প্রবহমান জীবন শত বাধা পেরিয়ে ছুটে চলে গন্তব্যে। রেখে যায় স্মৃতি, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা। সুহৃদদের লেখা অনুগল্প নিয়ে আয়োজন...
'মা, তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে, তাই না? তুমি ঠিক আছো তো? তুমি চিন্তা করো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। ভোরের আলো ফুটলেই আমি ডাক্তারের কাছে যাব। ডাক্তার না এলেও আমি তোমার জন্য ওষুধ নিয়ে আসব।' মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে দিহান এমন শত কথার সান্ত্বনার বাণী শুনিয়ে চলে। মা মাঝেমধ্যে চোখ মেলে তাকান। ছেলের হাতে হাত রেখে শক্ত করে জড়িয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলেন- না বাবা, আমার জন্য এত কষ্ট করো না। তিন বছর হলো, আমি হয়তো চলে যাব। শেষ বয়সে এসে শরীরে নানা রকম অসুখ বাসা বেঁধেছে। আজ কত দিন ধরে বিছানায় শুয়ে ঘরবন্দি আমি।
আছিমন বিবির চোখ টলমল করছে। বিড়বিড় করে কী যেন ভেবে বোবাকান্না করছেন। দিহান মায়ের চোখের অশ্রু মুছতে মুছতে বলল- মা, তুমি শান্ত হও। তোমার কিছু হবে না। আজকের রাত এত বীভৎস কেন? একটু পরপর দূরের কোথাও হড়হড় শব্দ করে বজ্রপাতের শব্দ আসছে। বৃষ্টির আনাগোনা বেড়ে চলছে। সরকারি জমির ওপরে জীর্ণশীর্ণ পলিথিনে মোড়ানো ঘরের চাল চুইয়ে টপটপ করে বৃষ্টির পানি পড়ছে। দিহান অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় বৃষ্টির কাছে। এলাকার চেয়ারম্যান বলেছিলেন, একটি আধা-পাকা ঘর দেওয়া হবে। কিন্তু দিন যায় মাস আসে, নতুন চেয়ারম্যান আসেন; আছিমন বিবির কপালে আধা-পাকা ঘর জোটে না। এখন আর ঘরের আশা করেন না তিনি। তিনি জানেন, তাঁর ছেলে একদিন ঠিকই বড় হবে। জীবনের সব দুঃখকষ্ট ভুলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে।
বৃষ্টি থামার নাম নেই, চলছে তো চলছেই। আকাশজুড়ে বিকট শব্দ হলো, খুব কাছে কোথাও হয়তো বজ্র পড়েছে। দিহান শক্ত করে মাকে জড়িয়ে ধরে। কিছুক্ষণ পর সে বুঝতে পারে, মা নিস্তেজ হয়ে গেছেন। নিজের বুকে থাকা অবস্থায় না ফেরার দেশে চলে গেছেন আজিমন বিবি। দিহান মায়ের মুখে হাত বোলাতে বোলাতে বিলাপ করতে থাকে। তার মনে বাসা বাঁধা স্বপ্নগুলো উঁকি দিতে থাকে। যেন বালির ঘরের মতো নিমেষেই সব শেষ হয়ে গেল। শেষ আশ্রয় হারিয়ে দিহান যেন দিশেহারা। সংসারের কষ্ট দেখতে দেখতে বড় হয়েছে সে। সেই কষ্টের দিন থেকে মুক্তি পেতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দিহান।
জীবনধারা থেকে গেলেও বাইরে তখনও বৃষ্টি পড়ছে অঝোর ধারায়। প্রকৃতি বড় নিষ্ঠুর। দুই বছর আগে এমন এক বৃষ্টির দিনে বাবাকে হারিয়েছে দিহান। আজ মাকেও হারিয়ে বড় একা হয়ে গেল পৃথিবীর বুকে।
বিরহের দহনে না পুড়ে স্বার্থপর পৃথিবীতে একাকী পথচলার আশ্রয় খুঁজে বেড়ায় সে।
সুহৃদ কুড়িগ্রাম

বিষয় : জীবনের গল্প

মন্তব্য করুন