- ফিচার
- ছোট ছোট সুখ দুঃখ
ছোট ছোট সুখ দুঃখ

জীবন মানে ছোট ছোট সুখ-দুঃখের সমাবেশ। উৎসব সেই সমাবেশে আনন্দের রং বয়ে আনে। ঈদ সামনে রেখে তিন সুহৃদের গল্প
জান্নাতুল বাকি
গলির ভেতর তখন সবে সন্ধ্যা নেমেছে। দেয়ালে ক্ষয়ে যাওয়া ইটের গায়ে ল্যাম্পপোস্টের আলো এসে অবলীলায় হারিয়ে যাচ্ছে। গলির শেষ মাথায় পুরোনো দ্বিতল বাড়ির সামনে রিকশা থেকে নামল সোমা। সিঁড়ির বাম পাশে বড় ঘরটা গৃহকর্ত্রী মিতালীর। বারান্দা থেকে সোমাকে বললেন, টিকিট পেয়েছিস রে মা? - পেয়েছি। গুছিয়ে নে। সোমা দ্রুত গোছানো শেষ করে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। রাতে সাড়ে ৯টার গাড়ি। ঢাকা-লালমনিরহাটের বাসে সোমার পাশের সিটে এক তরুণী বসেছে। বাসের যাত্রীদের চোখেমুখে ঘরে ফেরার আনন্দ। সোমা জানালার বাইরে তাকিয়ে। বাস দ্রুত ছুটে চলেছে। জানালা দিয়ে হুড়মুড় করে বাতাস ঢুকছে, শুধু মনের জানালায় অজস্র চিন্তার ভার সোমার। অনেক বছর হয়েছে, ঈদে আপন ঘরে ফেরা হয়নি। এবার নিশ্চয়ই হবে। জীবনের অনেক সময় চলে গেছে বড্ড অবহেলায়।
বহুদিন আগে এমনি এক ঈদের সময় বাবার হাত ধরে সে ঢাকায় এসেছিল চিকিৎসার জন্য। তাকে নিয়ে মায়ের সঙ্গে বাবার কথা কাটাকাটি হয়েছিল খুব। এক রাতে বাবা তাকে এক দোকানের সামনে রেখে খাবার আনতে যান কিন্তু কেন যেন আর ফিরে আসেননি। বহু পথ ঘুরে তার আশ্রয় হয়েছিল মিতালীর ঘরে। তাঁর সন্তান নেই। সোমা তাঁর সন্তান আবার ঘরের একমাত্র কাজের মানুষ। সময় গড়ায় নিজস্ব গতিতে। অনেক দিন পর সে জানতে পারে তার বাবা মারা গেছেন। বাবার মুখটা ভেবে মাঝে মধ্যে আকাশের পানে চেয়ে থাকে। বাবা, তুমি কেন আমাকে ফেলে গিয়েছিলে বলতে পারো?
মায়েরও খোঁজ পায় সে। এই মাকে ছেড়ে আসল মায়ের খোঁজে সোমা বেরিয়েছে জেনেও সে আটকায়নি। রাতের নিস্তব্ধতার বুক বিদীর্ণ করে বাসের অডিও সিস্টেমে গান বাজে ওঠে- 'আয় খুকু আয়'।
ঈদের দিন। খুব ভোরে বাস থেকে নেমে অনেক কষ্টে পাওয়া ঠিকানায়। এক বৃদ্ধা দরজা খুললেন, একটু এগিয়ে বারান্দার আলোয় মুখটা দেখলেন। তিনি দু'হাতে সোমার মুখটা নিজের কাছে টেনে নিলেন। হুবহু তার বাবার মুখের মতো। দু'জন দু'জনকে বুকে জড়িয়ে কান্না শুরু করল। কতটা সময় জড়িয়ে ধরলে প্রাণ শান্ত হবে হয়তো তারা কেউ জানে না।
মেহেরুন নেছা রুমা
শত কষ্ট সয়ে ছুটি প্রাণপণে, সব গ্লানি নিমেষে যায় ধুয়ে- যখন গিয়ে দাঁড়াই ঘাসভরা উঠোনে, রোদের ঝিলিক দেখি মায়ের মুখপানে। এই যাত্রা ঈদের। আনন্দের আবেগের আর উচ্ছ্বাসের। বছরের যে কোনো সময় বাড়ি যাওয়ার জন্য মন কেমন করা ভাবকে শিকলে বেঁধে রেখে বলি, এই তো আর কয়েকটা দিন সবুর কর মন, ঈদ এলো বলে। প্রতিবার ঈদ শেষে ঢাকায় ফিরে বলি, 'আর ঈদে বাড়ি যাব না। অন্য সময়ে যাব!' কিন্তু এই বদলে যায় ঈদ এলেই। এমনও হয়েছে ঈদের আগের দিন চলে গিয়েছি। সীমাহীন যন্ত্রণা শেষে বাড়ি পৌঁছতে হয়েছে। যাব না, যাব না করে লঞ্চে কেবিন বুকিং করা হয়নি আগে। হুট করে যাত্রার প্ল্যান। বরিশালের সবচেয়ে বড় লঞ্চ ছিল তখন কীর্তনখোলা। এক আত্মীয় মারফত কেবিনের ভরসা পেয়ে ব্যাগপ্যাটরা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। তুমুল বৃষ্টি আর অসহনীয় যানজটে সদরঘাট যেতে সে কী বিড়ম্বনা! রিকশা থেকে নেমে হাঁটা শুরু করি। বৃষ্টিতে ভিজছি সেই খেয়ালও নেই। লঞ্চ থেকেও কল এলো। রাস্তার জটলা, বৃষ্টি, তাড়াহুড়া ইত্যাদি কারণে মোবাইল ফোনের আওয়াজ কানে পৌঁছেনি।
জনস্রোতের সঙ্গে ছুটে চলি আমরাও। লক্ষ্য সদরঘাট। অনেক যুদ্ধ শেষে ঘাটে গিয়ে দেখি লঞ্চ ছেড়ে বুড়িগঙ্গা পাড়ি দিয়ে চলে যাচ্ছে। একরাশ মন খারাপ নিয়ে বৃষ্টির জলে দুঃখ ভাসিয়ে বলি, বাড়ি যাব বলছি যাবই। কিন্তু লঞ্চ না পেয়ে এবার গাড়ি নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বাসায় এসে সন্ধ্যায় সড়কপথে রওনা দিলাম। ভাগ্যবিড়ম্বনায় ফেরিঘাটের কাছাকাছি যেতেই আমাদের গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। রাত বাড়ে, বাড়ে উৎকণ্ঠা, সেই সঙ্গে পেটের খিদে আর মনের ভয়। রাস্তার পাশে বসে রইলাম। শেষে উপায় না পেয়ে ভ্যান, অটোরিকশা, লোকাল বাস করে কোনোমতে মাওয়া ফেরিঘাট পর্যন্ত গেলাম। সেখানে দীর্ঘ অপেক্ষার পর ফেরি পার হয়ে ওপাড়ে যেতে যেতে সকাল ১০টা। বরিশাল পৌঁছি দুপুর দেড়টায়। ঈদ যে কখন ফুরিয়ে যাচ্ছে টেরও পাচ্ছি না। বরিশাল থেকে মেহেন্দীগঞ্জ যেতে তখন লঞ্চে সময় লাগে তিন-চার ঘণ্টা। বরিশাল লঞ্চঘাট পৌঁছে দেখি লঞ্চ এখনই ছেড়ে যাবে। দৌড়ে লঞ্চে উঠি। তুমুল বৃষ্টি আর দমকা বাতাসে ছোট লঞ্চটি এমনভাবে দুলছিল যেন ডুবে যাবে এখনই। সৃষ্টিকর্তাকে ডাকি আর বলি এভাবে আর বাড়ি যাব না। অবশেষে সন্ধ্যার পর গিয়ে বাড়ির উঠানে পা ফেলি।
সেই অনুভূতি প্রকাশের নয়, নিজের জন্মস্থানের মাটিতে পা ফেলতেই যেন এক অদ্ভুত শিহরণ ছুঁয়ে গেল মনে। আপনজনদের মুখখানি দেখামাত্রই মুছে গেল সব কষ্ট। হাসি আর আনন্দ-উল্লাসে মুখর হয়ে উঠল বাড়ির আঙিনা।
এবার ঈদযাত্রাকে আনন্দময় করতে যুক্ত হয়েছে এক মহাবিস্ময়। আমাদের পদ্মা সেতু। উচ্ছ্বসিত হয়ে আছি কখন পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে বাড়ি যাব। যত কষ্টই হোক না কেন ঈদ এলে মনে হয় এই শহর আমার নয়। আমার নিজস্ব আকাশ আর মাটি ডেকে বলে, আয় ফিরে মায়ের কোলে। এই ভালোবাসার হাতছানি উপেক্ষা করে কিছুতেই যেন থাকা যায় না আর।
বাহাউদ্দিন ইমরান
জমাট ঘন মেঘের ভেতর থেকে বিমানটা আরেকটু নিচে নেমে এলো। দেশের মাটি, মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা বিভিন্ন বয়সী বৃক্ষ দেখে আকবরের চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক। প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর পর দেশের মাটিতে পা। আকবরকে নিতে টার্মিনালের বাইরে অপেক্ষায় বড় ভাবি আর ভাইজি মেহনাজ। দেখা হতেই দৌড়ে প্রিয় ছোট চাচাকে জড়িয়ে ধরে মেহনাজ। এবার ফেরার পালা। মগবাজারের দিলু রোডে আকবরের বড় ভাইয়ের বাসাতেই সে দিনটি প্রায় ঘুমিয়েই কাটালেন দুবাই প্রবাসী আকবর। রাতে খাবার টেবিলে দুই ভাইয়ের দেখা। পরদিন শুক্রবার, তাদের গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার পূর্ব নির্ধারিত দিন। তার এক দিন বাদেই ঈদ। হঠাৎ সব পরিকল্পনা ভেস্তে দিলেন বড় ভাই। জানালেন, ব্যক্তিগত কিছু অসুবিধার কারণে তাঁর এবারও গ্রামে ঈদ করতে যাওয়া হচ্ছে না। আকবর কারণ জানতে চাইলে সোলায়মান কথার প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করেন। সোলায়মান আকবরের জোরাজুরিতে সায় দেন। পরদিন দুপুর গড়াতেই তাঁরা বাড়ির পথে রওনা হন।
নির্মল বাতাসে দুই পাশে সারি সারি বৃক্ষলতা পেরিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলে। মাইক্রোতে বসেই সোলায়মান তাঁর অন্য দুই ছোট ভাই আনোয়ার এবং তোফায়েলকে ফোন করেন। তাঁরাও যাত্রাপথে। বাস বিলম্ব হওয়ায় আনোয়ার তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের বাসে বসিয়ে রেখে বাসের চারপাশে রাস্তায় পায়চারি করছে বলে জানান। তোফায়েল বললেন, ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা। শিডিউল ট্রেন প্রায় এক ঘণ্টা পর গাজীপুর স্টেশন থেকে ছেড়েছে। এখনও টিকিটের সঙ্গে মিলিয়ে নিজের সিটে বসতে পারেননি তিনি। তাই নিজে দাঁড়িয়ে থেকে স্ত্রী-সন্তানকে আরেকজনের সিটে বসিয়ে রেখেছেন। এভাবে আরও কিছুপথ তাঁকে ভোগান্তির মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
সব ঝুট-ঝামেলা পেরিয়ে বাড়ির বড় উঠোনের এক কোণে এসে মাইক্রো থামল। উঠোনের আরেক কোণে চেয়ারে বসে থাকা বাবা চশমার আড়াল থেকে তাঁর সন্তানদের দেখতে পেয়ে উঠে দাঁড়াতে চাইলেন। আকবর-সোলায়মান এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরলেন। তাঁকে বসিয়ে দিয়ে মায়ের কাছে ছুটলেন। প্রায় এক বছর হতে চলল, মা বিছানা থেকে উঠে একা হাঁটতে পারেন না। তবুও সন্তানদের দেখে তিনি আধ সোয়া হয়ে বসলেন। সন্তানদের বুকে জড়িয়ে মা একগাল কেঁদে ফেললেন। সবাই পেছনে ফিরে দেখলেন, আনোয়ার দাঁড়িয়ে। ভাইদের উদ্দেশে বলতে থাকলেন, মা কি শুধু তোমাদের? জায়গা দাও আদর নিয়ে নিই। মায়ের মুখ দিয়ে হাসি আর চোখ দিয়ে কান্না একসঙ্গে গড়িয়ে পড়তে থাকল। তিনি বললেন, আমার তোফায়েল কত দূর? সন্ধ্যার কিছু পর সপরিবারে তোফায়েলও মা-বাবার কাছে ফিরলেন। মা-বাবার জন্য কেনা সবার উপহার সব ভাগাভাগি হলো, সারাদিনের ধকল মলিন হয়ে গেল। সন্তানদের সঙ্গে গল্প-আহ্লাদ করতে গিয়ে মায়ের চোখে আবারও পানি। মা-বাবাকে জড়িয়ে ধরে আনন্দ-বেদনায় চোখের কোণে জল এলো সবার।
ঈদের দিন সকাল। চারদিকে উৎসবের আমেজ। রকমারি খাবারের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে। পুরুষরা ঈদের জামাতের উদ্দেশে রওনা দিলেন। দরজার কাছে মাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন পুত্রবধূরা। সবাইকে একসঙ্গে পেয়ে মায়ের বুকে এক অজানা প্রশান্তির প্রলেপ বিরাজ করে। তিন দিন বাদেই যেন ফিকে হয়ে আসে আনন্দ, চলে যাওয়া হলো। ছোট ছেলে কিছুদিন থাকলেও বাকিদের ফিরতে হবে কর্মস্থলে। সন্তানদের মাথায় হাত বুলিয়ে বিদায় জানালেন মা। মায়ের চোখের মায়ার গভীরতা তাঁদের মনে স্মৃতির বিচ্ছুরণ ঘটাতে লাগল। শত শত মাইল দূরে অপেক্ষায় থাকা মা আবারও নতুন বছরের ক্যালেন্ডার খুঁজতে শুরু করলেন, আবার কবে আসবে ঈদ?
জান্নাতুল বাকি
গলির ভেতর তখন সবে সন্ধ্যা নেমেছে। দেয়ালে ক্ষয়ে যাওয়া ইটের গায়ে ল্যাম্পপোস্টের আলো এসে অবলীলায় হারিয়ে যাচ্ছে। গলির শেষ মাথায় পুরোনো দ্বিতল বাড়ির সামনে রিকশা থেকে নামল সোমা। সিঁড়ির বাম পাশে বড় ঘরটা গৃহকর্ত্রী মিতালীর। বারান্দা থেকে সোমাকে বললেন, টিকিট পেয়েছিস রে মা? - পেয়েছি। গুছিয়ে নে। সোমা দ্রুত গোছানো শেষ করে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। রাতে সাড়ে ৯টার গাড়ি। ঢাকা-লালমনিরহাটের বাসে সোমার পাশের সিটে এক তরুণী বসেছে। বাসের যাত্রীদের চোখেমুখে ঘরে ফেরার আনন্দ। সোমা জানালার বাইরে তাকিয়ে। বাস দ্রুত ছুটে চলেছে। জানালা দিয়ে হুড়মুড় করে বাতাস ঢুকছে, শুধু মনের জানালায় অজস্র চিন্তার ভার সোমার। অনেক বছর হয়েছে, ঈদে আপন ঘরে ফেরা হয়নি। এবার নিশ্চয়ই হবে। জীবনের অনেক সময় চলে গেছে বড্ড অবহেলায়।
বহুদিন আগে এমনি এক ঈদের সময় বাবার হাত ধরে সে ঢাকায় এসেছিল চিকিৎসার জন্য। তাকে নিয়ে মায়ের সঙ্গে বাবার কথা কাটাকাটি হয়েছিল খুব। এক রাতে বাবা তাকে এক দোকানের সামনে রেখে খাবার আনতে যান কিন্তু কেন যেন আর ফিরে আসেননি। বহু পথ ঘুরে তার আশ্রয় হয়েছিল মিতালীর ঘরে। তাঁর সন্তান নেই। সোমা তাঁর সন্তান আবার ঘরের একমাত্র কাজের মানুষ। সময় গড়ায় নিজস্ব গতিতে। অনেক দিন পর সে জানতে পারে তার বাবা মারা গেছেন। বাবার মুখটা ভেবে মাঝে মধ্যে আকাশের পানে চেয়ে থাকে। বাবা, তুমি কেন আমাকে ফেলে গিয়েছিলে বলতে পারো?
মায়েরও খোঁজ পায় সে। এই মাকে ছেড়ে আসল মায়ের খোঁজে সোমা বেরিয়েছে জেনেও সে আটকায়নি। রাতের নিস্তব্ধতার বুক বিদীর্ণ করে বাসের অডিও সিস্টেমে গান বাজে ওঠে- 'আয় খুকু আয়'।
ঈদের দিন। খুব ভোরে বাস থেকে নেমে অনেক কষ্টে পাওয়া ঠিকানায়। এক বৃদ্ধা দরজা খুললেন, একটু এগিয়ে বারান্দার আলোয় মুখটা দেখলেন। তিনি দু'হাতে সোমার মুখটা নিজের কাছে টেনে নিলেন। হুবহু তার বাবার মুখের মতো। দু'জন দু'জনকে বুকে জড়িয়ে কান্না শুরু করল। কতটা সময় জড়িয়ে ধরলে প্রাণ শান্ত হবে হয়তো তারা কেউ জানে না।
মেহেরুন নেছা রুমা
শত কষ্ট সয়ে ছুটি প্রাণপণে, সব গ্লানি নিমেষে যায় ধুয়ে- যখন গিয়ে দাঁড়াই ঘাসভরা উঠোনে, রোদের ঝিলিক দেখি মায়ের মুখপানে। এই যাত্রা ঈদের। আনন্দের আবেগের আর উচ্ছ্বাসের। বছরের যে কোনো সময় বাড়ি যাওয়ার জন্য মন কেমন করা ভাবকে শিকলে বেঁধে রেখে বলি, এই তো আর কয়েকটা দিন সবুর কর মন, ঈদ এলো বলে। প্রতিবার ঈদ শেষে ঢাকায় ফিরে বলি, 'আর ঈদে বাড়ি যাব না। অন্য সময়ে যাব!' কিন্তু এই বদলে যায় ঈদ এলেই। এমনও হয়েছে ঈদের আগের দিন চলে গিয়েছি। সীমাহীন যন্ত্রণা শেষে বাড়ি পৌঁছতে হয়েছে। যাব না, যাব না করে লঞ্চে কেবিন বুকিং করা হয়নি আগে। হুট করে যাত্রার প্ল্যান। বরিশালের সবচেয়ে বড় লঞ্চ ছিল তখন কীর্তনখোলা। এক আত্মীয় মারফত কেবিনের ভরসা পেয়ে ব্যাগপ্যাটরা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। তুমুল বৃষ্টি আর অসহনীয় যানজটে সদরঘাট যেতে সে কী বিড়ম্বনা! রিকশা থেকে নেমে হাঁটা শুরু করি। বৃষ্টিতে ভিজছি সেই খেয়ালও নেই। লঞ্চ থেকেও কল এলো। রাস্তার জটলা, বৃষ্টি, তাড়াহুড়া ইত্যাদি কারণে মোবাইল ফোনের আওয়াজ কানে পৌঁছেনি।
জনস্রোতের সঙ্গে ছুটে চলি আমরাও। লক্ষ্য সদরঘাট। অনেক যুদ্ধ শেষে ঘাটে গিয়ে দেখি লঞ্চ ছেড়ে বুড়িগঙ্গা পাড়ি দিয়ে চলে যাচ্ছে। একরাশ মন খারাপ নিয়ে বৃষ্টির জলে দুঃখ ভাসিয়ে বলি, বাড়ি যাব বলছি যাবই। কিন্তু লঞ্চ না পেয়ে এবার গাড়ি নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বাসায় এসে সন্ধ্যায় সড়কপথে রওনা দিলাম। ভাগ্যবিড়ম্বনায় ফেরিঘাটের কাছাকাছি যেতেই আমাদের গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। রাত বাড়ে, বাড়ে উৎকণ্ঠা, সেই সঙ্গে পেটের খিদে আর মনের ভয়। রাস্তার পাশে বসে রইলাম। শেষে উপায় না পেয়ে ভ্যান, অটোরিকশা, লোকাল বাস করে কোনোমতে মাওয়া ফেরিঘাট পর্যন্ত গেলাম। সেখানে দীর্ঘ অপেক্ষার পর ফেরি পার হয়ে ওপাড়ে যেতে যেতে সকাল ১০টা। বরিশাল পৌঁছি দুপুর দেড়টায়। ঈদ যে কখন ফুরিয়ে যাচ্ছে টেরও পাচ্ছি না। বরিশাল থেকে মেহেন্দীগঞ্জ যেতে তখন লঞ্চে সময় লাগে তিন-চার ঘণ্টা। বরিশাল লঞ্চঘাট পৌঁছে দেখি লঞ্চ এখনই ছেড়ে যাবে। দৌড়ে লঞ্চে উঠি। তুমুল বৃষ্টি আর দমকা বাতাসে ছোট লঞ্চটি এমনভাবে দুলছিল যেন ডুবে যাবে এখনই। সৃষ্টিকর্তাকে ডাকি আর বলি এভাবে আর বাড়ি যাব না। অবশেষে সন্ধ্যার পর গিয়ে বাড়ির উঠানে পা ফেলি।
সেই অনুভূতি প্রকাশের নয়, নিজের জন্মস্থানের মাটিতে পা ফেলতেই যেন এক অদ্ভুত শিহরণ ছুঁয়ে গেল মনে। আপনজনদের মুখখানি দেখামাত্রই মুছে গেল সব কষ্ট। হাসি আর আনন্দ-উল্লাসে মুখর হয়ে উঠল বাড়ির আঙিনা।
এবার ঈদযাত্রাকে আনন্দময় করতে যুক্ত হয়েছে এক মহাবিস্ময়। আমাদের পদ্মা সেতু। উচ্ছ্বসিত হয়ে আছি কখন পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে বাড়ি যাব। যত কষ্টই হোক না কেন ঈদ এলে মনে হয় এই শহর আমার নয়। আমার নিজস্ব আকাশ আর মাটি ডেকে বলে, আয় ফিরে মায়ের কোলে। এই ভালোবাসার হাতছানি উপেক্ষা করে কিছুতেই যেন থাকা যায় না আর।
বাহাউদ্দিন ইমরান
জমাট ঘন মেঘের ভেতর থেকে বিমানটা আরেকটু নিচে নেমে এলো। দেশের মাটি, মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা বিভিন্ন বয়সী বৃক্ষ দেখে আকবরের চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক। প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর পর দেশের মাটিতে পা। আকবরকে নিতে টার্মিনালের বাইরে অপেক্ষায় বড় ভাবি আর ভাইজি মেহনাজ। দেখা হতেই দৌড়ে প্রিয় ছোট চাচাকে জড়িয়ে ধরে মেহনাজ। এবার ফেরার পালা। মগবাজারের দিলু রোডে আকবরের বড় ভাইয়ের বাসাতেই সে দিনটি প্রায় ঘুমিয়েই কাটালেন দুবাই প্রবাসী আকবর। রাতে খাবার টেবিলে দুই ভাইয়ের দেখা। পরদিন শুক্রবার, তাদের গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার পূর্ব নির্ধারিত দিন। তার এক দিন বাদেই ঈদ। হঠাৎ সব পরিকল্পনা ভেস্তে দিলেন বড় ভাই। জানালেন, ব্যক্তিগত কিছু অসুবিধার কারণে তাঁর এবারও গ্রামে ঈদ করতে যাওয়া হচ্ছে না। আকবর কারণ জানতে চাইলে সোলায়মান কথার প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করেন। সোলায়মান আকবরের জোরাজুরিতে সায় দেন। পরদিন দুপুর গড়াতেই তাঁরা বাড়ির পথে রওনা হন।
নির্মল বাতাসে দুই পাশে সারি সারি বৃক্ষলতা পেরিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলে। মাইক্রোতে বসেই সোলায়মান তাঁর অন্য দুই ছোট ভাই আনোয়ার এবং তোফায়েলকে ফোন করেন। তাঁরাও যাত্রাপথে। বাস বিলম্ব হওয়ায় আনোয়ার তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের বাসে বসিয়ে রেখে বাসের চারপাশে রাস্তায় পায়চারি করছে বলে জানান। তোফায়েল বললেন, ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা। শিডিউল ট্রেন প্রায় এক ঘণ্টা পর গাজীপুর স্টেশন থেকে ছেড়েছে। এখনও টিকিটের সঙ্গে মিলিয়ে নিজের সিটে বসতে পারেননি তিনি। তাই নিজে দাঁড়িয়ে থেকে স্ত্রী-সন্তানকে আরেকজনের সিটে বসিয়ে রেখেছেন। এভাবে আরও কিছুপথ তাঁকে ভোগান্তির মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
সব ঝুট-ঝামেলা পেরিয়ে বাড়ির বড় উঠোনের এক কোণে এসে মাইক্রো থামল। উঠোনের আরেক কোণে চেয়ারে বসে থাকা বাবা চশমার আড়াল থেকে তাঁর সন্তানদের দেখতে পেয়ে উঠে দাঁড়াতে চাইলেন। আকবর-সোলায়মান এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরলেন। তাঁকে বসিয়ে দিয়ে মায়ের কাছে ছুটলেন। প্রায় এক বছর হতে চলল, মা বিছানা থেকে উঠে একা হাঁটতে পারেন না। তবুও সন্তানদের দেখে তিনি আধ সোয়া হয়ে বসলেন। সন্তানদের বুকে জড়িয়ে মা একগাল কেঁদে ফেললেন। সবাই পেছনে ফিরে দেখলেন, আনোয়ার দাঁড়িয়ে। ভাইদের উদ্দেশে বলতে থাকলেন, মা কি শুধু তোমাদের? জায়গা দাও আদর নিয়ে নিই। মায়ের মুখ দিয়ে হাসি আর চোখ দিয়ে কান্না একসঙ্গে গড়িয়ে পড়তে থাকল। তিনি বললেন, আমার তোফায়েল কত দূর? সন্ধ্যার কিছু পর সপরিবারে তোফায়েলও মা-বাবার কাছে ফিরলেন। মা-বাবার জন্য কেনা সবার উপহার সব ভাগাভাগি হলো, সারাদিনের ধকল মলিন হয়ে গেল। সন্তানদের সঙ্গে গল্প-আহ্লাদ করতে গিয়ে মায়ের চোখে আবারও পানি। মা-বাবাকে জড়িয়ে ধরে আনন্দ-বেদনায় চোখের কোণে জল এলো সবার।
ঈদের দিন সকাল। চারদিকে উৎসবের আমেজ। রকমারি খাবারের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে। পুরুষরা ঈদের জামাতের উদ্দেশে রওনা দিলেন। দরজার কাছে মাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন পুত্রবধূরা। সবাইকে একসঙ্গে পেয়ে মায়ের বুকে এক অজানা প্রশান্তির প্রলেপ বিরাজ করে। তিন দিন বাদেই যেন ফিকে হয়ে আসে আনন্দ, চলে যাওয়া হলো। ছোট ছেলে কিছুদিন থাকলেও বাকিদের ফিরতে হবে কর্মস্থলে। সন্তানদের মাথায় হাত বুলিয়ে বিদায় জানালেন মা। মায়ের চোখের মায়ার গভীরতা তাঁদের মনে স্মৃতির বিচ্ছুরণ ঘটাতে লাগল। শত শত মাইল দূরে অপেক্ষায় থাকা মা আবারও নতুন বছরের ক্যালেন্ডার খুঁজতে শুরু করলেন, আবার কবে আসবে ঈদ?
বিষয় : ছোট গল্প
মন্তব্য করুন