নানামুখী চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়ে গতকাল ১ জুলাই ২০২২-২৩ অর্থবছর শুরু হলো। নতুন এ অর্থবছরে অর্থনীতিতে সম্ভাবনার চেয়ে চ্যালেঞ্জই বেশি। এমন সময়ে নতুন অর্থবছর শুরু হলো যখন মূল্যস্ফীতির চাপ গত আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। দেশীয় মুদ্রা টাকা নিত্যদিন মান হারাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমে আসছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি, খাদ্য ও শিল্পপণ্যের দাম বাড়ছে। আবার রপ্তানি বাজারেও চাহিদা কিছুটা কমছে। কমেছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। পুনরায় বাড়তে শুরু করেছে করোনার প্রকোপ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের বন্যার ক্ষয়ক্ষতি, যা অভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদন ও যোগাযোগ অবকাঠামোকে বড় ধাক্কা দিয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ উস্কে দিচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এ যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী পণ্য সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে নির্দিষ্ট কিছু বাজারে যেতে বাধ্য হচ্ছেন বিশ্বের ক্রেতারা। যে কারণে দাম বেড়ে যাচ্ছে। এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে সম্ভাবনাও আছে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালুর মাধ্যমে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলেছে। গতিশীল হচ্ছে পণ্য সরবরাহ। আশা করা হচ্ছে এতে ব্যবসা ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে আঞ্চলিক বৈষম্য কমে আসবে। এ ছাড়া মেট্রোরেল, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে। গড়ে উঠছে নতুন নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল। এসব অঞ্চল চালুর মাধ্যমে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়বে। বিদায়ী অর্থবছরে দেশে শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি বেড়েছে। এতে নতুন শিল্প বা শিল্প খাতের সম্প্রসারণ ও কর্মসংস্থানেরও আশা করা হচ্ছে। বাজেটে দেশীয় শিল্পের বিকাশে নানা প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে, যা অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তাঁর বাজেট বক্তৃতায়ও চ্যালেঞ্জের কথা স্বীকার করেছেন। তিনি নতুন অর্থবছরে ছয়টি বিষয়কে প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে চিহ্নিত করেছেন। যেসব বিষয়কে অর্থমন্ত্রী চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন তার মধ্যে অন্যতম হলো মূল্যস্টম্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা এবং অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বাড়ানো। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় এসব খাতে বাড়তি যে ভর্তুকি দিতে হবে সেই অর্থের ব্যবস্থা করতে হবে। বৈদেশিক সহায়তার অর্থ ব্যবহার এবং মন্ত্রণালয়ের উচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পগুলো নির্ধারিত সময়ে শেষ করার চ্যালেঞ্জ রয়েছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্প যথাসময়ে বাস্তবায়ন এবং অভ্যন্তরীণ মূল্য সংযোজন কর সংগ্রহের পরিমাণ এবং ব্যক্তি আয়করদাতার সংখ্যা বাড়ানো এবং টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল ও বৈদেশিক মুদ্রার মজুত সন্তোষজনক পর্যায়ে রাখার চ্যালেঞ্জের কথা তিনি বলেছেন। একই সঙ্গে বলেছেন, এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অত্যন্ত কৌশলী হতে হবে। কোনো একটি সমস্যা সঠিকভাবে সমাধান করা না গেলে তা সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করতে পারে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের বিক্রয়মূল্য পর্যায়ক্রমে ও স্বল্প আকারে সমন্বয় করার পরিকল্পনা নিয়েছে। রাজস্ব আহরণ কার্যক্রম জোরদার করার লক্ষ্যে কর সংগ্রহে অটোমেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে। মূল্য সংযোজন কর ও আয়করের আওতা বাড়ানো হবে। বিলাসী ও অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিরুৎসাহিত করা হবে। মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার প্রতিযোগিতামূলক রাখা হবে।

এমন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে গত ২৯ জুন অর্থবিল পাসের আগে দেওয়া বক্তৃতায় পুরো জাতিকে মিতব্যয়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সবাইকে সঞ্চয়ী হতে হবে। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি বিলাস পণ্যের ব্যবহার পরিহার করতে হবে।

বাড়তি মূল্যস্ফীতির কারণে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের জীবিকার সংকট বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষত চাল, ডাল, আটা, ভোজ্যতেল, তরিতরকারি, মাছ-মাংসের দাম এবং যাতায়াত খরচ, বাসা ভাড়া, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যয় যেভাবে বেড়েছে, তাতে অনেকের দৈনন্দিন খরচ চালানো কঠিন হয়ে উঠছে। আবার বন্যার কারণে বৃহত্তর সিলেট ও উত্তরাঞ্চলের অন্যান্য জেলায় কৃষি উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক মানুষের বাড়িঘর, গবাদি পশু, ঘরে জমানো খাবার নষ্ট হয়েছে। এসব অঞ্চলের মানুষের আয় ও উৎপাদন কর্মকাণ্ড বাড়ানোও নতুনভাবে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। নতুন করে করোনার প্রকোপ বাড়ছে। মহামারির এই নতুন ঢেউয়ের সঙ্গে মানুষ ঠিকমতো খাপ খাওয়াতে না পারলে সংকট আরও তীব্র হবে।

আলোচনা চলছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো নিয়ে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে এসব পণ্যের দাম বেড়েছে। ফলে বাড়তি খরচ হচ্ছে। বাড়তি খরচের কিছু অংশ দাম বাড়িয়ে সমন্বয় করা হবে। কিছু সরকার ভর্তুকি দেবে। কোন সময়ে এই দাম বাড়ানো হবে তার ওপর নির্ভর করছে জনজীবনে এর প্রভাব।

দুর্গতির বছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনও বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। এই অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক যে পরিস্থিতি তাতে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হওয়া বেশ কঠিন। এতে সরকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ঠিকমতো ব্যয় করতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিণতি কী দাঁড়াবে তা এখনই অনুমান করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে এই যুদ্ধ প্রলম্বিত হলে বিশ্ববাজারে অস্থিরতা যে বাড়বে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। ইতোমধ্যে যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ, গম, ভুট্টা, ভোজ্যতেলের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। এসব পণ্যে বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর। অন্যদিকে বাড়তি আমদানি ব্যয় মেটাতে গিয়ে ডলার সংকট তৈরি হয়েছে। গত অর্থবছরে স্থানীয় মুদ্রা টাকা প্রায় ১০ শতাংশ দর হারিয়েছে। ৯ মাসের ব্যবধানে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমে গেছে প্রায় ৭০০ কোটি ডলার। আগামীতে আরও কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

তবে পদ্মা সেতু দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এ সেতু চালুর ফলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় পণ্য সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। অন্যদিকে দ্রুত ওই অঞ্চলের পর্যটন খাত বিকশিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিশেষ করে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, সুন্দরবন, বাগেরহাট, যশোর এলাকার পর্যটন বাড়বে। এতে পরিবহন, রেস্তোরাঁ, রিসোর্ট ও অন্যান্য সেবা খাতের সম্প্রসারণের মাধ্যমে মানুষের আয় ও কাজের সুযোগ বাড়বে।

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন সমকালকে বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা নতুন অর্থবছরের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে যাদের জন্য মূল্যস্ফীতি জীবিকার সংকট তৈরি করবে। নতুন বাজেটের প্রতি ৮ টাকায় ১ টাকা ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এ ভর্তুকি যদি বিদ্যুৎ, জ্বালানির বাড়তি মূল্য সমন্বয়ে ব্যবহার করা হয়, তাহলে ভালো। নতুবা ভর্তুকির কারণেও মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে। এ ছাড়া ডলার সংকট আরেকটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ। বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে সরকার কিছু পণ্য আমদানিতে শুল্ক্ক বাড়িয়েছে। এতে এসব পণ্যের আমদানি কমলেও দেশে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। এ জন্য সরকারকে জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ নয় এবং বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হবে এমন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন স্থগিত বা ধীরে করতে হবে। দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ যাতে সমস্যায় না পড়ে সে জন্য সরকারকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ব্যয় বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু নতুন অর্থবছরের জন্য ব্যাপক সম্ভাবনা নিয়ে আসছে। কারণ এই সেতুর ফলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ পুরো দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাড়বে পর্যটনসহ অন্যান্য সেবা খাতের কর্মকাণ্ড। এ ছাড়া চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে পারলে অনেক সম্ভাবনা উঠে আসবে।