
ড. এম আবু ইউসুফ, অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সমকাল :চামড়া খাতে কমপ্লায়েন্সের অভাবের কথা বলছেন অনেকেই। ঘাটতিগুলো আসলে কোন কোন জায়গায়?
এম আবু ইউসুফ :চামড়া খাতকে কমপ্লায়েন্ট করতে ২০১৭ সালে ট্যানারি কারখানাগুলোকে ঢাকার হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তর করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল পরিবেশবান্ধব শিল্প গড়ে তোলা; উৎপাদন ও রপ্তানি বাড়ানো। এজন্য ১ হাজার ৭৯ কোটি টাকার প্রকল্পে ৮০ শতাংশই দিয়েছে সরকার। আর কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) স্থাপনে ৬৩৮ কোটি টাকার পুরোটাই সরকার দিয়েছে। তারপরও কমপ্লায়েন্সে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ের উন্নতি হয়নি।
চামড়া শিল্পনগরীর সিইটিপিতে ২৫ হাজার ঘনমিটার তরল বর্জ্য পরিশোধন করা যায়। অথচ পিক সিজন, অর্থাৎ কোরবানি ঈদের পর ট্যানারিগুলোতে ৩০-৪০ হাজার ঘনমিটার তরল বর্জ্য উৎপাদন হয়। শুরু থেকেই এ বিষয়ে সচেতন হওয়া উচিত ছিল। সম্প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তর বলেছে, এই সিইটিপি কিছু ইন্ডিকেটরে এখনও কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছতে পারেনি। কিন্তু বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) বলছে, সিইটিপি ঠিকভাবেই কাজ করছে। আসলে এ ক্ষেত্রে বিসিক উন্নতি করেছে, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তর ও লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) দেওয়া লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। আরেকটি সমস্যার জায়গা হচ্ছে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। এই বর্জ্য খোলা জায়গায় ফেলা হচ্ছে। তবে সম্প্রতি শিল্প মন্ত্রণালয় কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এর স্থায়ী সমাধান হলে সেখানকার পরিবেশের ব্যাপক উন্নতি হবে বলে আশা করা যায়।
সমকাল :কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি না হওয়ার পেছনে দায়টা আসলে কার?
এম আবু ইউসুফ :দায় আমাদের সবারই। কারণ আমরা সবাই সমস্যাগুলো জানি কিন্তু সমাধান সেভাবে করছি না। উন্নতি কিছুটা হচ্ছে কিন্তু তা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নয়। এ ক্ষেত্রে অন্যতম একটি নির্ণায়ক এলডব্লিউজি সার্টিফিকেট। তৈরি পোশাকে এ ধরনের সনদ হচ্ছে লিড সার্টিফিকেট। দেশের পোশাকশিল্পে এই সার্টিফিকেট পাওয়া প্রতিষ্ঠান এখন ১৬১টি। তৈরি পোশাকে এই উন্নতির ক্ষেত্রে কমপ্লায়েন্টই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। অথচ চামড়া খাতে এ পর্যন্ত মাত্র চারটি প্রতিষ্ঠান এলডব্লিউজি সনদ পেয়েছে। এর মধ্যে শফিপুরে অবস্থিত অ্যাপেক্স ট্যানারি ইউনিট-২ একমাত্র গোল্ড সার্টিফায়েড। এটি বিদেশ থেকে চামড়া এনে প্রক্রিয়াজাত করে লেদারগুডস ও ফুটওয়্যার এক্সপোর্ট করে। অথচ কমপ্লায়েন্ট না হওয়ার কারণে দেশীয় চামড়া তারা ব্যবহার করতে পারছে না। সাভার চামড়া শিল্পনগরীর একটি প্রতিষ্ঠানও এলডব্লিউজি সনদ পায়নি।
সমকাল :কমপ্লায়েন্সের ঘাটতির কারণে কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে?
এম আবু ইউসুফ :সারা পৃথিবীতেই এখন বলা হচ্ছে 'নো কমপ্লায়েন্ট, নো বিজনেস'। শিল্পপ্রতিষ্ঠান কমপ্লায়েন্ট না হলে অনেকে তাদের সঙ্গে আর ব্যবসা করতে চাইছে না। বিশেষ করে হাই এন্ডের প্রোডাক্টে। এই খাতের ব্যবসাটা বায়ার ড্রিভেন; সাপ্লাই ড্রিভেন নয়। বড় ব্যান্ড ও ক্রেতারা ইএসজি (এনভায়রনমেন্ট, সোশ্যাল অ্যান্ড গভর্ন্যান্স) জায়গায় ছাড় দেয় না। এমনকি এখন তারা ট্রেসিবিলিটিও দেখতে চায়। পশুর জন্ম থেকে শুরু করে তার পরিচর্যা, চামড়া সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত কীভাবে হয়েছে- পুরোটাই পরীক্ষা করা যায় এখন।
চামড়া শিল্পনগরীতে ছয় থেকে সাত হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ করেছেন ট্যানারি মালিকরা। পাশাপাশি আট হাজার কোটি টাকার সম্পদ আছে হাজারীবাগে। পুরোনো ব্যাংকঋণে বছরে ৮০০ কোটি টাকার মতো সুদ গুনতে হচ্ছে তাঁদের। কিন্তু কমপ্লায়েন্সে ঘাটতির কারণে সে অনুসারে ব্যবসা করতে পারছেন না তাঁরা। ট্রানজিশন পিরিয়ডে তাঁদের অনেকের রপ্তানি কমে গেছে। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের চামড়া খাতে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৫ কোটি ডলারের। এখন ভিয়েতনাম প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি করছে। আমরা এক বিলিয়ন ডলার নিয়েই যুদ্ধ করছি।
সমকাল :উন্নতির জন্য করণীয় কী?
এম আবু ইউসুফ :চামড়া খাত বৃহৎ শিল্প। এই খাতের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বিসিককে। কিন্তু বিসিক তো ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প নিয়ে কাজ করে। চামড়াশিল্পের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে যোগ্য কর্তৃপক্ষ দরকার, যে প্রতিষ্ঠান চামড়াশিল্পকে কমপ্লায়েন্ট করার জন্য কাজ করবে। এ খাতের জন্য রোডম্যাপও তৈরি করতে হবে। সেখানে বলতে হবে সমস্যা কোনগুলো; সমাধানে কী পদক্ষেপ থাকছে। কোন বছরের মধ্যে কোনটি হবে, সেটাও থাকতে হবে। শিল্পনগরীর সাধারণ সমস্যা (যেমন- সিইটিপি, কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা) সমাধান করে কারখানা মালিকদের বলতে হবে, এখন আপনারা কমপ্লায়েন্ট হোন। পাশাপাশি ভালো ও প্রকৃত ব্যবসায়ীদের সহজ শর্তে অর্থায়ন ও অন্যান্য সুবিধা দিতে হবে।
সমকাল :এ খাতের আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান কেমন?
এম আবু ইউসুফ :আন্তর্জাতিক বাজার প্রায় ২৪০ বিলিয়ন ডলারের মতো। এর মধ্যে বাংলাদেশের অংশ মাত্র শূন্য দশমিক ৬ শতাংশের মতো। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাতে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় এসেছে ১ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার। মাঝে কয়েক বছর রপ্তানি কমে যাওয়ার পর গত অর্থবছরে কিছুটা বেড়েছে।
সমকাল :সার্বিক অবস্থার উন্নতি হলে বাংলাদেশের সম্ভাবনা কতটুকু?
এম আবু ইউসুফ :বাংলাদেশের চামড়া খাতে তুলনামূলক সুবিধা রয়েছে। এখানে সস্তা শ্রমের পাশাপাশি কাঁচামালের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। মূল্য সংযোজনের হার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত; যা তৈরি পোশাক খাতের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি। চামড়াশিল্পের জন্য শুধু কেমিক্যাল আমদানি করতে হয়। বাকিটা দেশেই পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে চামড়া খাতে বাংলাদেশের সম্ভাবনা অনেক বেশি। কমপ্লায়েন্সের উন্নতি হলে এখনকার দামের চেয়ে দেড় গুণ বেশি দামে পণ্য বিক্রি করা যাবে। সাভার শিল্পনগরীতে যদি ২০-২৫টি ট্যানারিকে এলডব্লিউজি সার্টিফায়েড করা যায়, তাহলে ২০৩০ সালের মধ্যে রপ্তানি আয় বছরে ৫ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা সম্ভব।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মমিনুল হক আজাদ
মন্তব্য করুন