সমকাল :অর্থনীতির জন্য স্টার্টআপ কেন গুরুত্বপূর্ণ?
মিনহাজ আনওয়ার :২০১৪ সালে হোয়াটসঅ্যাপ যখন মালিকানা বদল করে ফেসবুকের কাছে যায়, তখন হোয়াটসঅ্যাপের পরিসর ছিল ৫০ জন মানুষের চেয়ে কম এবং পাঁচ বছরেরও কম ছিল স্টার্টআপটির বয়স। এরকম একটি কোম্পানি কিনে নিতে ফেসবুকের তখন খরচ হয় প্রায় ১৯ বিলিয়ন ডলার। ওই সময় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও ছিল প্রায় ১৯ বিলিয়ন ডলার। এমন ১০-২০টি স্টার্টআপ যদি কোথাও থাকে, অর্থনীতিতে তারা কী রকম অবদান রাখতে পারে, তা বলাই বাহুল্য।

৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাওয়া পুরোনো একটি খাত তৈরি পোশাক শিল্প প্রায় ৪০-৪৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান করেছে। আর গত ৫-৭ বছরে আমাদের দেশীয় স্টার্টআপগুলো মিলে প্রায় ১৫ লাখ মানুষের শ্রমবাজার তৈরি করেছে। স্টার্টআপগুলো যদি পাঁচ বছরে এখানে পৌঁছতে পারে, তাহলে ৪০ বছরে কোথায় যাওয়া সম্ভব, তা ভাবুন। আবার চাকরির মান ও পারিশ্রমিকের তুলনাতেও পার্থক্য এখানে বিস্তর। এখানে আমদানি খরচের বিষয়টিও তেমন নেই।
সবকিছু মিলিয়ে, স্টার্টআপ খাত পৃথিবীর যে কোনো দেশের অর্থনীতিতে অল্প সময়ে সবচেয়ে বেশি প্রভাব তৈরি করতে পারে। যেসব বড় কোম্পানি এখন পৃথিবীতে প্রভাব বিস্তার করছে, তাদের অনেকেই এক সময় স্টার্টআপ হিসেবেই শুরু করেছিল। আমাদের স্টার্টআপরাও আগামীতে বাংলাদেশকে বদলে দিতে পারে।

সমকাল :দেশে স্টার্টআপের ইকোসিস্টেম তৈরির যাত্রাটা কেমন ছিল?
মিনহাজ আনওয়ার :ব্রিটিশ ইনকিউবেশন অ্যাসোসিয়েশনের একটা রিপোর্ট থেকে আমি ইনকিউবেটর ও এন্টারপ্রেনারশিপ সম্পর্কে ধারণা পাই। পরে আমেরিকান ইনকিউবেশন অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হই। ওখান থেকে ধারণা পেয়ে বাংলাদেশে ইকোসিস্টেম তৈরির কাজ শুরু করি। প্রথমে আমরা একটা প্রাইভেট প্লাগ অ্যান্ড প্লে ইনকিউবেটর সেটআপ করতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে আমরা বুঝতে পারলাম যে, শুধু বাইরের অনুকরণে একটা ফ্রেমওয়ার্ক এখানে শুধু আনলেই হবে না, তরুণ জনগোষ্ঠীকে বোঝাতে হবে, তাদের কমিউনিটিতে কানেক্ট করতে হবে। তারপর সারা বাংলাদেশে আমরা স্টার্টআপ বাংলাদেশ নামে কানেক্টিং একটা ইভেন্ট করি, যেখান থেকে আমাদের স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম তৈরির যাত্রা মূলত শুরু হয়।

সমকাল :এখন ইকোসিস্টেম আসলে কোথায় আছে, লক্ষ্য কতটুকু অর্জিত হলো?
মিনহাজ আনওয়ার :অন্তত ২০ বছর না হলে একটা দেশের ইকোসিস্টেমে পরিপকস্ফতা আসে না। আমরা গত ১৩ বছর ধরে কাজ করছি, সে হিসেবে আমরা আসলে মাঝামাঝি জায়গাটায় আছি। বাংলাদেশে আমরা এখন থার্ড জেনারেশন অব স্টার্টআপকে দেখছি। প্রথম জেনারেশন ছিল বিডিজবস থেকে বিকাশের শুরুর পর্যন্ত সময়টা। সে সময়ে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা বা বাংলাদেশের ভেতরে কোনো ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ছিল না।
দ্বিতীয় প্রজন্মে এলো চালডাল সেবা। তারা কোনো না কোনোভাবে দেশে বা দেশের বাইরে থেকে কিছু প্রাতিষ্ঠানিক সাপোর্ট পেয়েছিলেন। চালডালের ক্ষেত্রে ওয়াই কম্বিনেটর, সেবার ক্ষেত্রে গ্রামীণফোন এক্সিলারেটরের কথা উল্লেখ করা যায়। ভেঞ্চার ক্যাপিটাল, এঞ্জেল ইনভেস্টরদের থেকে তারা ফান্ড পেয়েছে। তাদের মডেলটা হয়তো দেশের বাইরে কোথাও না কোথাও আছে, যেটি দেশে তাদের মতো করে তারা ইমপ্লিমেন্ট করেছেন। দেশের বাজারের জন্য তৈরি করতে অনেক শ্রম দিতে হয়েছে।

তৃতীয় প্রজন্মের স্টার্টআপের উত্থান হচ্ছে ওয়ানথ্রেড, আইপেজ, এয়ারওয়ার্ক বা এরকম স্টার্টআপদের হাত ধরে, যারা বৈশ্বিক প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করছে। তাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা এরকম যে, বাংলাদেশের ফাউন্ডার বাংলাদেশে বসে বিশ্বে বাজার তৈরি করছে অথবা দেশের বাইরের একজন কো-ফাউন্ডারের সঙ্গে রিমোটলি কাজ করে একটি পণ্য বা সেবার প্ল্যান করছে। এই প্রজন্ম নিয়ে আমি সবচেয়ে আশাবাদী। তারা বাংলাদেশের স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমকে একটি অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে। তারা একটা দারুণ সংখ্যার চাকরির শ্রমবাজার তৈরি করেছে এবং বাইরে থেকে একটা ভালো অঙ্কের বিনিয়োগও নিয়ে এসেছে। আশা করছি, এই দুটি সংখ্যাই ভবিষ্যতে বাড়তে থাকবে। এর মাধ্যমে আরও মানুষ উপকৃত হবেন, অর্থনীতি উপকৃত হবে।

স্টার্টআপ বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অনেক কাজ হয়েছে। যেমন- অল্টারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট অ্যাক্ট হয়েছে ২০১৫ সালে। স্টার্টআপ বাংলাদেশ নামে একটি সরকারি মালিকানাধীন ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি হয়েছে, যারা এখন বাংলাদেশি স্টার্টআপগুলোতে বিনিয়োগ করা শুরু করেছে। গত বছরে বঙ্গবন্ধু ইনোভেশন গ্র্যান্ট নামে একটা আন্তর্জাতিক মানের প্রতিযোগিতা হলো। যেখানে আমাদের দেশের একটি তৃতীয় প্রজন্মের স্টার্টআপ চূড়ান্ত পর্বে বিজয়ী হয়। এখন এসএমই বোর্ড অথবা অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ড নিয়ে যে আলোচনাটা হচ্ছে এবং সরকার যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে, সেগুলো বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে সাহায্য করবে।

এরই মধ্যে অনেক আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ভেঞ্চার ক্যাপিটাল যেমন- সেকোয়া ক্যাপিটাল, টাইগার ক্যাপিটাল, এক্সেল পার্টনারস, গোল্ডেন গেট ভেঞ্চার্স বাংলাদেশে বিনিয়োগ করছে। আমাদের স্টার্টআপরা বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন পরিচিতি তৈরি করেছে। অনেক প্রবাসী বাংলাদেশিও স্টার্টআপগুলোতে বিনিয়োগ করছেন ও সহায়তা দিচ্ছেন। ভালো পরিবর্তনগুলো শুরু হয়েছে। আমাদের যেতে হবে আরও অনেক দূর। আশা করি, আমরা সেখানে যাব।

সমকাল : নতুনদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
মিনহাজ আনওয়ার :স্টার্টআপের এই জগৎটা খুব মসৃণ নয়। এই পথে লেগে থাকাটা খুব জরুরি। তার পাশাপাশি গ্রাহক, বাজার, প্রতিযোগিতা- এগুলো সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা খুব প্রয়োজন। ঠিকমতো জেনেশুনে মাঠে নামতে হবে। রিসার্চ এবং ভ্যালিডেশনের বিষয়গুলোতে আগে কাজ করে এর পরেই মাঠে কিংবা মার্কেটে যাওয়া উচিত। প্রতিষ্ঠাতাদের প্রোফাইল ছাড়াও যে জিনিসগুলো ইনভেস্টররা দেখেন তার মধ্যে রয়েছে- পণ্যের স্ট্যাবিলিটি বা টেকনোলজি, প্রতিযোগিতা, সম্ভাবনা ইত্যাদি। সততা ও বিনয় খুব বড় উপাদান সফলতা পাওয়ার জন্য।