নজিরবিহীন তাপদাহে পুড়ছে প্রায় অর্ধেক বিশ্ব। তীব্র তাপে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশসহ আমেরিকা, আফ্রিকাতেও। জলবায়ু পরিবর্তনে বিশ্বের প্রতিবেশ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। এ নিয়ে লিখেছেন শাহেরীন আরাফাত

গত বছর জুলাইয়ে জার্মানির পশ্চিমাঞ্চল, বেলজিয়ামের পূর্বাঞ্চল, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, লুক্সেমবার্গ ও সুইজারল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলে অস্বাভাবিক মাত্রায় বৃষ্টিপাত ও বন্যার কারণে ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হয়। শুধু জার্মানি ও বেলজিয়ামে অন্তত ২২০ জনের মৃত্যু হয়। সেই ইউরোপ এখন পুড়ছে নজিরবিহীন তাপদাহ আর দাবানলে।

ব্রিটেনে গত ১৯ জুলাই (মঙ্গলবার) প্রথমবারের মতো তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে, যা সর্বোচ্চ তাপমাত্রার নতুন রেকর্ড। এর আগে ২০১৯ সালে যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছিল। সে সময় পারদ চড়েছিল ৩৮ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। লন্ডনসহ পুরো ব্রিটেনের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা এই তাপদাহে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। লন্ডনের চারপাশের বেশ কয়েকটি এলাকায় দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে আগুন। স্পেনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ১০ থেকে ১৮ জুলাই পর্যন্ত দেশটিতে তাপজনিত সমস্যায় কমপক্ষে ৫১০ জন মারা গেছেন। অন্যদিকে পর্তুগালের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ৭ থেকে ১৭ জুলাইয়ের মধ্যে দেশটিতে তাপজনিত কারণে ৬৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।

এ অবস্থা শুধু ব্রিটেন বা ইউরোপের নয়। অস্বাভাবিক তাপে, গরমে পুড়ছে ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকা, এশিয়ার বিশাল অংশ। বহুদেশে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পেরিয়েছে। কিছু অঞ্চলের তাপমাত্রা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। তাপদাহের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দাবানল। দাবানল ছড়িয়ে পড়েছে ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল, ব্রিটেন, তুরস্ক, জার্মানি, মরক্কো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস, ক্যালিফোর্নিয়া, কলোরাডো, ওকলাহোমা, আরকানসাসহ কয়েকটি শহরে। পশ্চিম ইউরোপের অনেক সরকার নীরব আত্মসমর্পণই করেছে বলা চলে। ফ্রান্সের জিরোন্দে বনের প্রায় ১৭ হাজার হেক্টর এলাকা দাবানলে পুড়ে ধ্বংস হয়েছে। স্পেনে পুড়ে ছাই হচ্ছে সেখানকার ৭০

হাজার হেক্টর বনভূমি। আগুন ছড়িয়েছে আবাসিক এলাকাতেও। পর্তুগালেও একই পরিস্থিতি।
খরা পর্যবেক্ষণ সংস্থার হিসাবে, ক্যালিফোর্নিয়ার ৮৬ শতাংশ খরায় ভুগছে। দাবানল বাড়তে থাকায় বিশ্বের সবেচেয়ে বড় ও পুরোনো গাছ জায়ান্ট সেকুইয়ার বন পুড়ে যাচ্ছে। ক্যালিফোর্নিয়ার ইয়োসেমাইট ন্যাশনাল পার্কে আছে এই গাছের সবচেয়ে বড় বন। ইতোমধ্যে দেড় হাজার হেক্টরেরও বেশি বনাঞ্চল পুড়েছে।
এদিকে, তাপদাহের কারণে রেড অ্যালার্ট জারি হয়েছে চীনের বাণিজ্যিক রাজধানী সাংহাইসহ ৮৬টি শহরে। তাপদাহের প্রভাবে সেখানকার রাস্তা, এমনকি বাড়ির ছাদেও ফাটল ধরতে দেখা গেছে।

হুমকিতে মানবজাতি
প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মানবজাতির অর্ধেক ভয়ংকর বিপদে রয়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের অভ্যাস বদলাতে না পারলে কোনো দেশই জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে পারবে না। জার্মানির বার্লিনে জাতিসংঘের উদ্যোগে আয়োজিত ৪০ দেশের জলবায়ু সম্মেলনে গত ১৮ জুলাই এ কথাগুলো যখন বলছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, তখনই তাপদাহ আর দাবানলে পুড়ছে অর্ধেক বিশ্ব। গুতেরেস বলেন, 'আমাদের সামনে দুটি বিকল্প থেকে একটি পছন্দ বেছে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে হয় একযোগে উদ্যোগ নিতে হবে, নয়তো একযোগে আত্মহত্যা করতে হবে।'

বাড়ছে শুস্কতা, বাড়ছে দাবানল
গত বছরের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সের (পিএনএএস) প্রকাশিত গবেষণায় দেখা যায়, দাবানলের কারণে ২০০১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চলে বছরে গড়ে সাড়ে ১৩ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা ধ্বংস হয়েছে; যা ১৯৮৪ থেকে ২০০০ সালের চেয়ে দ্বিগুণ। মে থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে উচ্চ শুস্ক দিনের সংখ্যা ২০০১ থেকে ২০০৮ সালের চেয়ে ৯৪ শতাংশ বেড়েছে। মার্কিন গবেষকদের একটি দল 'ভ্যাপর প্রেশার ডিফিসিট' (ভিপিডি) নিয়ে কাজ করছে। এর মধ্যমে বাতাস কতটা শুস্ক তা নির্দেশ করে। বায়ুমণ্ডলে প্রকৃতপক্ষে উপস্থিত পানির পরিমাণ এবং বায়ুমণ্ডল সর্বাধিক কী পরিমাণ পানি ধরে রাখতে পারে, তার মধ্যে পার্থক্য উপস্থাপন করে ভিপিডি। ঘাটতি যত বেশি হবে, মাটি এবং গাছপালা থেকে বাতাসে তত বেশি পানি টানা হয়। এরপর মাটি-গাছপালা শুস্ক হয়ে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, যা ক্রমবর্ধমান আগুনের জন্য সহায়ক। গবেষণায় দেখা যায়, শুস্কতার পরিমাণ গড়ে ৩২ শতাংশ বেড়েছে। া