টঙ্গী রেলস্টেশনে ছুটে বেড়ানো দুরন্ত ছেলে রিফাত। মাসখানেক আগে রাগের মাথায় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। চলতে চলতে এক পর্যায়ে টঙ্গী স্টেশনে এসে থমকে দাঁড়ায়। সে জানে না, কীভাবে বাড়ি ফিরবে, কোথায় সে এসে পড়েছে। রেলস্টেশনে থাকা আর পাঁচটা শিশুর মতোই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অনাদরে দিন কাটতে থাকে। কিছুদিন পর পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা একটি মানবিক সংগঠন লিডো রিফাতকে খুঁজে পায়। রিফাতের কাছ থেকে তার হারিয়ে যাওয়ার গল্প শোনে। এবং পরে সংগঠনের নির্বাহী প্রধান ফারহাদ হোসেন 'নিখোঁজ' নামক একটি অ্যাপে শিশুটির হারিয়ে যাওয়ার বিজ্ঞাপন দিয়ে ছবি পোস্ট করেন। কিছুদিনের মধ্যেই রিফাতের পরিবারের লোকজন তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তথ্যপ্রমাণ বিশ্নেষণ করে প্রমাণিত হয় রিফাত তাঁদেরই হারিয়ে যাওয়া সন্তান। কুমিল্না থেকে রিফাতের পরিবার এসে রিফাতকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।

নিখোঁজ অ্যাপ সম্পর্কে ফারহাদ হোসেন বলেন, 'এটি একটি সময়োপযোগী উদ্ভাবন। পথশিশুদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছি। গত ১৮-১৯ মাসে আমাদের সংগঠন ১২০০ পথশিশুকে উদ্ধার করেছে, যার মধ্যে মাত্র ২৫০ জনকে তাদের পরিবারে ফিরিয়ে দিতে পেরেছি আমরা। এই অ্যাপ সম্পর্কে বেশিরভাগ মানুষই অবগত নয়, তবুও এই সময়ের মধ্যে কয়েকটি শিশুকে তার পরিবারের কাছে ফেরাতে আমাদের সাহায্য করেছে এ অ্যাপ। আশা করি, অ্যাপটির ব্যবহার সম্পর্কে সবাই অবগত হলে সহজেই হারিয়ে যাওয়া শিশুদের তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে।'
যেভাবে কাজ করে 'নিখোঁজ'

ফেস রিকগনিশন প্রযুক্তির মাধ্যমে কাজ করা নিখোঁজ অ্যাপটিতে রয়েছে দুটি অপশন। প্রথমটি হচ্ছে- 'অ্যাড চিলড্রেন', অর্থাৎ হারিয়ে যাওয়া শিশু সম্পর্কে ছবিসহ বিস্তারিত তথ্য আপলোড করা। দ্বিতীয় অপশনটি 'ফাইন্ড চিলড্রেন'। কেউ যদি হারিয়ে যাওয়া কোনো শিশুর সন্ধান পান, তাহলে শিশুটিকে স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দিতে চাইলে এই অপশনে ছবি আপলোড করে সার্চ দিতে হবে। হারিয়ে যাওয়া শিশুটি সম্পর্কে আগে থেকে তথ্য আপলোড করা থাকলে তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে সহজেই। এ অ্যাপের নির্মাতারা জানান, হারিয়ে যাওয়া বা খুঁজে পাওয়া মানুষের ছবি দিয়ে সার্চ দিলেই অ্যাপটি নির্ভুলভাবে খুঁজে দেবে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে। অ্যাপটির যৌথ উদ্ভাবক মইনুল ইসলাম ও হাসান শাহরিয়ার। মইনুল ইসলাম সমকালকে বলেন, 'শিশুদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে হারিয়ে যাওয়া শিশুদের বিষয়টি আমাদের ভাবিয়ে তোলে। সেখান থেকেই এই অ্যাপ তৈরির পরিকল্পনা।'

গত বছর জুন মাসে অ্যাপটি গুগল প্নেস্টোরে আসে। প্রতিষ্ঠাতারা অ্যাপটিকে পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে নিয়ে কাজ করছেন। মানুষের সাড়া পেলে সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষের সহায়তা নিয়ে আরও বড় পরিসরে এগোনোর পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের।

নিখোঁজ অ্যাপ শুধু শিশুদের খুঁজে পেতে সহযোগিতা করবে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে উদ্যোক্তারা জানান, প্রাথমিকভাবে শিশুদের বিষয়টি ফোকাস করা হয়েছে। যেহেতু শিশুদের হারানোর সংখ্যাটা বেশি। এর পাশাপাশি প্রতিবন্ধী, বৃদ্ধদেরও ফোকাস করা হবে। ভবিষ্যতে যে কোনো বয়সী মানুষ হারিয়ে গেলে খুঁজে পাওয়ার জন্য সহায়তা করবে নিখোঁজ।

অ্যাপটি সম্পর্কে উদ্ভাবক মইনুল ইসলাম বলেন, 'বিষয়টি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। সাধারণ মানুষের বোঝার ও ব্যবহারের স্বার্থে অ্যাপে বেশি তথ্য চাওয়া হয়নি। পুরো বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় এর সঙ্গে পুলিশের সহায়তা প্রয়োজন হবে। জিডির কপি এবং যিনি হারিয়ে যাওয়া শিশুর খোঁজ পেতে তথ্য আপলোড করবেন, তাঁর বিস্তারিত তথ্যও চাওয়া হবে। সে বিষয়ে কাজ চলছে। অন্যদিকে, যিনি হারিয়ে যাওয়া শিশুকে পেয়ে ফিরিয়ে দিতে চাইবেন, তাঁর তথ্যও দিতে হবে।' এ ছাড়া হারিয়ে যাওয়া শিশুকে স্বজনদের কাছে হস্তান্তরের বিষয়টি থানা বা দায়িত্বশীল কোনো সংস্থার মাধ্যমে করা হবে বলে জানান তিনি। অ্যাপটির উদ্ভাবকদের দাবি, সরকারি সহযোগিতা পেলে তাঁরা কাজে অনেক অগ্রগতি আনতে পারবেন।

অন্যদিকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদী বলেন, 'বাংলাদেশে এর আগে এমন অ্যাপের উদ্ভাবনের কথা শুনিনি। চমৎকার উদ্যোগ। যে কোনো উদ্ভাবনে সরকার সহায়তা করে থাকে। এ ক্ষেত্রে প্রমোটের জন্য উদ্ভাবকদের আইসিটি বিভাগের হেড অফিসে এসে আইসিটি প্রজেক্ট বা মোবাইল অ্যাপস অ্যান্ড গেমস বিভাগে যোগাযোগ করার আহ্বান জানাই। অ্যাপটির ব্যবহার জাতির জন্য মঙ্গলজনক হলে অবশ্যই জাতীয় পর্যায়ে এর ব্যবহার ছড়িয়ে দিতে সরকার সহায়তা করবে।'

বিষয় : নিখোঁজ অ্যাপ

মন্তব্য করুন