রাজধানীর হাজারীবাগে গড়ে ওঠা চামড়াশিল্পের মাধ্যমে আশপাশের পরিবেশ ও বুড়িগঙ্গা নদীর ব্যাপক ক্ষতি হয়ে আসছিল দশকের পর দশ ধরে। দেশের চামড়াশিল্পে আন্তর্জাতিক মানসম্মত পরিবেশে নিশ্চিত করার জন্যই সাভারের হেমায়েতপুরে প্রায় দুই দশকের প্রচেষ্টায় গড়ে তোলা হয় চামড়া শিল্পনগরী। এ-সংক্রান্ত ১৭৫ কোটি টাকার প্রকল্পটিতে শেষ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ১০১৫ কোটি টাকা। কিন্তু এই দীর্ঘ সময় ও অতিরিক্ত অর্থ খরচের পরও পুরোপুরি কমপ্লায়েন্ট হতে পারেনি শিল্পনগরীটি। বর্জ্য পরিশোধনের জন্য শতভাগ প্রস্তুত হয়ে ওঠেনি সেখানকার কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি)। কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ডাম্পিং ইয়ার্ডও পর্যাপ্ত নয়। এসব অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি নিজেদের সক্ষমতার অভাবে কমপ্লায়েন্ট হতে পারেনি ট্যানারিগুলোও। যে কারণে আন্তর্জাতিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ পাচ্ছে না তারা। ফলে বিশ্ববাজারে তুলনামূলক কম দরে বিক্রি করতে হচ্ছে চামড়া। অন্যদিকে হাজারীবাগের মতোই দূষণ হচ্ছে ওই এলাকার পরিবেশ। দূষিত হচ্ছে এক সময়ের স্বচ্ছ পানির নদী ধলেশ্বরীও।

কমপ্লায়েন্সের অভাবের কারণে বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের চামড়া খাতের রপ্তানি আয় এক বিলিয়ন ডলারে ঘুরপাক খাচ্ছে। অথচ এ খাতের রপ্তানি বাড়ানোর ব্যাপক সম্ভাবনার কথা বলে আসছেন বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীরা। তাঁদের মতে, চামড়া শিল্পনগরীতে কমপ্লায়েন্সের ঘাটতি পূরণ করার পর ট্যানারি প্রতিষ্ঠানগুলো নিজে থেকে কমপ্লায়েন্ট হলে এলডব্লিউজি সনদ অর্জন করা যাবে। তখন আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দ্বিগুণ দাম পাওয়ার পাশাপাশি রপ্তানির পরিমাণও বেড়ে হবে দ্বিগুণ। দেশে কাঁচাচামড়ার দামও বাড়বে। কিন্তু এই সুযোগ নিতে হলে শিল্পনগরীর সিইটিপির সক্ষমতা বৃদ্ধি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ঠিক করা, শ্রমিকদের সুবিধা ও কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা, হাজারীবাগে ট্যানারির জমিগুলোকে রেড জোনমুক্ত করা, সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ, ভূমি বরাদ্দ নীতিমালা হালনাগাদ এবং পুরোনো ঋণের সুদ মওকুফ করাসহ কিছু উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নবায়ন বা নতুন করে ছাড়পত্র দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

ফিনিম্যাক্স ট্যানারির মালিক মাজাকাত হারুন মানিক বলেন, সাভারের সিইটিপিতে কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। চাহিদার চেয়ে এর ধারণ ক্ষমতা কম। চাপ বেশি পড়লে মাঝেমধ্যে অকার্যকর হয়ে যায়। বৃষ্টি হলে বর্জ্য রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে। চাপ কমাতে কিছু কিছু ট্যানারি সাময়িক বন্ধ রাখা হয়। আবার কিছু সময় চালু থাকে। এভাবে রেশনিং করে চলছে ট্যানারিগুলো। তবে এতে কিছু চামড়া নষ্ট হয়ে যায়। তিনি বলেন, বর্তমানে সব কিছুর দাম বাড়লেও চামড়ার দাম বাড়ছে না। ট্যানারিগুলো কমপ্লায়েন্ট হতে পারলে চামড়ার রপ্তানি মূল্য বেশি পাওয়া যেত।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান মো. ইলিয়াসুর রহমান বাবুল সমকালকে বলেন, সিইটিপি দিয়ে যে পানিগুলো পরিশোধন করা হয় সেগুলো পুনরায় ব্যবহার করা যায় না। এগুলো ব্যবহার করা গেলে পানি সরবরাহে খরচ কমত। ইউরোপ থেকে উন্নতমানের যন্ত্র এনে আরও একটি সিইটিপি স্থাপন করা দরকার।

তিনি বলেন, শিল্পনগরীর জন্য জায়গা আরও বেশি পরিমাণে নেওয়া দরকার ছিল। বিসিকের পরিকল্পনায়ও কিছু ভুল ছিল। বেশিরভাগ ট্যানারি আয়তনে অনেক ছোট। পুঁজি কম তাদের। দক্ষ জনশক্তিরও অভাব। ফলে পরিবেশবান্ধব কারখানা করার জন্য যেসব শর্ত রয়েছে তা অনেকের পক্ষে মানা সম্ভব নয়। তাছাড়া ট্যানারি নিয়ে সরকারেরও মনোযোগ কম। সব মিলিয়ে কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করার বিষয়টি অনিশ্চিত।

বিটিএর সাধারণ সম্পাদক মো. শাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, পরিবেশর ছাড়পত্র খুব বেশি দরকার। কারণ এলডব্লিউজি সনদের জন্য আবেদন করতে আগের দুই বছর পরিবেশের ছাড়পত্র থাকতে হবে। এটা পাওয়া গেলে আগামী দুই বছরের মধ্যে কমপক্ষে ৩০টি ট্যানারি এলডব্লিউজি সনদের জন্য আবেদন করতে পারবে। সেজন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। নতুবা কমপ্লায়েন্ট হওয়া সম্ভব নয়।

রপ্তানিকারকরা বলছেন, এলডব্লিউজি সনদ না থাকা অর্থাৎ ট্যানারিগুলোতে শতভাগ কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত না হওয়ায় ইউরোপ ও আমেরিকার ক্রেতারা পণ্য কিনতে চান না। তাই তুলনামূলক কম দামে চীনে রপ্তানি করতে হয়। এতে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ দাম কম পাচ্ছেন তাঁরা। তবে এলডব্লিউজি সনদ পেলে ইউরোপ ও আমেরিকার ক্রেতারা ফিরে আসবেন।

বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ মাহিন বলেন, পুরোপুরি প্রস্তুত করার আগেই হেমায়েতপুরে কারখানা স্থানান্তরে ট্যানারি মালিকদের বাধ্য করা হয়েছে। সেখানে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি রয়ে গেছে। এতে উদ্যোক্তারা নানা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।

তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে প্রায় ২৪০ থেকে ২৫০ বিলিয়ন ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য কেনাবেচা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের রপ্তানি এক বিলিয়নের কিছু বেশি। ট্যানারিগুলোতে কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা গেলে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, এ খাতের বর্তমান রপ্তানি আয় ২০৩০ সাল নাগাদ ১০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা সম্ভব।

বুড়িগঙ্গা নদী ও পরিবেশ দূষণের কারণে রাজধানীর হাজারীবাগের চামড়াশিল্পকে সাভারের হেমায়েতপুরে নেওয়া হয়। দুই বছরের মধ্যে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পরিবেশে উন্নীত করে সেখানে চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয় বিসিক। সেই লক্ষ্যে কাজ শুরু হয় ২০০৩ সালে। ২০১৭ সালে হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো সাভারে স্থানান্তর হয়। কাজ এখনও চলছে। প্রথমে প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে বেশ কয়েক দফায়। অন্যদিকে দুই বছরের মধ্যে সিইটিপি স্থাপনের কথা থাকলেও তা শেষ করতে সময় লেগেছে প্রায় সাত বছর। এত দীর্ঘ সময় ও অতিরিক্ত অর্থ খরচের পরও এখনও পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে ওঠেনি চামড়া শিল্পনগরী। সেখানে ১৫৫টি ট্যানারিকে জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে বর্তমানে ১৩৯টি ট্যানারি উৎপাদনে রয়েছে।

জানা গেছে, বছরের অন্য সময়ে কম হলেও কোরবানির ঈদের পর চামড়া শিল্পনগরীতে দৈনিক ৪০ থেকে ৪৫ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য উৎপাদন হয়। কিন্তু ট্যানারি মালিকদের ধারণা, ১৫ থেকে ২০ হাজারের বেশি ঘনমিটার বর্জ্য পরিশোধন করার সক্ষমতা নেই সিইটিপির। যদিও কর্তৃপক্ষ বলছে, সিইটিপির বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা রয়েছে দৈনিক ২৫ হাজার ঘনমিটার।

চামড়া শিল্পনগরী কর্তৃপক্ষ সূত্র বলছে, অনেকে নিয়ম অমান্য করে একই লাইনে সব ধরনের বর্জ্য ছেড়ে দেয়। সিইটিপির পাইপে বর্জ্য ছাড়ার সময় ছাকনি ব্যবহার করে না। ফলে পাইপগুলোর ভেতরে বর্জ্য জমে যায়। তখন পরিশোধন ক্ষমতা কমে যায়। এ সমস্যা সমাধানে বর্তমান সিইটিপির পাশাপাশি আরও একটি সিইটিপি স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সেজন্য সমীক্ষা চলছে। আগামী ছয় মাসের মধ্যে উদ্যোগ নেওয়া হবে। বড় ট্যানারিগুলো যেন নিজস্ব সিইটিপি করতে পারে, সে বিষয়টিও দেখা হচ্ছে। এছাড়া খুব শিগগিরই একটা ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট করা হবে, যার মাধ্যমে বর্জ্য পানি পরিশোধন করে তা পুনরায় ব্যবহার করা যাবে। তখন পানি পরিশোধন করে ধলেশ্বরীতে ফেলতে হবে না। কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়ও নেওয়া হচ্ছে স্থায়ী সমাধানের উদ্যোগ। সেগুলো থেকে বাই-প্রোডাক্ট উৎপাদন করা হবে। এতে বর্জ্যের পরিমাণ কমে যাবে। সব মিলিয়ে আগামী বছর নাগাদ চামড়া শিল্পনগরী ও এর সিইটিপির চেহারা পাল্টে যাবে।

চামড়া শিল্পনগরীতে সিইটিপি পরিচালনার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট ওয়েস্টেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাক আহমেদ সমকালকে বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বেশ বিছু পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। আরেকটি সিইটিপি স্থাপন করা হবে। এছাড়া বর্জ্য পানি পরিশোধন করে তা পুনরায় ব্যবহার করা যাবে- এমন একটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট করা হবে। এখন কঠিন বর্জ্যগুলো ডাম্পিং ইয়ার্ডে ফেলা হচ্ছে। ভবিষ্যতে ক্রোমিয়ামযুক্ত এবং ক্রোমিয়ামবিহীন উভয় প্রকার কঠিন বর্জ্য প্রক্রিয়াজাত করে 'বাই প্রডাক্ট' তৈরি করা হবে।

এলডব্লিউজি সনদ অর্জনের জন্য ১৭১০ পয়েন্ট অর্জন করতে হয়। এর মধ্যে সিইটিপিতে রয়েছে ৩০০ পয়েন্ট। কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ১০০ পয়েন্ট। এছাড়া কারখানার শ্রমিকদের নিরাপত্তা, কাজের ভালো পরিবেশ, কেমিক্যাল ওয়্যারহাউসসহ কারখানার সার্বিক মান ঠিক থাকলে বাকি ১৩০০ পয়েন্ট অর্জন করা যায়।
জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে ২৫টি ট্যানারিকে এলডব্লিউজি সনদ পেতে তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি, অদক্ষতা চিহ্নিতকরণ, কারখানার মান ও পরিবেশ উন্নয়নে করণীয়সহ কিছু কর্মসূচি নিয়েছে বিটিএ। এতে সহায়তা করছে লেদার সেক্টর বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিল (এলএসবিপিসি) ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

পরিবেশ অধিদপ্তরের ঢাকা অঞ্চলের পরিচালক মো. জিয়াউল হক সমকালকে বলেন, পরিবেশ আইন অনুযায়ী যেসব শর্ত রয়েছে সেগুলো পরিপালন করতে পারছে না ট্যানারিগুলো। প্রতি মাসে সিইটিপি থেকে তরল বর্জ্য এনে গবেষণাগারে পরীক্ষা করা হয়। তাতে দেখা যায়, সিইটিপি দিয়ে নির্গত তরল বর্জ্যগুলোর সঙ্গে কঠিন বর্জ্য, কেমিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড (সিওডি) ও ক্রোমিয়াম থেকে যায়। এর মধ্যে সিওডি পাশের ধলেশ্বরী নদীতে গিয়ে পড়ে। এতে নদীতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। তিনি বলেন, সরকার ও ট্যানারিগুলো যৌথ উদ্যোগ না নিলে এলডব্লিউজি সনদ পেতে অনেক সময় লেগে যাবে। তবে সরকার চাইলে এসব শর্ত শিথিল করে আপাতত পরিবেশগত ছাড়পত্র দিতে পারে।