডেল জোড়াটিই, যা বস্তুতপক্ষে নৈর্ব্যক্তিক ও অসার একটি বস্তু, বুঝি 'সব চেয়ে আপন, সবচেয়ে কাছের।'
এটিই এই চরিত্রের সবচেয়ে অধোগতির লক্ষণ। সবচেয়ে দুর্বলতা। তা হলো এমন একটি বস্তুকে নিজের আপন করে নেওয়া বা আপন মনে ভাবা, যে কোনো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারে না, যার কোনো প্রতিবাদ নেই। যে নায়কের চরিত্রের চেয়েও বেশি দুর্বল, বেশি অসহায়।
এই বইটির নাম 'ভাল মানুষের জগৎ'। মানব জীবনের অভিনব এক গল্প। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ভালো মানুষেরা ব্যবহূত হয়ে থাকে। তাদেরই প্রিয়জনদের হাতে। কখনও বা বাইরের জগতের মানুষের কাছেও। ভালো মানুষেরা সবই বোঝে, সব জানে, কিন্তু জেনেবুঝেও তারা ভালো মানুষের মতোই থেকে যায়। তাদের কোনো বিদ্রোহ নেই, কোনো প্রতিবাদ নেই, সতর্কতা আছে কিন্তু কোনো আদিষ্ট লক্ষ্যে তা পরিচালিত হয় না। তাদের এই ভালো মানুষজনিত অপারগতাই সংসারে তাদের বিদ্রুপের বা উপহাসের পাত্র করে তোলে। যে গৃহিণী সুন্দরী কাজের মেয়ের হাতে স্বামীকে ছেড়ে দিয়ে বাপের বাড়ি যায়, যার মনে বিন্দুমাত্র স্বামী সম্পর্কে সন্দেহ হয় না, সত্যি বলতে এটি গৃহিণীর তরফ থেকে স্বামীর প্রতি তাচ্ছিল্য ছাড়া তো আর কিছুই নয়। স্বামীর পুরুষত্বের প্রতি অবমাননা ছাড়া আর কিছু নয়। তবু ভালো মানুষেরা সেই বাড়িতেই গৃহিণী ছাড়া ফিরে যায়। একসময় তারা ফিরে যেতে চায় তাদের বাল্যের নিষ্পাপ জগতে, যে জগতে মা আছে, অকৃত্রিম ভালোবাসা আছে, কিন্তু সেখানেও আর ফিরতে পারে না। কারণ, যাদের কাছে ফিরবে, তারাও চায় না সে ফিরুক।
এই বইয়ের প্রথম গল্পটির নাম হচ্ছে 'সীমান্তে'। বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী কন্যার দেশে ফেরার বৃত্তান্ত। গল্পটি আমাদের বাংলাদেশের সাহিত্যে অপূর্ব একটি সংযোজন। একদা আদর্শবান মেয়েটি, বাংলার নাড়ি ছিঁড়ে বেরোনো মেয়েটি ক্রমে ক্রমে পাশ্চাত্য সমাজের জলবায়ু, আবহাওয়া, বিদেশি স্বামী ও সন্তানের ভেতর দিয়ে বিদেশের মাটিকেই আপন বলে আঁকড়ে ধরে রাখা এবং দেশের মাটিতে ফিরে আসবার ভয়, অসুস্থ হবার ভয়, এবং শেষমেশ টিকিট করেও দেশে ফিরে না আসা, মাঝপথ পর্যন্ত দেশে এসে আবার স্বস্থানে ফিরে যাওয়া অর্থাৎ বিদেশ- অপূর্ব এপিক একটি গল্প। এখানেও আছে বাস্তবতার সঙ্গে আপস করে নেওয়া অতি সহজেই এক জীবনের গল্প। বস্তুত বিদেশে পা রাখা কোনো সন্তানই অবশেষে দেশে ফেরে না, এর মূলে আর যাই থাক, বিদেশের রাষ্ট্রকাঠামো এবং তাদের সমাজের খোলামেলা জীবনযাপনের স্বাচ্ছন্দ্য যে মানুষকে আকৃষ্ট করে এতে করে কোনো সন্দেহ নেই, বিশেষ করে সেইসব মানুষ, যারা আমাদের মতো দেশ থেকে সেখানে প্রথম পা রাখে। বরং পাশ্চাত্যের মানুষেরা এসে আমাদের দেশে স্থায়ী হতে পারে, কিন্তু প্রাচ্যের মানুষের পক্ষে পাশ্চাত্যের আপাত স্বচ্ছ জীবন ছেড়ে নিজ দেশে ফিরে আসা কঠিন।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর পুরো বইটির মনোজগতজুড়েই এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করে গেছে। ফলে তাঁর সমগ্র গল্পমালাতে এক ধরনের মনোবেদনা, ইংরেজিতে যাকে বলে প্যাথোজ, কাজ করে গেছে। আমরা যারা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে তাঁর অসংখ্য লেখার মাধ্যমে চিনি ও জানি, আমাদের কাছে লেখকই যেন বারবার গল্পগুলোর মাধ্যমে ধরা দেন। আপসহীন মনোভাব নিয়েও আপসের বেড়াজালে তার চরিত্ররা নিজেদের আবদ্ধ দেখতে পায়। এর একটি কারণ হয়তো এককালে আমরাও তাঁর গল্পের আদর্শবান নায়কদের মতোই ছিলাম, কিন্তু বাস্তবের নিষ্ঠুর কশাঘাত আমাদের সকলকেই প্রায় বিচ্যুত করেছে।
তাঁর গল্পের ভাষা অত্যন্ত সাবলীল, সূক্ষ্ণ এবং চিন্তা-চেতনায় গভীরতা ধারণকারী।
কথাসাহিত্যিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর গল্প লেখার এখানেই সার্থকতা যে এই লেখাগুলো হয় আমাদের সমাজেরই দর্পণ, যেখানে মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত তাদের মুখ দেখতে পায়।
লেখকের জন্মদিনে তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করে আমার মতো সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধার্ঘ্য।
এই সঙ্গে আমরা স্মরণ করি লেখকপত্নী নাজমা জেসমিন চৌধুরীকেও, যাঁর সান্নিধ্যে কেটেছে লেখকের দীর্ঘ ও সুখী দাম্পত্য জীবন।
মন্তব্য করুন