- ফিচার
- গর্ভকালে নারীর শরীর ও মন
গর্ভকালে নারীর শরীর ও মন

গর্ভধারণ একজন নারীর জীবনে স্বাভাবিক একটি বিষয়। তবে এ সময়ে শরীর-মনে আসে বিভিন্ন পরিবর্তন। এ বিশেষ সময়টিতে একজন অন্তঃসত্ত্বার এ পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে পরিবার-কর্মস্থল-সমাজের সচেতন ও সংবেদনশীল হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ নিয়ে লিখেছেন সানজিদা আহমেদ
দীপ্তি সরকার, গৃহিণী। সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। চার মাসের পর থেকেই তাঁর পেট বড় হতে শুরু করেছে। ওজন বাড়ছে প্রতিদিন। ইদানীং রাতে ঘুমাতে পারছেন না। ওজনের কারণে পিঠে ব্যথা করে। এ ছাড়া বারবার টয়লেটে যেতে হয়। তাঁর কখনোই ডায়াবেটিস ছিল না। এখন তাঁকে ইনসুলিন নিতে হচ্ছে। এ ছাড়া মাথাব্যথা নিত্যদিনের অসুখ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তামান্না নূর, একটি বেসরকারি সংস্থায় প্রোগ্রাম অফিসার পদে কাজ করছেন। এই অফিসে যোগদান করেছেন সাত মাস হলো। তাঁর স্বামী ঢাকায় চাকরি করেন। কাজের ক্ষেত্রে সব সময়ই তামান্না অনেক বেশি আন্তরিক এবং দক্ষ। কিছুদিন ধরে তামান্না অসুস্থ অনুভব করছেন। খেতে পারছেন না। শরীরও অনেক দুর্বল। চিকিৎসকের কাছে গিয়ে নিশ্চিত হলেন তিনি সন্তানসম্ভবা। গর্ভধারণের নিশ্চিত খবর পাওয়ার পর থেকেই নানা ধরনের অনুভূতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। চাপ, উদ্বেগ, বিস্মিত বা ভৌতিক অনুভূতি হয় তাঁর। এত বড় দায়িত্ব পালন করতে পারবেন কিনা, এটি নিয়ে সবসময় শঙ্কায় থাকেন। গর্ভধারণের বিষয়টি অফিস কীভাবে গ্রহণ করবে, সেটিও ভাবছেন প্রতিনিয়ত। তাঁর অনেক বেশি মুড সুইয়িং হচ্ছে ইদানীং, কখনও নিজেকে অপরাধীও ভাবছেন।
গর্ভধারণ একজন নারীর জীবনে বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসে। সেটি শারীরিক এবং মানসিক উভয় ক্ষেত্রে। শারীরিক বিষয়গুলো দৃশ্যমান হলেও মানসিক বিষয়গুলো অনেক সময় অজানাই থেকে যায়। গর্ভাবস্থায় নারীরা নানা ধরনের দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকেন। বিশেষ করে যাঁরা গর্ভধারণ জীবনের বড় পরিবর্তনের মধ্যে অন্যতম। তাই এই সময়ে মানসিক চাপ একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া।
এ প্রসঙ্গে মুজিব শতবর্ষ স্বাস্থ্য গবেষণায় অনুদানপ্রাপ্ত আইসিডিডিআর,বির প্রকল্প গবেষণা ব্যবস্থাপক শাহরিয়া হাফিজ বলেন, 'গর্ভকালে একজন নারীর শরীর ও মনে নানা ধরনের পরিবর্তন আসতে থাকে। গর্ভাবস্থায় নারীর শরীরে যে পরিবর্তন আসে, এর পেছনে রয়েছে অ্যাস্ট্রোজেন এবং প্রজেস্টেরন নামে দুটি হরমোন। একদম শুরু থেকেই প্রথম তিন মাস বাহ্যিক পরিবর্তন বোঝা যায় না। বমি বমি ভাব অনেক অন্তঃসত্ত্বা নারী শুরুতে অনুভব করেন, বিশেষ করে সকালের দিকে।
এ জন্য খেতে পারেন না। সবার ক্ষেত্রেই যেটি ঘটে সেটি হলো, শরীর ভারী হয়ে যাওয়া। প্রতি মাসে দুই কেজি পর্যন্ত ওজন বৃদ্ধি অথবা পুরো অন্তঃসত্ত্বার সময়ে ১৫ কেজি পর্যন্ত ওজন বৃদ্ধি পাওয়া তাঁদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক বলে মনে করা হয়। গর্ভাবস্থায় নারীর শরীরের হাড়ের সংযোগস্থল ঢিলা হয়ে যায়। হাড়ের সংযোগস্থলে ব্যথা হয়। পেট ভারী বা শরীরের সামনের অংশ বেড়ে যাওয়ার কারণে পিঠের হাড়ে চাপ তৈরি হয়। পিঠে ব্যথা হতে পারে।'
তিনি আরও বলেন, 'অন্তঃসত্ত্বা নারীদের অনেক সময় রক্তে চিনির পরিমাণ বেড়ে যায়, যাকে বলে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস। বেশিরভাগ সময় সন্তান প্রসবের পর এটি চলে যায়। দাঁতের মাড়ি ফুলে যাওয়া, ব্রাশ করার সময় রক্ত বের হওয়া, মাড়িতে ব্যথা হতে পারে। জরায়ুর আকার বড় হয়ে যাওয়ার কারণে মূত্রথলিতে চাপ পড়ে। তাই বারবার প্রস্রাব হয়। জরায়ুর আকার বেড়ে যাওয়ায় ফুসফুস পর্যাপ্ত প্রসারিত হতে পারে না। তাই অনেকের শ্বাসকষ্ট হতে পারে। গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কারণ শরীরে আয়রনের চাহিদা বাড়ে। এ সময় নারীর শরীরে তরল উৎপাদন বেড়ে যায়।
এতে পায়ে পানি জমে ফোলা ভাব হতে পারে। অনেকের উচ্চ রক্তচাপ হয়ে থাকে। হরমোনের কারণে স্তন আকারে বড় হতে থাকে, স্তনবৃন্তের আশপাশ আরও কালো হয়ে ওঠে। শিশুকে খাওয়ানোর জন্য স্তন প্রস্তুত হয়। অনেকে স্তনে ব্যথা অনুভব করেন। ল্যাকটোজেন হরমোন বুকের দুধ তৈরি করে। এগুলোই গর্ভাবস্থার প্রধান শারীরিক পরিবর্তন; যা সব নারীর ক্ষেত্রে একই রকম নয়। প্রসবের পর অক্সিটোসিন হরমোন জরায়ুকে সংকুচিত করে। তবে অনেক কিছুই তার আগের জায়গায় ফিরে যায় না। অনেকের ওজন, স্ট্রেস মার্কের, ডায়াবেটিসের সমস্যা রয়ে যায়। এ ছাড়া পাঁচটি বিপদ চিহ্ন রয়েছে- হঠাৎ রক্তপাত শুরু হওয়া, খিঁচুনি হওয়া, চোখে ঝাপসা দেখা বা তীব্র মাথাব্যথা হওয়া, ভীষণ জ্বর এবং বিলম্বিত প্রসব।' এ জন্য গর্ভাবস্থায় প্রথম ৩৬ সপ্তাহে নূ্যনতম প্রতি মাসে একবার এবং ৩৬ সপ্তাহের পর প্রতি সপ্তাহে একবার করে চেকআপ করানোর ওপর জোর দেন তিনি।
এসব শারীরিক পরিবর্তন নারীর মনের ওপর প্রবল চাপ তৈরি করে। এ সময় উদ্বেগ, অনিশ্চয়তা, বিষণ্ণতা, রাগ, মুড সুইয়িং বা মেজাজ বদল এ রকম অনেক কিছু ঘটে নারীর মনে। অনেকে আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে তাঁরা খুব অল্পতেই কেঁদে ফেলেন, বিরক্ত হন, রেগে যান, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়।
মেন্টাল হেলথ ফার্স্ট এইডারের মনোবিজ্ঞানী ও সোনারতরী শিশু-কিশোর সংঘের প্রতিষ্ঠাতা ফারজানা ফাতেমা (রুমী), বলেন, 'বিষণ্ণতা এবং উদ্বেগ হলো গর্ভাবস্থায় সবচেয়ে সাধারণ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, যা প্রতি ১০০ অন্তঃসত্ত্বা নারীর মধ্যে ১০ থেকে ১৫ জনের হয়ে থাকে। যদি না পরিবারে এ সময়ে নতুন মায়ের পাশে থেকে কেউ যত্ন করেন, শিশু লালন-পালনে সহায়তা করেন। বিশেষ করে এখানে বাবার ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
মনে রাখতে হবে, অন্তঃসত্ত্বার সময় এবং প্রসব-পরবর্তী সময়ে একজন মায়ের শরীরে হরমোনের পরিবর্তন হয়ে থাকে; যা তাঁর আচরণে প্রভাব ফেলে। রেগে যাওয়া, কান্নাকাটি করা, সন্তান জন্মদান জটিলতার ভয়, আতঙ্ক, অস্থিরতা, নির্ঘুম থাকা, দৈনন্দিন রুটিনের পরিবর্তন, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস, ওজন বৃদ্ধি, সন্তানের খাওয়া-ঘুম সব মিলিয়ে একজন মা আগের অবস্থানে থাকেন না। এ সময় ওই নতুন মায়ের হতে পারে হ্যালোসিনেশন বা অলীক কিছু দেখতে পারেন। যেমন- মা দেখতে পান কিংবা শুনতে পান কেউ একজন তাঁর সন্তানকে মেরে ফেলতে বলছে। এই সন্তানের জন্য তাঁর স্বামীর সঙ্গেও দূরত্ব তৈরি হচ্ছে, এ রকম দুশ্চিন্তা থেকে স্বামী অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে বলে সন্দেহ করা, এমনকি আক্রমণাত্মক আচরণও করতে পারেন। সন্তানের জন্য অশান্তি মনে করে সন্তানকে শত্রু ভাবতে শুরু করা, এমনকি মেরে ফেলার চেষ্টা করা। অনিরাপত্তাবোধ থেকে নিজেকে আঘাত করা, আত্মহত্যার চেষ্টা করাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। যাকে বলা হয়, পোস্ট পার্টাম সাইকোসিস।'
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণেই হোক বা সচেতনতার জন্যই হোক, আজকাল 'বেবি ব্লুজ' শব্দটার সঙ্গে অনেকেই পরিচিত; যা ঘটে থাকে সন্তান জন্মদানের প্রথম ২ সপ্তাহে। এই সময়টা একজন নতুন মায়ের জন্য কতই না আনন্দের; কিন্তু তারপরও কেন যেন খুব কান্না পায়, বাচ্চার একটু কান্নাতেই অপরাধবোধে ভোগা, কেমন এক দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে থেকে কেটে যায় মাতৃত্বের এই প্রথম ক'দিন। সন্তানের বয়স ২ সপ্তাহ থেকে ৩ বছর পর্যন্ত একজন মায়ের জীবনের অন্যান্য সময়ের মতো, এ সময় বিভিন্ন ধরনের মানসিক অসুস্থতা থাকতে পারে এবং তীব্রভাবে হতে পারে।
'আমি একজন ব্যর্থ মা'- এই গ্লানি ভর করে মাকে। শুরুটা হতে পারে অন্তঃসত্ত্বার সময় থেকে কিংব গর্ভধারণের আগে যদি একজন মা মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকেন এবং তাঁর সুচিকিৎসা না পান।
শিশুর স্তন্যপান ঠিকমতো হচ্ছে কিনা, তার পেট ভরেছে কিনা, সময়-অসময়ে কান্নার কারণ, সুস্বাস্থ্য, বৃদ্ধি, বিকাশ ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা সব দায়িত্ব যেন একজন মায়েরই। যদি সিজারিয়ান ডেলিভারি হয়ে থাকে সে ক্ষেত্রে একজন মায়ের যথেষ্ট যত্ন না হলে তাঁর হতে পারে ইনফেকশন কিংবা অন্যান্য রোগ। কর্মজীবী মা হলে তো সঙ্গে কাজের চাপ তাঁর উপরি পাওনা। সব মিলে একজন মায়ের ক্লান্তি, মুড ডিজঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া বা অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকে।
মজার বিষয় হলো, একজন মানুষ তাঁর জীবনের অনেক ঘটনাই ভুলে যান; কিন্তু একজন বৃদ্ধাকেও বলতে শুনবেন, 'আমার বড় মেয়ে পেটে থাকতে আমার স্বামী এই করেছিল, আমার ছোট ছেলের জন্মের সময় আমার শ্বশুর এই বলেছিলেন।' তাই একজন মায়ের অন্তঃসত্ত্বার সময়ে পরিবারের সদস্যসহ বন্ধু-শুভাকাঙ্ক্ষীদের হবু মায়ের পাশে থাকার চেষ্টা করতে হবে। প্রতিদিনের কাজে সাহায্য করা বা ছোটখাটো উপহার দেওয়া যেতে পারে। সম্ভব হলে এ সময়ে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। পুষ্টিকর খাবারের মতোই তাঁর মনের পুষ্টি ঠিক রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা জরুরি।
গর্ভধারণ একজন নারীর জীবনে স্বাভাবিক একটি বিষয়। এর মানে এই নয়, তিনি দুর্বল হয়ে পড়েন। উল্টো নিজের মধ্যে আরেকটি প্রাণ ধারণ করে তিনি আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। সেই শিশুটি এ রাষ্ট্রের সম্পত্তি। তাই এ সময়ে সহ-নাগরিকদের সহযোগিতা জরুরি।
লেখক : উন্নয়নকর্মী
মন্তব্য করুন