বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন বৃক্ষগুলো আমাদের জন্য অবিশ্বাস্য রকমের উপকারী। এমন আবিস্কারের পরও আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সেগুলো হারাচ্ছি। এসব বৃক্ষের ক্লোন করাকে অনেকে সমাধান হিসেবে দেখছেন। এগুলোর জেনেটিক রহস্য নিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিতে প্রকাশিত এক নিবন্ধ অবলম্বনে লিখেছেন শাহেরীন আরাফাত

২০০৫ সালে আমেরিকার মন্টানার উত্তর রকি পর্বতমালায় পরিবেশবাদী লেখক জিম রবিন্সের ১৫ একর বনে বহু শতাব্দী পুরোনো পন্ডেরোসা পাইন গাছগুলো হঠাৎ মারা যেতে থাকে। তিনি বুঝতে পারেন, পাহাড়ি গুবরে পোকার আক্রমণে গাছগুলো ভেঙে পড়ছে। ছোট্ট ইঞ্চি দেড়েকের এ পোকা গাছের মধ্যে গর্ত করে বাসা বেঁধেছিল। পরের বছর মৃত গাছের সংখ্যা আরও বাড়তে থাকে। পরিবেশ-প্রকৃতি নিয়ে কাজ করা জিম রবিন্সের জন্য এটি ছিল অবসাদগ্রস্ত বাস্তবতা। তিনি চোখের সামনে আকাশছোঁয়া গাছগুলো বিবর্ণ হতে দেখেছেন, অথচ করার কিছুই ছিল না।

এর তিন বছরের মধ্যেই ওই বনের প্রায় ৯০ শতাংশ গাছ মারা গিয়েছিল। যদিও জিম রবিন্সের বনে গাছ মারা যাওয়ার আনুমানিক কারণ ছিল গুবরে পোকা; তবে প্রশ্ন হলো- এখানে এমন কী হলো যে, গুবরে পোকাগুলো ঘাতক হয়ে উঠল। তাপমাত্রার পরিবর্তনটা রকি পর্বতমালায় খুব স্পষ্ট। অতীতে সেখানে রেকর্ড পরিমাণ ঠান্ডা ছিল, মাইনাস ৫৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ১৯৭০ সালেও শীতকালে তাপমাত্রা মাইনাস ৩৪ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যেত। আজকাল শীতকালে নূ্যনতম তাপমাত্রা খুব কমই মাইনাস ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা এর নিচে নামে। দু-এক দিনের জন্য হয়তো তাপমাত্রা কমে; কিন্তু তা ওই গুবরে পোকাগুলো মারার জন্য যথেষ্ট ঠান্ডা নয়। এটি শুধু একটি বনের কথা নয়; উত্তর আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলজুড়ে গাছ মারা যাচ্ছে। ব্রিটিশ কলাম্বিয়া ২০০৬ ও ২০০৭ সালে প্রায় ৮০ শতাংশ গাছ হারিয়েছে। কয়েক বছর আগে ক্যালিফোর্নিয়ায় ১২৯ মিলিয়ন গাছ মারা যায়।

তবে গত কয়েক বছরে বিজ্ঞানীরা প্রাচীন গাছের জেনেটিক্স সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ করেছেন। তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে দেখিয়েছেন, পৃথিবীর বনের ভবিষ্যতে এ প্রাচীন বৃক্ষের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। অনেকে জিনগতভাবে অক্ষত রেখে এসব দৈত্যাকৃতির বৃক্ষের ক্লোন বা প্রতিরূপ রোপণ করতে ভীষণ আগ্রহী। এটিকে দূরদর্শী পদক্ষেপ বলে মনে করা হচ্ছে।

প্রাচীন গাছগুলো কার্বনের বড় ধারক, যা জলবায়ুতে কার্বন গ্যাসের পরিমাণ কমাতে ভীষণ জরুরি। উষ্ণায়ন থেকে বাঁচতে কার্বন ধারণের বিকল্প নেই। সবচেয়ে বড় ১ শতাংশ গাছ মোট ৫০ শতাংশ কার্বন ধারণ করে। সমস্যা সমাধানে বৃক্ষের মধ্যকার সম্পর্কের ওপর গুরুত্বারোপ করেন ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুবিজ্ঞানী সুজান সিমার্ড। তাঁর মতে, গাছেদের মধ্যে পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে এবং শিকড় ও ছত্রাকের মাধ্যমে তারা একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করে।
ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ ইকোফিজিওলজিস্ট ও গ্লোবাল চেঞ্জ ইকোলজিস্ট উইলিয়াম হ্যামন্ড এবং নিউ মেক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুবিদ্যার অধ্যাপক ক্রেগ ডি অ্যালেন বিশ্বের বৃহত্তম গাছ এবং ঐতিহাসিক বনে ব্যাপক মৃত্যুর পূর্বাভাস দিয়েছেন।

এ থেকে উত্তরণের পথ কী হতে পারে? গবেষকরা বলছেন, বছরের পর বছর কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করাকে একমাত্র উপায় মনে করার সুযোগ নেই। কিছু বনে একরপ্রতি ৮০০ থেকে ১ হাজার গাছ থাকে, যাদের পানির জন্য কঠোর প্রতিযোগিতা করতে হয়। একটি সুস্থ বনে এর এক-দশমাংশ হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে যান্ত্রিকভাবে জঙ্গল পাতলা করা বা নিয়ন্ত্রিত আগুনের সাহায্য এতে সহায়ক হতে পারে।

তবে বন ও প্রাচীন বৃক্ষের প্রজাতি রক্ষায় ক্লোন প্রযুক্তিকে সবচেয়ে কার্যকর বলে মনে করা হচ্ছে। ১৯৯০-এর দশকে গ্রামীণ উত্তর মিশিগানে এক বাবা ও ছেলে মিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি প্রজাতির বৃহত্তম গাছ ক্লোন করার পরিকল্পনা করেন। ডেভিড মিলার্ক চতুর্থ প্রজন্মের কৃষক, যিনি বৃহৎ বৃক্ষের পরিচর্যা করেন। তিনি ও তাঁর ছেলে জ্যারেড বড় গাছের তালিকা দেখে সেখানে যান এবং ওই জায়গার মালিকের অনুমতিক্রমে গাছের কিছু কাটিং সংগ্রহ করেন। কাটিংগুলো একটি নার্সারিতে পাঠানো হয়, যেখানে ওই বৃহৎ বৃক্ষের অবিকৃত কপি বা ক্লোন আকারে তা বড় হয়। এরপর মিলার্ক এবং তাঁর ছেলে ক্লোনগুলো কবরস্থান, পার্ক বা কোনো খোলা জায়গায় রোপণ করেন। মিলার্ক একে 'জীবন্ত আর্কাইভাল লাইব্রেরি' বলে উল্লেখ করেন। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ৮০০, ২০০০ বা ৫০০০ বছরের পুরোনো গাছের জেনেটিক্স সংরক্ষণ করতেই এ কাজ তাঁরা শুরু করেন। মিলার্ক বলেন, 'বৃহৎ বৃক্ষের জেনেটিক্স অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। এদের জেনেটিক্স রক্ষা করতে ক্লোন করাটা ভীষণ জরুরি। এগুলো কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা আমরা অনেকেই জানি না।'

মিলার্কের প্রকল্পটি বিশ্বের বৃহত্তম গাছ ক্লোন করার এবং সারাবিশ্বে রোপণের এক অদ্ভুত প্রচেষ্টার গল্প তুলে ধরছে। প্রকল্পটি আমেরিকান ফরেস্ট নামে ওয়াশিংটন ডিসির একটি অলাভজনক সংগঠনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত। এ প্রকল্পে মূলত রেডউডস ও সিকোইয়ার মতো আমেরিকার প্রাচীনতম, সবচেয়ে আইকনিক গাছগুলো ক্লোন করা হয়।

মিলার্কের সংগঠনটিকে এখন 'আর্চঅ্যাঞ্জেল অ্যানসিয়েন্ট ট্রি আর্কাইভ' বলা হয়। এখনও তারা গাছের ক্লোন করছে। তারা পুরোনো বনেও বৃক্ষরোপণ করছে। মিলার্ক জানান, তাঁরা প্রেসডিওতে ক্লোন করা ৭৫টি রেডউড রোপণ করেছেন। অন্তত ৪১টি শহরে সিকোইয়া রোপণ করেছেন। আর্চঅ্যাঞ্জেল অ্যানসিয়েন্ট ট্রি আর্কাইভের দর্শন হলো- ২০০০ বছরের পুরোনো গাছগুলো নড়তে পারে না, তবে তাদের জেনেটিক্স তা করতে পারে। ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে গড়ে তোলা সম্ভব এক নতুন বন।

প্রাচীন বৃক্ষের জেনেটিক্সের গুরুত্ব তুলে ধরে সুরকার ও সংগীত প্রযোজক টিমোথি স্মিথ জানান, যুক্তরাজ্যের কর্নওয়ালে তাঁর ইডেন প্রজেক্টে আর্চঅ্যাঞ্জেল অ্যানসিয়েন্ট ট্রি আর্কাইভ থেকে ৪৯টি ক্লোন সিকোইয়া রোপণ করা হয়েছিল, যেখানে বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার উদ্ভিদ প্রজাতি রয়েছে। সিকোইয়াগুলো ৩ ফুট উঁচু অবস্থায় এসেছিল, যা এখন প্রায় ১৫ ফুট লম্বা। দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়াটা ওই প্রাচীন বৃক্ষের জিনগত বৈশিষ্ট্য।

দুই দশক ধরে ক্লোনিং চলার ওপর এ বছর একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। উপসংহার টানা হয়- প্রাচীন গাছগুলো আমূলভাবে জেনেটিক বৈচিত্র্যকে উৎসাহিত করে এবং এভাবে পার্শ্ববর্তী বনের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিস্থাপকতা এবং এর মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতায় অবদান রাখে।

গবেষণা প্রতিবেদনের অন্যতম লেখক ও ইলিনয়েসের মর্টন আরবোরেটাম সেন্টার ফর ট্রি সায়েন্সের পরিচালক চাক ক্যানন বলেন, 'এই প্রাচীন গাছগুলোর মধ্যে থাকা জেনেটিক্সের বিশেষ সংমিশ্রণ শতাব্দীর সঙ্গে শতাব্দীর সেতু রচনা করতে পারে এবং এমন জিনগুলো চরম পরিবেশে চলার জন্য উপযোগী, যা শত শত বছর ধরে উপস্থিত ছিল না।'

বিষয় : হাজার বছরের বৃক্ষ

মন্তব্য করুন