'আমি বুঝি না, তোমার কি একবারও ইচ্ছে হয় না যে তুমিও বন্ধুদের মতো গোল্ড মেডেল জিতে নাও?' পড়ার টেবিলে মুখ গুজে চুপচাপ আম্মুর বকা শুনছিল শায়েরী। সে বুঝতে পারছে না, কেন সবাইকে পরীক্ষায় গোল্ড মেডেল পেতেই হবে? সবাই যদি ফার্স্ট হয়ে যায় তবে লাস্ট কে হবে? সে তো চাইলেই পারে, ফার্স্ট হতে। ইচ্ছে করেই তো কম পড়াশোনা করছে। সে যদি কম নম্বর না পেত, তবে টিচাররা বুঝত কী করে কে ভালো ছাত্র-ছাত্রী? এর আগে এসব দার্শনিক কথা বলে আম্মুর বকুনি খেয়েছিল। তাই আজ আর ওসব নিয়ে মুখ খুলল না।

শায়েরী শহরের নামি এক স্কুলের প্রথম শ্রেণির ছাত্রী। ওদের 'পার্ল' গ্রুপে মোট ২৪ জন শিক্ষার্থী। প্রতি বৃহস্পতিবার ক্লাস টেস্ট হয়। রিপোর্ট কার্ডে ওই টেস্টের নম্বর ওঠে নিয়মিত। সোমবার ফলাফল প্রকাশের পর প্রথম স্থান অর্জনকারীকে দেওয়া হয় গোল্ড মেডেল। তবে মেডেলটি ওই শিক্ষার্থী কেবল একদিনের জন্য বাসায় নিতে পারে। পরদিন মঙ্গলবার রিপোর্ট কার্ডসহ মেডেল মিসের কাছে জমা দিয়ে দিতে হয়। তারপরের বৃহস্পতিবার ফের পরীক্ষা নেওয়া হয়। আবার রেজাল্ট ঘোষণার পর প্রথম স্থান অর্জনকারীকে সেই একই মেডেল পরিয়ে দেওয়া হয়।

প্রতি বৃহস্পতিবারেই ছোটরা মেডেল পরে বাসায় গিয়ে ছবি তুলে ওয়াশ করে নিয়ে আসে। মিস আবার দেয়ালে ঝুলানো বোর্ডে পিন দিয়ে সেই ছবি টানিয়ে দেয়। দেখতে ভালোই লাগে! ক্লাসের সবাই চায়, অমন মেডেলসহ তারও ছবি দেয়ালে ঝুলুক। কেবল শায়েরীর ক্ষেত্রেই কেন যেন সবকিছুতে অনীহা। পরের সপ্তাহের বুধবারে পার্থর সঙ্গে গল্প করতে গিয়ে পরীক্ষার সিলেবাস নোটবুকে তুলে আনতে ভুলে গেল মেয়েটি। বাসায় ফিরে আম্মুর কাছে এর জন্য বকুনি খেলো। তাতে শায়েরীর বয়েই গেছে! ক্লাস ওয়ানে পড়ে সে। যথেষ্ট বড়ো হয়েছে। এখন আর বকা খেয়ে কান্নাকাটি করার বয়স নেই। যেহেতু সিলেবাস জানে না, সেহেতু পড়ার তাগাদাও ছিল না। শুধু মনে আছে ফল-ফুলের নাম মিস লিখে নিতে বলছেন। আম্মু ওকে তাই বইয়ের সব ফল আর ফুলের নাম বাংলা এবং ইংরেজিতে মুখস্থ করিয়েছেন।

পরদিন সকালে ক্লাসে এসে কী মনে করে মিসের ঠিক সামনে গিয়ে বসল শায়েরী। একদম মুখোমুখি থাকায় অন্যদের কী প্রশ্ন করছে, সব সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল। ভাগ্যক্রমে ওর রোল নাম্বার শেষের দিকে হওয়ায়, অন্য সবার পরীক্ষার পড়া শুনতে শুনতে ক্লাসেই সব মাথায় গেঁথে গেল।

'মিম্মি, বলো তো, আমাদের জাতীয় ফুলের নাম কী?' 'শাপলা।'

'উহু, হলো না। বলবে, আমাদের জাতীয় ফুলের নাম শাপলা। কেমন?' 'ওকে মিস।'

'রাহাত, বলো তো আমাদের জাতীয় পশুর নাম কী?' 'আমাদের জাতীয় পশুর নাম টাইগার।' 'না, না। বলবে, আমাদের জাতীয় পশুর নাম রয়েল বেঙ্গল টাইগার।'

এভাবে সবার পরীক্ষা শেষে শায়েরীর পালা এলো। ওকে যা-ই জিজ্ঞেস করল, তারই সে সঠিক উত্তর দিল; যেমনটা মিস এতোক্ষণ শুনতে চেয়েছেন।

'শায়েরী, আমাদের জাতীয় পাখির নাম কী?'

'মিস, আমাদের জাতীয় পাখির নাম দোয়েল।'

'ভেরি গুড!' ভীষণ খুশি হয়ে গেলেন মিস।

পরের সপ্তাহে সোমবার রেজাল্ট দিতে গিয়ে দেখা গেল, ফার্স্ট হয়েছে শায়েরী! যে কিনা নোটবুকে পরীক্ষার সিলেবাসই তোলেনি সেদিন, প্রস্তুতিতেও ছিল লবডংকা; সে না কি বুদ্ধি খাটিয়ে দিব্যি প্রথম স্থান দখল করে বসে আছে! তার মানে শায়েরী এবারের গোল্ড মেডেলটা বাসায় নেবে? ইয়াহু! মনে মনে লাফিয়ে উঠল সে। নিজের জন্য না, আম্মুর জন্য হলেও একবার অন্তত মেডেল পাওয়া উচিত, ভাবল শায়েরী। নাশ্বা মিস এসে মেডেলটা যত্ন করে শায়েরীর গলায় পরিয়ে দিয়ে বলেন, 'এ সপ্তাহে আমাদের গোল্ড মেডেল বিজয়ী শায়েরী। তবে দুঃখের বিষয়, আগামীকাল সরকারি ছুটির কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় মেডেলটি সে বাসায় নিতে পারছে না। লাস্ট পিরিয়ডের ঘণ্টা বাজলেই আবার আমায় এটা ফেরত দিয়ে দিতে হবে। কেমন?'

শেষ বাক্যটা তিনি শায়েরীর দিকে তাকিয়ে বললেন। এতোক্ষণের মুহুর্মুহু আনন্দ নিমিষে উধাও হয়ে গেল যেন। শায়েরীর মুখ হুট করে মলিন হয়ে গেল। সে স্কুল ভ্যানে যাতায়াত করে। ওর আম্মু ব্যাংকার হওয়ায়, আর দশজন শিক্ষার্থীর গার্জিয়ানের মতো স্কুল ছুটির পর নিতে আসতে পারেন না।

ইশ! আগে যদি জানা থাকত, সে ফার্স্ট হবে; তাহলে অন্তত আম্মুকে আজ ছুটির সময় স্কুলে আসতে বলা যেত। আম্মু নিশ্চয়ই আসতেন। তার কন্যা একবারের জন্য হলেও বুদ্ধি খাটিয়ে পরীক্ষায় গোল্ড মেডেল জিতে নিয়েছে- এই সুন্দর দৃশ্য তার স্বচক্ষে অবলোকন করা দরকার ছিল। 'মন খারাপ করো না শায়েরী। আমার মোবাইল দিয়ে মেডেলসহ তোমার একটা ছবি তুলে দিচ্ছি। এটাই তোমার আম্মু-আব্বুকে দেখিও, কেমন?'

বাহ! নাশ্বা মিস দেখি ঠিকই বুঝতে পেরেছেন ওর কষ্টটা। এই কথা শুনে তার সব কষ্ট যেন দূর হয়ে গেল। হাত দিয়ে টুক করে মুছে নিল চোখের কোণে জমে থাকা জল। ছবি তোলার জন্য হাসিমুখে দাঁড়াল শায়েরী।