তীরন্দাজ নাট্যদলের প্রতিষ্ঠাতা, আবৃত্তি সংগঠন 'বৈঠক'-এর সভাপতি এবং শিল্পকলা একাডেমির সহকারী পরিচালক শাহীন রেজা রাসেল। বিরল রোগে আক্রান্ত হয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তিনি দেশের এ মাথা থেকে ও মাথা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় গড়ে তুলেছেন বিশ্বের প্রথম জলবায়ু জাদুঘর। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন লাবণী মণ্ডল

প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ শাহীন রেজা রাসেলের জীবনই এক লড়াই- বাঁচার জন্য লড়াই। ৩৮ বছর বয়সের এ যুবকের কাজের ভার বয়সের তুলনায় অনেক বেশি। বিপন্ন পৃথিবীকে মুক্ত করার দায় নিয়েছেন। যে দায়বদ্ধতা থেকে একের পর এক নতুনের সন্ধান করে চলেছেন। মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলা শহরে ১৯৮৪ সালের ২৭ এপ্রিলে তাঁর জন্ম। সেখানেই বেড়ে ওঠা। নদীনালায় ভরপুর ছিল শ্রীপুর। গাছপালা। দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। এ যেন স্বর্গ! যেখানে চোখ বন্ধ করে ভাবা যায়- পৃথিবী বড়ই সৌন্দর্যময়। প্রকৃতির সান্নিধ্যেই কেটেছে তাঁর শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের একাংশ।

ট্রাভেলিংয়ের শুরু সম্পর্কে তিনি বলেন, 'কৈশোর থেকেই ঘুরে বেড়ানোর নেশা। ২০০০ সাল, তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। এক দিন কারাতে শিখতে গিয়ে আমার পায়ে কিছুটা দুর্বলতা অনুভব করি। প্রথম দিকে চিকিৎসকরা রোগটি শনাক্ত করতে পারেননি। মাস ছয়েক নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর রোগটির অস্তিত্ব শনাক্ত হয়। এরপর কলকাতার বেলভিউ ক্লিনিকের নিউরোলজি বিভাগে দেখাই। সেখানে ডা. অভিজিৎ চ্যাটার্জি আমাকে বলেন, তোমার রোগের নাম বেকার মাসকুলার ডিসট্রফি। পৃথিবীর কোথাও এ রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। তুমি আগামী ১০ বছরের মধ্যে পঙ্গু হয়ে যাবে। ধীরে ধীরে তোমার সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অকার্যকর হয়ে যাবে। এই রোগ ধীরে ধীরে তোমার মৃত্যু ঘটাবে। ওই বয়সে এই ভয়াবহ সত্যটা আমার কাছে বজ্রপাতের মতো লেগেছিল। সেদিনই সিদ্ধান্ত নিলাম, পঙ্গু হওয়ার আগেই সারা বাংলাদেশ ভ্রমণ করব। সেই মতো ট্রাভেলিং শুরু করে দিলাম। বাংলাদেশের প্রায় সব পর্যটনকেন্দ্রেই যাওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার। জেলা হিসেবে এ পর্যন্ত ৬১টি জেলা ভ্রমণ করেছি। এই শরীরে এখনও চেষ্টা করি ভ্রমণ অব্যাহত রাখার।'

তিনি আরও বলেন, '২০১৬ সাল থেকে হুইলচেয়ার ব্যবহার শুরু করি। এ বছর রোগটি আমার হূৎপিণ্ডকে গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আমার হূৎপিণ্ডের রক্ত সঞ্চালন ক্ষমতা এখন মাত্র ৩৬ ভাগ। ধীরে ধীরে হূৎপিণ্ডের এই ক্ষমতা আরও কমে যাচ্ছে এবং এক সময় থেমে যাবে। আমাকে নিতে হবে মৃত্যুর স্বাদ। তার আগে যতটা পারি, নিতে চাই জীবনের স্বাদ। মৃত্যুর আগেই মরে যেতে চাই না। আমি লড়াই করব, জীবনকে যাপন নয়, উদযাপন করব।'

পরিবেশ নিয়ে বৃহৎ পরিসরে কাজ শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর। ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাবিষয়ক সংগঠন 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশ সংসদ'। এরই ধারাবাহিকতায় গড়েছেন 'পরিবেশ ও জলবায়ু জাদুঘর'।

জাদুঘরটি সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব উপকরণ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। ঘরটির ভেতরে কাঠের টেবিলের ওপরে নির্দিষ্ট মাপের সারি সারি কৌটা সাজিয়ে রাখা। এসব কৌটার কোনোটিতে রয়েছে বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদের বীজ। কোনো কোনোটিতে রয়েছে নদীর পানি। আবার কোনোটিতে ভূগর্ভস্থ কঠিন শিলা, গ্রানাইট পাথর, বিভিন্ন পতঙ্গের বাসা, নানান মাটির নমুনা। দুই শতাধিক উপকরণ স্থান পেয়েছে পরিবেশবান্ধব ঘরটিতে। নিভৃত পল্লির ছোট্ট এই জাদুঘরটি দেখতে প্রতিদিনই দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসছে। তবে এসব দর্শকের বেশিরভাগ বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থী। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত দর্শনার্থীর জন্য খোলা রাখা হয় জাদুঘরটি।

শাহীন রেজা রাসেল সম্পর্কে বলতে গিয়ে আবৃত্তি সংগঠন 'বৈঠক'-এর প্রধান নির্বাহী হাসান মাহাদী বলেন, 'শাহীন রেজা রাসেল একজন অদম্য ইচ্ছাশক্তির মানুষ। দমন করা যায় না এমন একজন মানুষ। তারুণ্যের উন্মাদনা প্রতিনিয়ত কাজ করে তাঁর মধ্যে।'

শাহীন রেজা রাসেল বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সহকারী পরিচালক হিসেবে কর্মরত। এ ছাড়া তিনি প্রতিনিয়ত লিখছেন। গান, কবিতা আছে তাঁর অস্তিত্বজুড়ে। যুক্ত রয়েছেন আবৃত্তি সংগঠন 'বৈঠকে'র সঙ্গে। তিনি বলেন, 'এখন পর্যন্ত আমার ৮টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সাংস্কৃতিক ও সাংগঠনিক চর্চার শুরু ছোটবেলা থেকেই। আমি এ পর্যন্ত ৫টি মঞ্চনাটক, ১৪টি পথনাটক ও একটি টিভি নাটক রচনা করেছি। গান লিখি, সুর করি, আবার গেয়ে ফেলার দুঃসাহসও দেখাই।'

ভবিষ্যতে কী করতে চান- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, "আর হয়তো অল্প কয়েকটা দিন আছি পৃথিবীতে। যে ক'টা দিনই থাকি সৃজন আনন্দে যেন বাঁচি, পৃথিবীর সবটা না হলেও কিছুটা যেন ঘুরে দেখতে পারি এবং মানুষের জন্য যেন কিছু করতে পারি সেই স্বপ্ন দেখি।" মৃত্যুর মতো সত্য আর কিছু নেই। কী অবলীলায় তিনি তা বলে দিলেন! এটাই জীবনের শক্তি, যা মৃত্যুচিন্তা থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী।