- ফিচার
- কার্পেট-শতরঞ্জিতে জীবন বদল
কার্পেট-শতরঞ্জিতে জীবন বদল

প্রতিবন্ধী আত্মউন্নয়ন সংস্থায় নোপালি চাম্বুগংয়ের কাজের মুহূর্ত-সমকাল
পোলিও হওয়ায় শৈশবেই অচল হয়ে যায় দুটি পা। দেখা হয়নি স্কুলের বারান্দা। শিক্ষা নিয়ে তাই আক্ষেপ ছিল প্রতিবন্ধী নোপালি চাম্বুগংয়ের। তবে নিজে পড়াশোনা করতে না পারলেও ২০০৭ সাল থেকে কার্পেট-শতরঞ্জির বুনন করে উপার্জিত টাকায় এক বোনকে মাস্টার্স পর্যন্ত পড়িয়েছেন। আদিবাসী এই নারীর বাড়ি নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার কোলাগড়া ইউনিয়নের ছনগড়া গ্রামে। শুধু নোপালি নন, এমন আরও অনেক প্রতিবন্ধী হস্তশিল্পের ছোঁয়ায় এখন পরিবারের ভরসা হয়ে উঠেছেন। তাঁদের নিয়ে কাজ করছেন আরেক প্রতিবন্ধী শেফালি আক্তার।
ময়মনসিংহ নগরীর কাঁচিঝুলি টাউন হল এলাকায় ১৯৯৭ সালে সুইডেনের নাগরিক ব্রাদার ফ্রাঙ্ক চালু করেন প্রতিবন্ধী কমিউনিটি সেন্টার। প্রতিবন্ধীদের কর্মমুখী করতে প্রতিষ্ঠানটি কাজ শুরু করে। সেখানে কার্পেট-শতরঞ্জির বুননের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ২০০৪ সালে এখানে কাজ শেখেন নগরীর ইসমত এলাকার ইদ্রিস আলীর মেয়ে শেফালি আক্তার। রপ্ত করেন নানা ধরনের কাজ। পরে তিনি এই সেকশনের পুরো দায়িত্ব পান। শৈশবে ষষ্ঠ শ্রেণির চৌকাঠ পেরোতে না পারলেও চলতি বছর উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে ভর্তি হয়েছেন উচ্চ মাধ্যমিকে।
প্রথমে প্রতিবন্ধী কমিউনিটি সেন্টারের সঙ্গে কাজ করলেও ২০১৯ সালে পৃথক হয়ে নগরীর কাঁচিঝুলি মোড়ে একটি বাড়িতে গড়ে তোলেন প্রতিবন্ধী আত্মউন্নয়ন সংস্থা। এখানে ১৪ জন নারী ও একজন পুরুষ কাজ করেন। সংস্থাটি ২০২০ সালে নগরীর ইসমত, তারাগাঁই, মির্জাপুর, রহমতপুর ও বেগুনবাড়ি এলাকায় আরও পাঁচটি শাখা চালু করে। এগুলোতে কাজ করছেন ২০০ নারী-পুরুষ ও শিশু প্রতিবন্ধীরা। শাখাগুলোতে কাজ করে তাঁরা পরিবারের কাছে হয়ে উঠছেন ভরসার প্রতীক। প্রতিবন্ধী সাবিনা আক্তার, রহিমা বেগম, বাবলি আক্তার, রোকসানা, সেতু, রিতা, নমিতা রায়সহ অন্যদের জীবনের গল্পও অনেক কষ্টের। তবে তাঁরা কষ্ট ঘুচিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার সংগ্রামে নিয়োজিত। ভালো কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৫ সালে ফ্রান্স সরকার শেফালিকে নিমন্ত্রণ করে বিশ্ব প্রতিবন্ধী ফোরামে নিয়ে যায়।
সংস্থার প্রধান ডিজাইনার ও ইনচার্জ শেফালি আক্তারের তত্ত্বাবধানেই চলছে পুরো কর্মযজ্ঞ। তৈরি হচ্ছে কার্পেট, শতরঞ্জি, রিসাইকেল, ওয়ালম্যাট, কুশন কভার, লেডিস ব্যাগ, ল্যাপটপ ব্যাগ, পাপসসহ নানা জিনিস। ওয়ালম্যাট বিক্রি হয় পাঁচ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকায়। কার্পেট দুই হাজার থেকে ৫০ হাজারে, শতরঞ্জি দুই হাজার ২০০ থেকে ২৫ হাজার টাকায়। এসব পণ্য তৈরি হয় উলের সুতা ও পুরোনো কাপড় দিয়ে। প্রতিবন্ধীদের তৈরি এসব পণ্যের চাহিদা দেশে কম হলেও রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, সুইডেনসহ অন্তত ১২টি দেশে।
নোপালি চাম্বুগং বলেন, প্রতিবন্ধিতা ও পরিবারের অভাব-অনটনের কারণে শৈশবে স্কুলে যাওয়া হয়নি, কিন্তু আশা ছাড়িনি। সুযোগ পেলে আমিও পড়তে চাই। শেফালি আপা বলেছেন, আমাকেও স্কুলে ভর্তি করে দেবেন। দুটি পায়ের অক্ষমতা ও দারিদ্র্যের কারণে বিয়ের কথা কখনও ভাবিনি। অনেক সুস্থ-সবল মানুষেরই সংসার টেকে না, তাই কারও বোঝা হয়ে থাকতে চাই না। সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে বাঁচতে এ সংস্থায় কাজ করছি।
শেফালি বলেন, ২০২০ সালে অনলাইনের মাধ্যমে সর্বশেষ দেশের বাইরে দুটি চালান যায়। এ ছাড়া রাজধানীর গুলশান, বনানী, বারিধারাসহ অভিজাত এলাকায় এসব পণ্যের চাহিদা থাকলেও সেসব জায়গায় তাঁদের শো-রুম নেওয়ার সামর্থ্য নেই। করোনার কারণে রপ্তানি বন্ধ থাকায় কাজ সীমিত হয়ে গেছে, কর্মীদের পারিশ্রমিক দিতেও সমস্যা হচ্ছে।
ময়মনসিংহ বিভাগীয় সমাজসেবা কার্যালয়ের পরিচালক তাহমিনা আক্তার বলেন, প্রতিবন্ধীদের উৎসাহিত করতে তাঁদের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। বিভিন্ন মেলার স্টলে বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়। সরকারি কোনো কেনাকাটা থাকলে এখান থেকে পণ্য নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
মন্তব্য করুন