এটি কবিতা বিষয়ে যতীন সরকারের চিন্তাভাবনা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা। কবিতার ব্যাখ্যা ও জিজ্ঞাসার বিস্তার অসীম। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যাখ্যাতা ও চিন্তক হিসেবে কবিরাই অগ্রগণ্য। যতীন সরকার মননশীল লেখক ও জ্ঞানসাধক- নিজে কবি নন, কিন্তু কবিতা বিষয়ে আছে তাঁর নিবিষ্ট অবলোকন ও অনুপুঙ্খ বিশ্নেষণ; যা পাঠে কবিতা বিষয়ে তাঁর স্পষ্ট ধারণার বহিঃপ্রকাশ দেখি। তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ 'সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা'তে কবিতা বিষয়ে কয়েকটি প্রবন্ধ আছে- উত্তরকালে কবি ও কবিতা নিয়ে তিনি আরও লিখেছেন এসব লেখায় তাঁর নন্দনচিন্তা, উত্তর ঔপনিবেশিক দোলাচলে বাংলা কবিতার স্বদেশ সম্পৃক্তি ও বিচ্ছিন্নতা, কবিতায় বা লেখায় মাটি ও মানুষের সঙ্গে সাঁকো বাঁধার প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে। কবিতা বিষয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণের ভঙ্গি শুধু উপরিতল দেখা নয়, বরং অনেক গভীরে গিয়ে বিশ্বকবিতার আবহে বাংলা কবিতা স্বরূপ অন্বেষণের চেষ্টা। এতে সময়ের অনুভব যেমন আছে, তেমনি আছে দূরবীক্ষণের চেষ্টা। সমকালীন কবিতার বৈশিষ্ট্য অনুধাবনে তাঁর এসব লেখা তাৎপর্যপূর্ণ। সবকিছু মিলে তাঁর কবিতা ভাবনার বহুদর্শী অবয়বের কিছু অংশ ধরার তৎপরতা আছে এই লেখায়।
২.
কবিতার ব্যাখ্যা বিজ্ঞানের মতো স্বতঃসিদ্ধ নয়। মনোজগতের সংগোপন সক্রিয়তার ভূমিকা এখানে গুরুত্বপূর্ণ, যার সঙ্গে সমাজ-অভিজ্ঞতার সংশ্নেষ ঘটে। যতীন সরকার জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কথন 'সকলেই কবি নয় কেউ কেউ কবি'- এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে প্যাভলভীয় দ্বান্দ্ব্বিক বস্তুবাদী মনোবিজ্ঞানকে অবলম্বন করেছেন। তাঁর মতে, উপরিউক্ত জিজ্ঞাসা উত্তর খুঁজতে 'প্যাভলভীয় মনোবিজ্ঞানের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালে একেবারে বিমুখ হয়ে ফিরে আসতে হবে না।'
প্যাভলভের অনুসরণে যতীন সরকার কবিতাকে সজ্ঞান সৃষ্টি মনে করেন। অন্যদিকে ফ্রয়েডপন্থিরা মনে করেন উচ্চতর কগনিটিভ প্রক্রিয়া অবচেতনে ঘটে। ফ্রয়েডীয় মনোবিজ্ঞানে নির্জ্ঞানের এই ধারণা যতীন সরকারের বিবেচনায় বিভ্রান্তিকর, তাই নাকচ করার পক্ষপাতী। তাঁর কাছে 'নির্জ্ঞানপন্থি মনোবিজ্ঞানী আর দৈববিশ্বাসী অধ্যাত্মবাদীর মধ্যে স্বরূপগত কোনো পার্থক্য নেই।' অন্যদিকে তিনি আচরণবাদী মনোবিজ্ঞানের উদ্দীপক ও সাড়া ( stimulus and response)-এর তত্ত্বকেও যান্ত্রিক বিবেচনায় সন্তোষজনক ভাবেননি। এ আলোচনায় তিনি প্যাভলভের সাংকেতিক ব্যবস্থাকে ( signaling system) গুরুত্ব দিয়েছেন। কারণ স্নায়ুপ্রক্রিয়ার প্রখর ও শক্তিশালী সংকেতের মাধ্যমেই বহির্জগতের নানা রূপের সঙ্গে কবি বা শিল্পীর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয়- যার প্রতিফলন ঘটে চৈতন্যে। এতে বহির্জগতের চেতন-অবচেতনের সঙ্গে একাত্মতা ঘটে। তবে মস্তিস্ক বা হৃদয়ের সংবেদন নয়, সমাজ পরিবেশের জাগতিক অভিজ্ঞতার আলোকে অনুশীলনকে কবিতা সৃষ্টির জন্য তিনি আবশ্যিক মনে করেন। এই দ্বান্দ্ব্বিক মনোবিজ্ঞানের আলোকে জীবনানন্দ দাশের কবিতাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তমান সমাজ বাস্তবতার প্রতিফলনে চৈতন্যের উদ্দীপনজাত কবিতার নানা অভিব্যক্তি প্রত্যক্ষ করেছেন।
জীবন দর্শন ও আত্মদর্শন দুটোই তাঁর কাছে দেখা ও ফিলোসফির সমাহার। 'পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু দর্শন' গ্রন্থের ভূমিকায় তাঁর জীবনবোধের এই উৎসারণ স্পষ্ট। কবিতা-ভাবনাও তিনি এর বাইরে নন। তাঁর বস্তুগত ও মনোলোকে এই বোধ যুগপৎ সক্রিয়। কিন্তু এই সক্রিয়তায় পক্ষপাত যে কলাকৈবল্যবাদের চেয়ে মানবমুক্তিতে বেশি, সেটি তাঁর কবিতাবিষয়ক রচনার বিষয়সূচি ও ব্যাখ্যা দেখলে আরও স্পষ্ট হয়। সংগত কারণেই তাঁর কাব্য আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে কবি রামপ্রসাদের ক্ষোভ ও প্রতিবাদ, রবীন্দ্রনাথের উপেনের হাহাকার, উপনিবেশ-উত্তর আফ্রিকার কবিতা, বাংলার প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতী, কাজী নজরুল ইসলাম, কালিদাস রায়, শামসুর রাহমানের কবিতা, শাহ আবদুল করিমের সর্বহারার দুঃখ জয়ের মন্ত্র ইত্যাদি। রফিক আজাদের কবিতা 'চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া' নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আর্কেডিয়ার মডেল খুঁজে ফেরেন সাম্যবাদ কবিদের শোষণমুক্ত পৃথিবীর কল্পনায়, সমাজতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থায়। সেখানে তিনি বুর্জোয়া আধুনিকতাকে 'ফলহীন পোড়ো জমি' হিসেবে দেখেন। সেই সঙ্গে তিনি পশ্চিমী দুনিয়ার চৈতন্যলোককে বিজ্ঞানবিমুখ আখ্যা দিয়ে 'পরাবাস্তববাদ থেকে অস্তিত্ববাদ পর্যন্ত পশ্চিমী শিল্পদর্শন তথা জীবনদর্শনগুলো হয় বিজ্ঞানবিরোধী নয় অপবিজ্ঞান আশ্রয়ী' বলেছেন। তবে এ আলোচনার ইতিটানা যাবে না। কারণ, অন্যত্র দেখি তাঁর আলোচনায়, যেখানে তিনি জীবনানন্দ দাশের কবিতা আলোচনা করতে গিয়ে পরাবাস্তব ইমাজিনেশনকে এমপ্যাথির আলোকেও বিশ্নেষণ করেছেন। তবে এসব বাদ-মতবাদকে তিনি সম্পূর্ণ নাকচ করেছেন মনে হয় না, এক আলোচনায় এ-ও বলেছেন 'শিল্প-প্রকরণরূপে সুররিয়ালিজম বা পরাবাস্তববাদের উদ্ভব সংশ্নিষ্ট হয়েছিল একটি বিদ্রোহী প্রতিবাদী চেতনা এবং সেই চেতনা সক্রিয় ছিল পরাবাস্তবতাবাদীদের পূর্বসূরি প্রতীকবাদীদের মধ্যেও। প্রসঙ্গক্রমে রুশ বিপ্লবের উত্তাল সময়ে এবং পরবর্তী দিনগুলিতে খোলস ছেড়ে ব্লক, লুই আঁরাগ, পল এলুয়ার, পাবলো নেরুদার মতো অনেকের বেরিয়ে আসার উদাহরণ দিয়েছেন।
কবিতা চিন্তায় তিনি সাম্যবাদী চিন্তাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি নির্দি্বধায় বলেন : 'শ্রমিক র ভাবাদর্শ ছাড়া এ যুগের কবির জন্য আত্মশুদ্ধির আর কোনো পথ খোলা নেই। যে দর্শনের ওপর এই ভাবাদর্শের ভিত গাড়া, সেই দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ একটি অখণ্ড বিশ্বদর্শন, জগৎ, জীবন সম্পর্কীয় কোনো কিছুই এ দর্শনের আওতার বাইরে নেই। ইতিহাস-বীক্ষায় এ দর্শন সংগ্রামকে প্রাধান্য দেয়, শোষক উৎখাত করে সর্বহারার রাজত্ব প্রতিষ্ঠা এ দর্শনের লক্ষ্য, ভাবের বদলে বস্তুকেই প্রাথমিক ও মুখ্য উপাদান হিসেবে গ্রহণ করে এ দর্শন, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ সম্পর্কে এ সবই সত্য।
তবে তিনি যা বলেছেন, সেটি একরৈখিক বা সাম্যবাদী প্রেসক্রিপশনের আকারে নয়। কবিতা ও সাম্যবাদ ধারণার সম্পর্কসূত্রে এই দ্ব্যর্থবোধকতা সত্ত্বেও কবিতা নিয়ে তাঁর নন্দনভাবনা সার্বিকভাবে মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বের অনুবর্তী নয়। প্রসঙ্গত তিনি লেনিনের উদাহরণ দিয়েছেন। তলস্তয় সম্পর্কে ভাববাদী, প্রতিক্রিয়াশীলতার সমর্থক, ইত্যাকার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে লেনিন তাঁকে 'রুশ বিপ্লবের দর্পণ' বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা জানি, শিল্পসাহিত্যকে বিপ্লবের হাতিয়ার হিসেবে দেখার বোধ থেকে লেনিনও একসময় দলীয় আনুগত্যহীন লেখক (non-partisan writers) লেখক ও সাহিত্যিক মহাপুরুষ (literary supermen) ধিক্কার দিয়েছিলেন। অনেকের ধারণা, এ নিয়ে লেনিন দোটানায় ছিলেন। তবে লেনিন পরবর্তী সময়ে স্টালিনের দক্ষিণহস্ত বলে খ্যাত আন্দ্রেই ঝুদানভ শিল্পসৃষ্টিতে যে নতুন ধারণার নির্দেশ করেন তাতে শিল্পসাহিত্যের ওপরে একধরনের মতাদর্শিক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। সাহিত্যকে সামন্তবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল, অশুদ্ধ, বুর্জোয়া নানা তকমায় মোড়ানো হয় তখন, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অসহিষুষ্ণতার প্রকাশ ঘটে, যার টেউ এসে লাগে বাংলায়ও। বস্তুত, একদল বামপন্থি মার্কসীয় চেতনার মানবিক দিক উপেক্ষা করে একে অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদ হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। তলস্তয়ের মতো তৎকালীন পূর্ববাংলায়ও একদল বামপন্থি রবীন্দ্র বিরোধিতায় নেমেছিলেন, তবে তা হালে পানি পায়নি তারা। ষাটের দশকের বাংলাদেশ রবীন্দ্র বিরোধিতায় মূলে ছিল সাম্প্রদায়িক অনুষঙ্গ- ফলে এ ধরনের বিরোধিতার প্রতিরোধে যে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চেতনার ঐক্য গড়ে ওঠে, তাতে রবীন্দ্রনাথ জনমানসে আরও মহিমান্বিত হয়ে ওঠেন। পশ্চিমবঙ্গে এ ধরনের ঘটনার উদাহরণ অনেক। শুধু রবীন্দ্রনাথ নন, অনেক লেখকই প্রতিক্রিয়াশীল বলে গণ্য হলেন। বুদ্ধদেব বসু, এমনকি মার্কসবাদী হওয়া সত্ত্বেও বিষুষ্ণ দেও অভিযুক্ত হলেন কট্টরপন্থিদের দ্বারা। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নামে চীনে শিল্প-সংস্কৃতির কণ্ঠরোধের প্রচেষ্টার প্রভাবও এসে পড়ল বাংলায়। শত্রু খতমের নামে শিল্প-সংস্কৃতিকে অবদমনের চেষ্টা চলল। যতীন সরকার এ ধরনের খণ্ডিত ভাবনাকে প্রশ্রয় দেননি তাঁর লেখায়। বরং কবিতার শিল্পবোধ ও বস্তুসত্য দুইয়ের সমন্বয়ে দেশজ সংস্কৃতির সেতুবন্ধ গড়ে তুলতে চেয়েছেন।
আশির দশকে 'বাঁধতে পারিনি সাঁকো' নামে যতীন সরকার একটি প্রবন্ধ লেখেন। কবি শামসুর রাহমান এই নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন, যার ভিত্তিতে তাঁর এই লেখা। কবিতার শেষে শামসুর রাহমান লিখেছেন- 'নিপুণ বাঁধতে গিয়ে সাঁকো তবু আমি/ ব্যর্থ হয়ে যাই/ বারবার ব্যর্থ হয়ে যাই। শামসুর রাহমান বাংলাদেশের কবিতার প্রথম আধুনিক কবি, নগর যন্ত্রণার পাশাপাশি বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের বহু চড়াই-উৎরাইয়ের সমান্তরালে গেছে তাঁর কবিতা। সেই শামসুর রাহমানও সাঁকো বাঁধতে না পারার ব্যর্থতায় হতাশা ব্যক্ত করেছেন। এ ব্যর্থতা কীসের- যতীন সরকার মনে করেন, এ ব্যর্থতা শুধু একা শামসুর রাহমানের নয়, এটি যুগের অন্তঃসার। এ ব্যর্থতার মূলে তিনি সামাজিক বিচ্ছিন্নতার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। বিচ্ছিন্নতা আধুনিক জীবনবোধেরই অংশ। বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে প্রায় সকল কবিই যুগের এই বিচ্ছিন্নতায় আক্রান্ত। এটি আধুনিকতার কুলক্ষণ। এই বিচ্ছিন্নতাকে যতীন সরকার গত, ধর্ম-সম্প্রদায়গত, ঐতিহ্যগত, সেইসঙ্গে সামাজিক অসংগতি এবং দুর্বোধ্যতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন। তিনি পাকিস্তান আমলে ভাষা আন্দোলনে ও স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে আমাদের কবি-লেখকদের ভূমিকা, সমাজ ও রাজনীতি সংলগ্নতার কিছু বিচ্ছিন্ন (তাঁর মতে) দৃষ্টান্ত এবং স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পরে কবিদের প্রতিবাদী ভূমিকার উল্লেখ করেও এ সিদ্ধান্ত দেন যে সামগ্রিকভাবে বাংলা কবিতা সমাজ বা জনগণের দিকে মুখ ফেরায়নি। এ ক্ষেত্রে তিন কবিতার পাঠযোগ্যতা ও কবিতা পাঠের আসরে সাধারণ মানুষের উপস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। উদাহরণ দিয়েছেন সোভিয়েত ইউনিয়নের কবিতা পাঠের আসরের, যেখানে শ্রোতা হিসেবে সাধারণ কৃষকের অংশগ্রহণ দৃশ্যমান ছিল। সাঁকো বাঁধার এ ধরনের প্রচেষ্টায় সমাজতান্ত্রিক দুনিয়াও যে সফল হয়েছে তেমন নয়। বিচ্ছিন্নতা অপনোদনে তিনি কবি-লেখকদের চ্যুতির কথা বলেছেন; সেটিও বাংলা কবিতায় সামষ্টিক প্রবণতা ধারণ করতে পারেনি। বরং বিশ্বব্যাপী নগরায়ণের বিস্তার, প্রযুক্তির উৎকর্ষ, সংস্কৃতির সংকরায়ন বর্তমান যুগের বিচ্ছিন্নতাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে; যা শুধু মার্কসীয় বিচ্ছিন্নতার আলোকে বিশ্নেষণ করা যাবে না। বৈশ্বিক এই বিচ্ছিন্নতাবোধ আরও বাড়িতে দিয়েছে আত্মপরিচয়ের সংকট। আমেরিকায় অভিবাসীর ইউক্রেনের কবি ইলিয়া কামিনস্কির (Ilya kaminski) Dancing in Odessa গ্রন্থের praise কবিতার দুটি লাইন থেকে বর্তমানের এ সংকটের তীব্রতা অনুভব করা যায় :
I was born on the city named after Odysseus and I praise no nation
সেজন্য বোধ করি, সাঁকো বাঁধার কাজটি দেশজ সংস্কৃতির পুনরাবিস্কারের মধ্যে সাধন করা সম্ভব বলে তিনি ভেবেছেন। সে চিন্তার প্রতিফলন আমরা দেখি তাঁর আফ্রিকার কবিতাবিষয়ক 'আফ্রিকার কবিতা পাঠের ভাবনা :বাংলার কবির কাছে প্রত্যাশা' শীর্ষক রচনায়। মূলত এ প্রবন্ধে তিনি সেনেগালের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ও আফ্রিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি লিওপোল্ড সেদার সেংঘরের কবিতার আলোকে বাংলা কবিতার কাছে প্রত্যাশা তুলে ধরেছেন।
রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে আমাদের কবিরা আফ্রিকা নিয়ে কবিতা রচনা করেছেন। আফ্রিকার মুক্তিকামী মানুষের আন্দোলন শুধু সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো সাম্যবাদী কবি নন, বুদ্ধদেব বসুর মতে শুদ্ধাচারী কবিকেও আলোড়িত করেছে। বর্তমান সময়ে বিশ্বসাহিত্যে ও আফ্রিকান সাহিত্যের অবস্থান ক্রমাগত বিস্তৃত হচ্ছে। এ প্রবন্ধে তিনি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত একটি সংকলনে প্রকাশিত সেংঘরের অনূদিত ১৫টি কবিতা নিয়ে আলোচনা করলেও এতে উত্তর-ঔপনিবেশিক আফ্রিকান কাব্য ও শিল্প চেতনার নানান অনুষঙ্গ বিধৃত। আমাদের উপমহাদেশের মতো আফ্রিকাও সুদীর্ঘকাল ঔপনিবেশিক শাসনে আবদ্ধ ছিল।
ব্রিটিশ আমলে এই উপমহাদেশে আধুনিকতার নামে ইংরেজায়নের যে প্রভাব বিস্তারিত হয়, আফ্রিকার ক্ষেত্র ফরাসি ও ইংরেজের আধিপত্য, দুটোই দৃশ্যমান ছিল- ঔপনিবেশিকতার আলোকে ইউরোপের এই দুই সংস্কৃতির আধিপত্য আফ্রিকান সংস্কৃতিতেও ব্যাপক প্রভাব ফেলে, ফলত বহু গোত্রে বিভক্ত আফ্রিকান সমাজে সংঘাত থেকে এক ধরনের টেনশনের জন্ম হয়েছে। বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম আন্দোলনের মাধ্যমে মুক্ত হয়েছে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ। এক শতাব্দীরও বেশি সময়ের শাসনে তাদের সংস্কৃতিতেও নানা টানাপোড়েন ঘটেছে। স্বাভাবিকভাবে উত্তর ঔপনিবেশিক আফ্রিকায় কবিতার ভাষা ও অনুষঙ্গ কীভাবে প্রতিফলিত তা অধ্যয়ন গুরুত্বপূর্ণ। সেংঘর, চিনুয়া আচিবির মতো লেখকরা সংস্কৃতির এই দোলাচলে দাঁড়িয়ে ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে যেমন লেখনীকে শানিত করেছেন, তেমনি স্বসাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরও জাগরণ ঘটিয়েছেন। এজন্য ইউরোপ ও আফ্রিকার সংস্কৃতির সংঘাতের বৈশিষ্ট্য অনুধাবন ও ঔপনিবেশিক শাসন অবসানে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে সেটি বোঝা জরুরি। বিশেষ করে প্রয়োজন সাধারণ আফ্রিকানদের মনোজগতের কী কী পরিবর্তন ঘটেছে তার অধ্যয়ন। আফ্রিকান লেখকরা তাঁদের রচনায় আফ্রিকান ঐতিহ্য এবং সামাজিক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে যে নতুন সাহিত্য নির্মাণ করেছেন, সেটি আফ্রিকান বৈশিষ্ট্যের আলোকে বিবৃত। সে জন্য সেংঘরের কবিতা আফ্রিকান জাতীয়তাবাদের বিশেষ দিক যেমন নির্দেশ করে, তেমনি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী স্বাদেশিক চেতনাও তাঁদের কবিতায় দীপ্ত। এই প্রেক্ষাপটে যতীন সরকার আমাদের কবিতাকে দেশজ-ঐতিহ্য সংলগ্ন দেখতে চান। কিন্তু বাংলা কবিতায় তিনি সে বৈশিষ্ট্য অসংশ্নিষ্ট দেখেন। এক ধরনের নিঃসঙ্গতা, আধুনিক জীবনের বিচ্ছিন্নতাবোধ ও শিকড়হীন অবস্থান নিজস্ব সংস্কৃতিকে আবিস্কার থেকে আমাদের কবিদের দূরে রেখেছে। তাঁর মতে, 'পশ্চিমের নয়া কলাকৈবল্যবাদী, আত্মবাদী, রূপবাদী, পরাবাস্তবতাবাদী ও অস্তিত্ববাদী কবিদের অনুসৃতি বাংলা কাব্যের দেহ নির্মাণে ও প্রসাধন কলায় উল্লেখনীয় কৃতির সঞ্চয় রাখতে পেরেছে। যদিও কাব্যের বাঞ্ছিত মুক্তি তাতে সাধিত হয়নি, হতে পারেও না।' এ নিয়ে তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি বাংলা কবিতার উত্তর ঔপনিবেশিক পরিপ্রেক্ষিতের আলোচনায় কৃষিজীবী ও কৌম সমাজের উপাদানগুলো ধারণ করে পশ্চিমা উপাদানকেও সংমিশ্রণের মাধ্যমে লোকসমাজ ও নাগরিক সমাজের সংস্কৃতির দূরত্ব ঘুচিয়ে আনার ওপরও জোর দিয়েছেন। তাঁর মতে, আফ্রিকান কবিরা যেমন তাঁদের গোত্র সমাজের ঐতিহ্যের মুক্ত প্রবাহেই তাঁদের কবিতার তরী ভাসিয়েছেন, আমাদের কবিতার তরীও যে তেমনি বাংলাদেশের প্রাণগঙ্গা ছাড়া আর কোথাও চলার পথ খুঁজে পাবে না, বাংলার কবিরা যদি এ সত্য প্রাণে প্রাণে উপলব্ধি করতে না পারেন, তাহলেই আমাদের কবিতার তরী চরায় এসেই ঠেকে থাকবে।
কবিতা সংস্কৃতির বাহন- বর্তমান সময়ে উত্তর ইউরোপীয় (অথবা পোস্ট ওয়েস্ট যুগে) প্রকরণ শৈলীর ও চিত্রকল্পে এক ধরনের সংকরায়ন ঘটলেও চূড়ান্ত অর্থে কবিতা জাতীয় সংস্কৃতির বাহন। সে জন্যই জাতীয় সংস্কৃতির অনুষঙ্গের আলোকেই বাংলা কবিতার মুক্তির অন্বেষণ করতে হবে। এই উপলব্ধিই যতীন সরকারের কবিতা ভাবনার মূল অভিমুখ।