জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঋতুর গতি-প্রকৃতি বদলে যাচ্ছে। বাড়ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা। তাপদাহে অতিষ্ঠ হয়ে মানুষ খুঁজছে শীতল হাওয়া। অন্যদিকে শহরের পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুতায়ন হচ্ছে। সে কারণে দিন দিন বাড়ছে বৈদ্যুতিক পাখা বা ফ্যানের চাহিদা, যা বছরে বাড়ছে প্রায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হারে। চাহিদা মেটাতে বাজারে আসছে নতুন নতুন কোম্পানি। আমদানিও হচ্ছে। ফলে বছরে এর বাজারের আকার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকায়।
এ খাতের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, শুল্ক্ক ও কর হ্রাস, সহজ শর্তে ঋণ দেওয়াসহ সরকার কিছু নীতি-সহায়তা দিলে এ খাতের উৎপাদন ব্যাপক হারে বাড়বে। এর ফলে বাড়বে কর্মসংস্থান। দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রপ্তানিও বাড়ানো যাবে। বর্তমানে বিআরবি এবং ওয়ালটনের উৎপাদিত কিছু ফ্যান রপ্তানি হচ্ছে। তবে বৃহৎ পরিসরে রপ্তানি বাজার ধরতে আন্তর্জাতিক মানের ল্যাব স্থাপন করা একান্ত দরকার। দেশে উৎপাদিত ফ্যানের মান যাচাই করে বিএসটিআই। কিন্তু অনেক দেশ বিএসটিআইর সনদ গ্রহণ করে না, যা রপ্তানির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা। বিশ্ব স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক মানের ল্যাব খুবই প্রয়োজন। তাঁরা বলেন, ফ্যান রপ্তানিতে ১০ শতাংশ প্রণোদনা রয়েছে। এর পরিমাণ বাড়াতে হবে।

উৎপাদন পরিস্থিতি
এক সময় পাকিস্তান, ভারত ও চীন থেকে আমদানি করে বেশিরভাগ চাহিদা মেটানো হতো। কিন্তু এখন দেশের উৎপাদন থেকে চাহিদার বড় অংশ মিটছে। এ খাতের উদ্যোক্তারা জানান, যেখানেই বিদ্যুৎ পৌঁছেছে, সেখানেই ফ্যানের চাহিদা বেড়েছে। গত ৫ বছরে কমপক্ষে ১০টি ব্র্যান্ড যুক্ত হয়েছে এ খাতে। বর্তমানে ব্র্যান্ড ও নন-ব্র্যান্ডের ১২০টির বেশি কোম্পানি বৈদ্যুতিক পাখা উৎপাদন করে। এর মধ্যে বিআরবি, আরএফএল, সুপারস্টার, যমুনা, ওয়ালটন ও সিঙ্গার অন্যতম। এ ছাড়া ছোটখাটো বহু প্রতিষ্ঠান ফ্যান তৈরি করে থাকে। দেশের মোট চাহিদার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ উৎপাদন হয় দেশে। বাকি ২০ থেকে ৩০ শতাংশ আমদানি হয় ভারত, পাকিস্তান ও চীন থেকে। এক সময় বেশি আমদানি হতো পাকিস্তান থেকে। তবে কয়েক বছর ধরে ভারত ও চীন থেকে আমদানি বেড়েছে। উৎপাদকরা বলছেন, ভবিষ্যতে বৈদ্যুতিক পাখা আমদানির পরিমাণ কমে যাবে। কারণ দেশে নতুন নতুন কোম্পানি উৎপাদনে আসছে। এ ছাড়া বিদ্যমান কোম্পানিগুলো তাদের বিনিয়োগ ও উৎপাদনের পরিমাণ বাড়াচ্ছে। দেশে বেশি উৎপাদন হয় সিলিং বা ঝুলন্ত ফ্যান। টেবিল ফ্যানও উৎপাদন হয়। তবে টেবিল ফ্যানে এখনও আমদানিনির্ভরতা রয়েছে। চীন ও থাইল্যান্ড থেকে এ জাতীয় ফ্যান বেশি আসে।

ফ্যানের বাজার
দেশে বৈদ্যুতিক পাখার বাজারের আকার কত, তা নিয়ে একক উৎস থেকে তৈরি কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে এ খাতের উদ্যোক্তাদের ধারণা, ইলেকট্রিক্যাল খাতের বাজারের আকার প্রায় ৪৫ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে বৈদ্যুতিক পাখার বাজারের আকার হবে ১৫ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকার। নতুন নতুন বিনিয়োগ আসায় এর বাজার বড় হচ্ছে। দেশে বিদ্যুতায়নের ফলে পাখার চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে। বাড়ছে গরুর খামারও। এ কারণে ফ্যানের চাহিদা বছরে প্রায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হারে বাড়ছে।

কবে থেকে ব্যবহার হচ্ছে
এক সময় গরমের তীব্রতা থেকে বাঁচতে মানুষ হাতা পাখা ব্যবহার করত। মানুষের শ্রম ছাড়া কীভাবে সেই পাখা চালানো যায় তা নিয়ে চলতে থাকে নানা গবেষণা। হাতপাখার বদলে উদ্ভাবন হয় বৈদ্যুতিক পাখা। পণ্যটির উৎপাদনের সাল নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য রয়েছে। জানা গেছে, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্রথম বৈদ্যুতিক পাখা তৈরি হয় ১৮৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। ক্রোকার অ্যান্ড কারাটস ইলেকট্রিক কোম্পানির চিফ ইঞ্জিনিয়ার ড. এস এস হুইলার এই পাখা উদ্ভাবন করেন। পরের বছর থেকেই শুরু হয় উৎপাদন। এগুলো ছিল দুই ব্লেডওয়ালা টেবিল ফ্যান। প্রথম ঝুলন্ত বা সিলিং ফ্যান তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্রের ইক ডায়নামো অ্যান্ড ইলেকট্রিক কোম্পানি ১৯০৮ সালে। এরপর থেকে বিশ্বব্যাপী শুরু হয় ফ্যানের ব্যবহার। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এবং পরে পাকিস্তানের বৈদ্যুতিক পাখার ওপর নির্ভরশীল ছিল। তখন মিল্লাত ব্র্যান্ডের ব্যবহার ছিল বেশ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মিল্লাতের মালিকানা বাংলাদেশের অধীনে চলে আসে। এর পর থেকে সরকারিভাবে মিল্লাত ফ্যান উৎপাদন শুরু হয়। ক্রমান্বয়ে হিরা ও আমীন ফ্যান বাজারে আসে। সেই ধারাবাহিকতায় দেশে গড়ে উঠেছে বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠান, যারা উৎপাদন করছে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বৈদ্যুতিক পাখা।

ফ্যানের খুঁটিনাটি
বাজারে ১০ থেকে ১২ ধরনের ফ্যান পাওয়া যায়। যেমন- সিলিং, টেবিল ফ্যান, নেট ফ্যান, এগজস্ট ফ্যান, ওয়াল ফ্যান, স্ট্যান্ড ফ্যান, সোলার ফ্যান ইত্যাদি। দেশে ৫৬, ৪৮, ৩৬ এবং ২৪ ইঞ্চি- এই চার আকারের সিলিং ফ্যান উৎপাদন হয়। সাধারণত ফ্যানের পাখা তিন ধরনের মেটাল দিয়ে তৈরি হয়। যেমন- লোহা, অ্যালুমিনিয়াম আর ফাইবার। তিন, চার ও পাঁচ পাখার সিলিং ফ্যান বেশি দেখা যায় বাজারে। তবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় তিন পাখাবিশিষ্ট সিলিং ফ্যান। ফ্যানের আরপিএম বেশি হলে বাতাসও বেশি হয়। আরপিএম হলো 'রিভোলিউশন পার মিনিট' অর্থাৎ প্রতি মিনিটে তা কতবার ঘুরতে পারে। বাজারে ৩০০ থেকে ৩৮০ আরপিএমের ফ্যান বেশি দেখা যায়।

এসব ফ্যানের পাশাপাশি চার্জার ফ্যানও পাওয়া যায় বাজারে। কিছু চার্জার ফ্যান রয়েছে, যেগুলো সরাসরি বিদ্যুতেও চালানো যায়, আবার ব্যাটারিতেও চলে। বর্তমানে লোডশেডিংয়ের কারণে চার্জার ফ্যানের চাহিদা তুঙ্গে। এ কারণে দামও বেড়েছে প্রতিটি ফ্যানে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা।

দাম কেমন
পাকিস্তান থেকে আমদানি করা পাক পাঞ্জাব, পাক পারওয়াজ, জিএফসি ইত্যাদি ব্র্যান্ড এবং ভারতীয় হ্যাভেলস, উষা, ওরিয়েন্ট, লুমিনাস ব্র্যান্ডের সিলিং ফ্যানের দাম ৫ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। তবে স্ট্যান্ডযুক্ত আমদানি করা বড় ফ্যানগুলোর দাম আরও বেশি। এ ছাড়া ১ হাজার ৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বিভিন্ন দেশি ব্র্যান্ডের টেবিল ফ্যান পাওয়া যায়। দেশি সিলিং ফ্যানগুলোর দাম ১ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত। চার্জার ফ্যান পাওয়া যাবে ১ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকায়। এ ছাড়া এগজস্ট ফ্যান মিলবে ১ হাজার থেকে ২ হাজার টাকায়।

রপ্তানির সম্ভাবনা
এক সময় বৈদ্যুতিক তারও আমদানি হতো। এখন আমদানি করতে হয় না। বিশ্বের ৪২টি দেশে বিভিন্ন কোম্পানির বৈদ্যুতিক তার রপ্তানি হয়। বর্তমানে স্বল্প পরিসরে নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভারত, ভুটান, মালি, ইয়েমেনে বৈদ্যুতিক পাখা রপ্তানি হয়। তবে নীতিগত কিছু সিদ্ধান্ত নিলে এ খাতের রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন খাতসংশ্নিষ্টরা।

এ খাতের ব্যবসায়ীরা জানান, দিন দিন বাড়ছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা। তাছাড়া গ্রামে-গঞ্জে ঘরে ঘরে বিদ্যুতের সংযোগ পৌঁছে গেছে। ফলে প্রতিটি পরিবারে কমপক্ষে দুই থেকে তিনটি ফ্যান ব্যবহার করে থাকে। শিক্ষা, ব্যবসাসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠানেও ফ্যানের ব্যবহার বাড়ছে। তা ছাড়া দেশের আনাচে-কানাচে গড়ে উঠেছে শত শত গরুর খামার। এসব খামারে গরু পালনে বাড়ছে ফ্যানের ব্যবহার। এসব কারণে দেশে পণ্যটির চাহিদা বাড়ছে।

বাংলাদেশ ইলেকট্রিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি খন্দকার রুহুল আমীন সমকালকে বলেন, বৈদ্যুতিক পাখা তৈরির কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক্কহ্রাস, উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে ঋণ ও নীতিগত কিছু পদক্ষেপ নিলে এ খাতের ব্যাপক উন্নতির সম্ভাবনা রয়েছে। রপ্তানির বড় খাত হতে পারে এটি।

দেশে উৎপাদন বাড়িয়ে ফ্যানকে আরও সহজলভ্য করতে সরকারের সহায়তা প্রয়োজন উল্লেখ করে রুহুল আমীন বলেন, খন্দকার সিলিং ফ্যান নামে তাঁর নিজস্ব ব্র্যান্ড রয়েছে। দ্রুত এই ফ্যান বাজারে জায়গা করে নিচ্ছে। সরকারের সহায়তা পেলে তাঁর মতো ছোট উদ্যোক্তারা এ খাতের ব্যবসাকে আরও দ্রুত প্রসার করতে পারবেন।

যেসব সুবিধা চান ব্যবসায়ীরা
ক্যাপাসিটর, বেয়ারিং, ব্লেডশিট, সিলিকনশিট ইত্যাদি কাঁচামাল প্রয়োজন হয় ফ্যান তৈরিতে। যেগুলো আমদানি হয় চীন, ভারত, তাইওয়ানসহ কয়েকটি দেশ থেকে। এসব কাঁচামালের মধ্যে কোনো কোনোটিতে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত আমদানি শুল্ক্ক দিতে হয়। এ কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। দীর্ঘদিন ধরে এ খাতের ব্যবসায়ীদের দাবি- কাঁচামালের শুল্ক্ক ফেরত দিতে হবে। নতুবা উৎপাদন খরচ কমবে না। আর উৎপাদন খরচ না কমলে রপ্তানি বাজারে চীন ও ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা সম্ভব নয়। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক মানের ল্যাব স্থাপন করতে হবে। যেখান থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে উৎপাদিত ফ্যানের স্বীকৃতি পাওয়া যাবে। তখন রপ্তানি বাজারে বাধা থাকবে না। ল্যাব স্থাপনে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।

বাংলাদেশ ইলেকট্রিক্যাল মার্চেন্ডাইজ ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ও আর আর ইলেকট্রিক ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক মোশাররফ হোসাইন ভূঁইয়া সমকালকে বলেন, তৈরি পোশাকের বিকল্প রপ্তানি খাত নিয়ে ভাবতে হবে। রপ্তানিপণ্যে বৈচিত্র্য আনা খুবই জরুরি। দেশে প্রচুর বৈদ্যুতিক পাখা উৎপাদন হয়। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে সেগুলো রপ্তানি করা সম্ভব।