খাদ্যপণ্যের মধ্যে চালের পরই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় আটা-ময়দা। সব শ্রেণির মানুষের মাঝেই দিন দিন বাড়ছে গম থেকে উৎপাদিত এই পণ্য দুটির চাহিদা। শুধু খোলা নয়, বিক্রি বাড়ছে প্যাকেটজাত আটা-ময়দারও। খুব বেশি দিনের প্রচলন না হলেও, এরই মধ্যে ভোক্তাদের মধ্যে আস্থা অর্জন করে নিয়েছে প্যাকেটজাত আট-ময়দা। চাহিদা মেটাতে এই বাজারে একের পর এক যুক্ত হচ্ছে বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান। স্থাপন করা হচ্ছে বেশি উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন অত্যাধুনিক যন্ত্র। প্রতিনিয়ত বাড়ছে বিনিয়োগের পরিমাণও।

বড় হচ্ছে বাজার

দেশে ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে প্যাকেটজাত আটা-ময়দার বাজার। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশে গমের চাহিদা আগের বছরের তুলনায় ৬ শতাংশ বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৮৪ লাখ টনে। এর ৮৮ শতাংশই আমদানি করতে হবে। অন্যদিকে এ খাতের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, প্রতি বছর আটা-ময়দার চাহিদা বাড়ছে গড়ে ১০ শতাংশ হারে। বর্তমানে বাজারে যে পরিমাণ আটা-ময়দা বিক্রি হয়, তার মধ্যে ১০ থেকে ১৫ শতাংশই প্যাকেটজাত। প্যাকেটজাত আটার চাহিদা বাড়ছে বছরে ১০ থেকে ১২ শতাংশ হারে। স্বাস্থ্য সচেতনতার কারণে অনেকে খোলা আটা-ময়দার চেয়ে প্যাকেটজাত আগের তুলনায় বেশি কিনছেন। বিভিন্ন কোম্পানির দাবি, খোলা আটা-ময়দার চেয়ে প্যাকেটজাত বেশি নিরাপদ। যদিও খোলা আর প্যাকেটজাত আটা-ময়দার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোনো তফাত নেই বলে মনে করেন অনেক খুচরা ব্যবসায়ী।

বাজারজাতকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও খুচরা ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্যাকেটজাত আটা-ময়দার মধ্যে বেশি বিক্রি হয় আটা। এ দুটি প্যাকেটজাত পণ্যের মধ্যে ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশই আটা। কারণ বাসাবাড়িতে ময়দার চেয়ে আটার ব্যবহার অনেক বেশি। বাকি ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বিক্রি হয় ময়দা, যার বেশিরভাগ ব্যবহার হয় হোটেল-রেস্তোরাঁয়। আটা-ময়দার পাশাপাশি সুজিও প্যাকেটজাত করে বিক্রি হচ্ছে এখন।

রাজধানীর তেজকুনি পাড়া এলাকার মাঈন উদ্দিন ট্রেডার্সের বিক্রয়কর্মী শাহ পরান সমকালকে বলেন, দিনে গড়ে ৬০ থেকে ৭০ কেজি প্যাকেটজাত আটা-ময়দা বিক্রি করেন তিনি। এর বেশিরভাগই আটা। তিনি জানান, বাজারে বর্তমানে এক ও দুই কেজি ওজনের প্যাকেটজাত আটা-ময়দা বিক্রি হচ্ছে। সাদা আটা-ময়দার পাশাপাশি বাজারে পাওয়া যাচ্ছে হালকা লাল আটা। সাধারণত ডায়াবেটিস রোগী ও স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ এগুলো বেশি কেনেন।

বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে করপোরেট প্রতিষ্ঠান

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে আটা-ময়দার বাজারে এসেছে অনেক করপোরেট প্রতিষ্ঠান। বাজারের বড় অংশই এখন তাদের দখলে। প্যাকেটজাত আটা-ময়দার বাজারে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে- বসুন্ধরা, সিটি, টি কে, এসিআই, ইফাদ ও নাবিল গ্রুপ। এ ছাড়া এলাকাভিত্তিক ছোট-বড় অনেক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ব্র্যান্ডে প্যাকেটজাত আটা-ময়দা বাজারে আনছে। যেমন ইউসুফ, ফোজি, সিলভার্স, হর্স, ইল্ডার্স, ডায়মন্ড, কেয়া, রমনি, মাহিন ইত্যাদি।

চাহিদা ও বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় এ খাতের উদ্যোক্তারাও বিনিয়োগ বাড়াচ্ছেন। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, বর্তমানে প্যাকেটজাত আটা-ময়দার বাজারে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে বসুন্ধরা ফুড অ্যান্ড বেভারেজ। গত বছরের শেষ দিকে তারা নতুন করে দৈনিক দুই হাজার টন আটা-ময়দা উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কারখানা স্থাপন করেছে। প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে দৈনিক প্রায় সাড়ে চার হাজার টন উৎপাদন করে।

প্যাকেটজাত আটা-ময়দা বিক্রিতে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সিটি গ্রুপ। চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের অন্যতম বড় আটা-ময়দা উৎপাদনকারী কারখানা স্থাপন করেছে। প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপিত কারখানাটির দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা পাঁচ হাজার টনের বেশি।

উৎপাদন ও বাজারজাতকারীরা বলছেন, আটা-ময়দার বাজারে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো আসার কারণে পণ্যের মানের উন্নয়ন ঘটছে। মেঘনা গ্রুপের সিনিয়র সহকারী ম্যানেজার তাসলিম শাহরিয়ার সমকালকে বলেন, প্রতিযোগিতার বাজারে ক্রেতার আস্থা অর্জনে সবাই নিজেদের পণ্যের মান নিশ্চিত করার বিষয়ে সচেতন থাকে। তাঁর মতে, খোলার চেয়ে প্যাকেটজাত আটা-ময়দা অবশ্যই বেশি নিরাপদ।

দেশে আটা-ময়দার বাজার পরিস্থিতি নিয়ে খুব বেশি গবেষণা দেখা যায় না। ২০১৩ সালে ইউরোপিয়ান জার্নাল অব বিজনেস অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনের তথ্যমতে, প্যাকেটজাত আটা-ময়দাসবচেয়ে বেশি খাওয়া হয় ঢাকা জেলায়। এরপরই রয়েছে চট্টগ্রামের অবস্থান।

প্যাকেটজাত আটা-ময়দা উৎপাদন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে পাওয়া তথ্যমতে, বর্তমানে এ দুটি পণ্যের বাজারে সবচেয়ে বেশি অংশ বসুন্ধরা গ্রুপের। মোট বাজারের ২৭ শতাংশই তাদের। এরপর ২৬ শতাংশ মার্কেট শেয়ার নিয়ে ফ্রেশ দ্বিতীয় ও ২৪ শতাংশ মার্কেট শেয়ার নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে তীর। এ ছাড়া পুষ্টি ও পিউরের ৮ শতাংশ করে বাজার রয়েছে। বাকি ৭ শতাংশ অন্যান্য কোম্পানির দখলে।

দাম নিয়ে স্বস্তিতে নেই ক্রেতারা

ক্রেতাদের মাঝে সব ধরনের আটা-ময়দার চাহিদা বাড়লেও দাম নিয়ে স্বস্তিতে নেই তাঁরা। ইউক্রেন-রাশিয়াসহ আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম বেড়ে যাওয়াসহ নানা কারণে দেশের বাজারে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে অনেক বেড়েছে আটা-ময়দার দাম। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, প্রতি কেজি খোলা আটা ৫০ থেকে ৫২, প্যাকেটজাত ৫৫ থেকে ৫৮ এবং খোলা ময়দা ৬০ থেকে ৬২, প্যাকেটজাত ৬৫ থেকে ৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সংস্থাটির হিসাবে, গত এক বছরে দাম বেড়েছে খোলা আটা ৫৪, প্যাকেটজাত ৫১, খোলা ময়দা ৬৩ এবং প্যাকেটজাত ৫২ শতাংশ পর্যন্ত।

এ খাতের উৎপাদনকারীরা বলেন, বিশ্ববাজারে দাম এখন আবার কিছুটা কমে এলেও ইউএস ডলারের দরবৃদ্ধির কারণে আমদানি ব্যয় কমেনি। তা ছাড়া সম্প্রতি জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে আমদানি থেকে সরবরাহ সব পর্যায়ে খরচ বেড়েছে। এ ছাড়া বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কিন্তু কারখানার সব খরচ ঠিকই চলমান। ফলে উৎপাদন ব্যয় আগের চেয়ে বেড়েছে। সেজন্য আটা-ময়দার দাম বাড়াতে তাঁরা বাধ্য হয়েছেন।

গমের উৎপাদন ও আমদানি পরিস্থিতি

আমদানিকারকদের তথ্যমতে, দেশে ৮৫ লাখ টন গমের চাহিদা রয়েছে। তবে সরকারের হিসাবে তা অনেক কম। কৃষি তথ্য সেবা বিভাগের তথ্যমতে, দেশে গমের চাহিদা রয়েছে ৭০ লাখ টনের মতো। এর বিপরীতে উৎপাদন মাত্র গড়ে ১২ লাখ টন। চাহিদার বাকি অংশ আমদানি করতে হয়। যার পরিমাণ প্রায় ৫৮ লাখ টন।

সাধারণ মানের গম থেকে আটা তৈরি হয়। এ ধরনের গমের সিংহভাগই আসে ইউক্রেন, রাশিয়া ও ভারত থেকে। আর দামি বা প্রিমিয়ার গম থেকে তৈরি হয় ময়দা। এ মানের গম আমদানি হয় কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা থেকে। সব মিলিয়ে সাধারণত সবচেয়ে বেশি গম আমদানি হয় রাশিয়া থেকে। মোট আমদানির প্রায় ৩২ শতাংশই আসে দেশটি থেকে। ২৩ শতাংশ আসে ইউক্রেন থেকে। ২০ শতাংশের বেশি আসে কানাডা থেকে। এ ছাড়া আর্জেন্টিনা থেকে ৯ এবং ভারত থেকে ৭ শতাংশের বেশি গম আসে। বাকিটা আসে যুক্তরাষ্ট্র, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া ও অস্ট্রেলিয়া থেকে।

খাদ্যপণ্য দুটির বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, এ খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো- গমের আমদানি-নির্ভরতা। ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে উৎপাদন না বাড়ালে ভবিষ্যতে গমের সংকট বাড়তে পারে। আন্তর্জাতিক কোনো কারণে কোনো দেশ থেকে আমদানি বন্ধ হয়ে গেলে তখন গম থেকে তৈরি খাদ্যপণ্যের দামও বাড়ার শঙ্কা থাকবে। দেশে উৎপাদন বাড়াতে হলে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকদের প্রণোদনাসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে তাঁদের উৎপাদিত গমের ন্যায্যমূল্য। উৎপাদন বাড়লে আটা-ময়দা দিয়ে উৎপাদিত খাদ্যপণ্যের সরবরাহ বাড়বে। দামও থাকবে ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। পাশাপাশি দেশের গম থেকে উৎপাদিত আটা-ময়দা রপ্তানিও করা সম্ভব হবে।