কভিড-১৯ মহামারি সৃষ্ট স্বাস্থ্য ও সাপ্লাই চেইন সংকট স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার আগেই মূল্যস্ফীতি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সারাবিশ্বেই অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাড়িয়ে দিয়েছে। এই দ্বৈত সংকট বাংলাদেশের বর্ধিত চলতি হিসাবে ঘাটতি, রেমিট্যান্সে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির চাপ, মার্কিন ডলারের বিনিময় হারের ওপর চাপ এবং আমদানির জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপসহ বহুবিধ অর্থনৈতিক চাপের সৃষ্টি করেছে। এমন অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে সরকার গত ৯ জুন জাতীয় বাজেট ঘোষণা করে।

২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট এমন এক সময়ে পেশ করা হয়েছে, যখন বাংলাদেশে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানোর গুরুত্ব অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। কভিড থেকে পুনরুদ্ধারের ধারা বজায় রাখা, কর্মসংস্থান ও আয়ের জন্য বিদেশি ও স্থানীয় বিনিয়োগ, রপ্তানি বাড়ানো এবং রপ্তানি বৈচিত্র্য, মূল্যস্ফীতির চাপ, চলতি হিসাবে ঘাটতি, বিনিয়োগ হ্রাস এবং এলডিসি-পরবর্তী পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত হওয়ার এবং চলমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমি এ লেখায় বেসরকারি খাতের ওপর এবারের বাজেটে কী প্রভাব ফেলতে পারে তার পর্যালোচনা তুলে ধরছি।

বিনিয়োগ ও বাণিজ্য :সরকার বাজেটে করের হার যৌক্তিকীকরণ এবং ব্যবসায়িক কর ব্যবস্থা উন্নত করার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। সব ধরনের কোম্পানির ক্ষেত্রে কর কমানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে ঋণের সুদের ওপর আয়করে কোনো মওকুফ নেই। ঋণ পরিশোধের অনিয়ম মোকাবিলায় এটি কার্যকর হবে।

ব্যবসার ওপর করের বোঝা বাড়াতে পারে এমন বেশ কয়েকটি প্রস্তাব অর্থবিলে রয়েছে। যেমন- সরকারি সিকিউরিটিজ থেকে লাভ আর করমুক্ত নয়। এতে করের দায় বাড়বে। স্পেশাল রিজার্ভে স্থানান্তর আর অনুমোদিত খরচে তালিকাভুক্ত থাকবে না, যার কারণে স্পেশাল রিজার্ভে স্থানান্তরের কার্যকর করের হার বেড়ে ৩৯.০৬%-এ দাঁড়াবে। ট্রান্সপোর্ট এবং ইন্টারনেট পরিষেবায় উৎসে কর কর্তন বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিবহন এবং ডিজিটাল উভয় ক্ষেত্রেই সামগ্রিক সংযোগের খরচ বাড়বে।

ট্যাক্স কমপ্লায়েন্সের বিষয়ে এমন অনেক ব্যবস্থা রয়েছে, যা বর্তমানের কঠিন কমপ্লায়েন্সকে আরও জটিল করে তুলবে। এর মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে রিটার্ন জমা দেওয়ার আবশ্যকতা আরোপ করা হয়েছে, যেখানে আগে ই-টিআইএন জমা দেওয়াই যথেষ্ট ছিল। উপরন্তু কোম্পানিগুলোকে বছরে ১০ লাখ টাকার বেশি ব্যাংক ক্রেডিট ব্যালান্সের জন্য রিটার্ন জমা দেওয়ার প্রমাণ জমা দিতে হবে। এটি কোম্পানিগুলোর ব্যাংকিং ডিপোজিট নিরুৎসাহিত করতে পারে। ফেসবুক, গুগল, টুইটার এবং অ্যামাজনের মতো বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল পরিষেবা প্রদানকারীদের জন্য ট্যাক্স রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যা এ অঞ্চলে বাংলাদেশের ডিজিটাল হাব হওয়ার সম্ভাবনা কমিয়ে দেবে।

বাজেটে কর কর্মকর্তাদের ঐচ্ছিক কর্তৃত্ব এবং দেশে রাজস্ব ব্যবস্থার উন্নতির জন্য দীর্ঘদিনের বাধা সম্পর্কিত বিষয়গুলো আরও জটিল করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর কর্মকর্তারা তাঁদের কাজে সহায়তা না করলে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবেন। বকেয়া ট্যাক্স পরিশোধ করা না হলে নোটিশের তারিখ থেকে ২১ দিনের মধ্যে ইউটিলিটি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা যেতে পারে। আইনের এ পরিবর্তনে বেসরকারি খাতে হয়রানির আশঙ্কা বাড়ল।

নতুন বাজেটে অধিগ্রহণের (অ্যামালগ্যামেশন) ক্ষেত্রে আইনের বিধান সহজ করা হয়েছে। শেয়ারের মাধ্যমে প্রাপ্ত বিষয়াবলির ওপর কর ছাড় দেওয়া হয়েছে এবং পদত্যাগ করা শেয়ারহোল্ডারদের অর্থের বিনিময়ে প্রাপ্ত বিষয়াবলি এখন করযোগ্য। এ পরিবর্তনগুলোকে শেয়ার ট্রান্সফারের মাধ্যমে বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং একত্রকরণ উৎসাহিত করবে। যদিও বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নয়নের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেমন প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা, আইনি এবং প্রশাসনিক সংস্কার, লজিস্টিক অবকাঠামোর উন্নতি এবং পূর্ব এশিয়া এবং অন্যত্র বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্যবসার সম্ভাব্য স্থানান্তরকে কেন্দ্র করে লক্ষ্যভিত্তিক দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ উন্নয়ন ও প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে বাজেট তেমন সরব নয়।

রপ্তানি: রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য করপোরেট কর কমানো হয়েছে। তৈরি পোশাকবহির্ভূত শিল্পে পোশাকের মতো একই করহার (১২ বা ১০%) করা হয়েছে। এ সুযোগ আয়কর অধ্যাদেশের বিধান এবং পরিবেশগত নীতিগুলোর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। তৈরি পোশাকের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পের জন্য কর কমিয়ে ১৫% করা হয়েছে। এটি এলডিসি উত্তরণের পর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পকে আরও সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করবে। সমুদ্রগামী জাহাজে কর ছাড় দেওয়া হয়েছে, যা এ শিল্পে বিনিয়োগ উৎসাহিত করবে। কিন্তু কিছু ব্যবস্থা রপ্তানিকারকদের করের বোঝা বাড়িয়ে দিয়েছে। উৎসে কর সংগ্রহের হার ১% করা এবং নূ্যনতম করের ক্ষেত্রে টিডিএস হার বাড়ানো হয়েছে। এতে কার্যকর করের হার বাড়বে। ফলে করপোরেট করহার হ্রাসের ইতিবাচক প্রভাব কমাবে।

উদ্ভাবন এবং প্রযুক্তি: স্টার্টআপ স্যান্ডবক্স সুবিধার আওতায় নতুন উদ্যোক্তারা ক্রমাগত ৯ বছর পর্যন্ত তাঁদের লোকসান দেখাতে পারবেন। এটি উদ্ভাবন, উন্নয়ন এবং প্রযুক্তি এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি দ্বারা চালিত নতুন পণ্য, প্রক্রিয়া বা পরিষেবাগুলোর স্থাপনা বা বাণিজ্যিকীকরণের দিকে প্রচেষ্টাকে সহায়তা করবে। স্টার্টআপে বিদেশি বিনিয়োগ উৎসাহিত করবে। কোনো সেবা বা রাজস্ব বণ্টনের জন্য বাংলাদেশে পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর নূ্যনতম কর আরোপ করা হয়েছে। এটি ফ্রিল্যান্সার এবং আউটসোর্সিং এজেন্সির ওপর কর বাড়াবে।

ক্ষুদ্র ও মাঝারিশিল্প: ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা এখন প্রাপ্ত পরিষেবার ওপর ইনপুট ট্যাক্স প্রয়োগ করতে পারবেন। এতে তাঁদের খরচ কমবে। উপরন্তু উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে কিন্তু ট্রেডিং পর্যায়ে প্রযোজ্য রয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারিশিল্প এখনও কভিড মহামারির প্রভাব থেকে পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়াতে রয়েছে এবং তাদের প্রবৃদ্ধি ও সহায়তায় সরকারের পক্ষ থেকে বাড়তি প্রচেষ্টা প্রয়োজন। ২১ দিনের মধ্যে ইউটিলিটির পরিষেবার অর্থ পরিশোধনে ব্যর্থ হলে, ই-টিআইএন সার্টিফিকেট গ্রহণ না করলে এবং রিটার্নের প্রমাণ জমা দিতে ব্যর্থ হলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে ট্যাক্স কমপ্লায়েন্স জটিলতা বাড়ানো, উচ্চতর উৎসে কর কর্তন এবং সামগ্রিকভাবে কর কর্তৃপক্ষের ঐচ্ছিক ক্ষমতা বৃদ্ধি দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ওপর বোঝা আরও বাড়িয়ে দেবে।

শেষ কথা: সামগ্রিকভাবে এবারের বাজেটে ব্যবসাবান্ধব বেশ কিছু পদক্ষেপ রয়েছে। কিন্তু এর একটা বড় অংশ বৃহৎ ব্যবসায় জন্য সুবিধাজনক হলেও এসএমই বিকাশে এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, রপ্তানি পণ্য ও বাজার বৈচিত্র্যকরণ এবং উৎপাদনশীলতা বাড়াতে প্রযুক্তি এবং দক্ষতা উন্নয়নে এবারের বাজেটে আরও বেশি কিছু থাকা প্রয়োজন ছিল। এর সঙ্গে বেশ কিছু প্রস্তাব, যা কর ব্যবস্থাকে আরও জটিল করে তুলবে সেগুলো পুনর্বিবেচনা করা বেসরকারি খাতের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।