- ফিচার
- ক্যান্সারের বিরুদ্ধে নাতাশার লড়াই
ক্যান্সারের বিরুদ্ধে নাতাশার লড়াই

টেলিভিশন চ্যানেলের বার্তা কক্ষে এন কে নাতাশা
ক্যান্সার জয়। দুই শব্দের বাক্যটার মধ্যে যে লুকিয়ে আছে বিপুল লড়াই! অসম এ লড়াই আমাদের খুবই অচেনা। শত্রুপক্ষ ভয়ানক শক্তিধর। যেখানে ঘাপটি মেরে থাকে রাজ্যের ভয়। সেই ভয় চির প্রস্থানের।
তবে ভয়কে জয় করার পথ খুঁজে দিয়েছেন এন কে নাতাশা। তাঁর লড়াইয়ের কথা শোনাচ্ছেন ওবায়দুল্লাহ্ সনি
বেসরকারি টেলিভিশন মাছরাঙার জনপ্রিয় সংবাদ উপস্থাপিকা এন কে নাতাশা। ফোর্থ স্টেজের ক্যান্সারের সঙ্গে লড়ছেন তিনি। তবে শয্যাশায়ী হয়ে নয়, জীবন চলছে স্বাভাবিকই, নিয়মমাফিক। অফিসও করছেন। চিকিৎসা পর্বে তাঁর এ আত্মবিশ্বাস দেখে সবাই তাজ্জব। প্রত্যেকের জীবনেই এমন একটি সময় আসে, যখন তাঁকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় যে ভয়ের কাছে হার মেনে নেবেন, নাকি সর্বশক্তি দিয়ে সেই ভয়কে জয়ের জন্য লড়াই করবেন।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে নাতাশার বুকে একটি লাম্প বা চাকা স্পর্শমান হয়। এক সময় জানা যায়, স্তন ক্যান্সার। এরই মধ্যে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত। কর্কট রোগটা ততদিনে স্টেজ ফোরে। চিন্তায় চিকিৎসকরা। পরিবার ভারাক্রান্ত। ভেঙে পড়েছিলেন নাতাশা নিজেও। সময় গড়াতেই আবার ঘুরে দাঁড়ালেন। জানিয়ে দিলেন, 'ফিরে আমি আসবই!' তবে হঠাৎ কোথা থেকে পেলেন মনের এত জোর? নাতাশা বলতে শুরু করলেন, 'অসুখ তো হবেই। আমাদের চারপাশে যা পরিবেশ, খাওয়া-দাওয়া, তাতে অসুখ না হওয়াটাই যেন বিস্ময়ের। মনকে আগেই বুঝিয়ে ফেলেছিলাম সে কথা। যে কোনো ক্যান্সার রোগীকেই ক্যান্সারের আগে জয় করতে হয় মৃত্যুভয়। সেটুকু জয় করতে পারলেই রোগের সঙ্গে লড়াই অনেক সহজ হয়ে যায়। যখন চিকিৎসা চলছে, কখনও-সখনও মনের সঙ্গে যুদ্ধে হেরেছি; কিন্তু পরক্ষণেই আবার উঠে দাঁড়িয়েছি। নিজেকে নিজেই সাহস জুগিয়েছি, লড়ার আগেই তো হেরে যাওয়া যায় না। ক্যান্সারে ভুগছেন এমন অনেক মানুষের সঙ্গে আমার এক সময় পরিচয় হয়। ভালো হয়ে গেছেন, পুরোপুরি সেরে উঠেছেন এমন মানুষেরও দেখা পাই।'
টিভির পর্দায় এন কে নাতাশা একজন জনপ্রিয় সংবাদপাঠিকা হলেও তিনি মূলত চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। ডায়াবেটিস ও স্বাস্থ্য বিষয়ে করেছেন পিএইচডি। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট-আইইডিসিআরের সহযোগী অধ্যাপক। একই সঙ্গে জনস্বাস্থ্যবিষয়ক জাতীয় বুলেটিনেরও সম্পাদক ডা. এন কে নাতাশা। অথচ এই চিকিৎসককেও ভুল চিকিৎসার শিকার হতে হয়েছে। ভুল ডায়াগনস্টিকের কারণে রোগ ধরা পড়ে দেরিতে। তাই চিকিৎসা শুরু হতেও অনেক দেরি হয়ে যায়। সেই খারাপ অভিজ্ঞতাকে টেনে নাতাশা জানান, লাম্প দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পরিচিত এক সার্জনের পরামর্শ নেন, এক্স-রে করান। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসক বলেন- ও কিছু নয়, ব্যথা পেয়েছো বলে এটা হয়েছে। ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তিন মাসেও যখন সমস্যাটা যায়নি, তখন অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। এর মধ্যে শরীরে আরেকটা সমস্যা দেখা দেয়। ওষুধ খাওয়ার পরও সেটা কমছিল না। পরীক্ষা করালে ভুল রিপোর্ট আসে। কোর বায়োপসি করার পর ক্যান্সার ধরা পড়ে। সেই রিপোর্ট নাতাশার হাতে আসে ২০২০ সালের ৮ আগস্ট। চিকিৎসা চলে তিন স্টেজে। কেমোথেরাপিতে কিছু ওষুধ নিতে হয়। তারপর সার্জারি, আক্রান্ত কিছু অংশ কেটে ফেলতে হয়। আছে রেডিওথেরাপি, তাতে কিছু অংশ পুড়িয়ে দিতে হয়।
নাতাশা বলেন, 'চিকিৎসার পাঁচ মাসের মাথায় আমাকে আবার কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। ওই সময়টায় প্রচণ্ডভাবে ভেঙে পড়েছিলাম এবং একটা সময় আমাকে জানিয়ে দেওয়া হয়- ক্যান্সার তোমাকে কখনোই ছেড়ে যাবে না। বড়জোর আর কয়েক মাস বা বছরখানেক বাঁচতে পার! আমি জানলাম, ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজ এবং ফুসফুসে ছড়িয়ে গেছে। ইমিউন সেল, যেটা রোগ প্রতিরোধ সেল তৈরি করে, সেখানেও ছড়িয়ে গেছে।'
ভালোভাবে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা ডা. নাতাশার জাগে এক অপ্রত্যাশিত পাওয়ার মাধ্যমে- 'যখনই আমাকে বলে দেওয়া হয়- তুমি আর বাঁচবে না, তখনই আমি একটা স্কলারশিপ পাই বাইরে যাওয়ার। সেটা আমি গ্রহণ করলে সবাই তখন বলেছেন- স্কলারশিপটা নিও না, তুমি আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে; কিন্তু আমার ভেতর কাজ করছে- আমি তো আর বাঁচবই না, তাহলে নেব না কেন? এতে করে তো অন্তত একটা দেশ দেখার সুযোগ পাচ্ছি! এসব চিন্তাভাবনা থেকেই স্কলারশিপটা নিই। পরে ওইখানে গিয়ে কাকতালীয়ভাবে ট্যুরিস্ট বাসে এক নারীর সঙ্গে আমার দেখা হয়, তিনিও একজন চিকিৎসক। অল্টারনেটিভ মেডিসিনের ইয়োগার এই ডক্টর আমাকে কিছু গাইডলাইন দিয়ে বললেন- এভাবে যদি তোমার লাইফস্টাইল চালাতে পার, তাহলে তুমি পুরোপুরি ভালো হয়ে যাবে। আমরা অনেক জায়গায় দেখেছি ক্যান্সারের রোগ ভালো হয়ে যায়।'
ডা. এন কে নাতাশা বলেন, 'আমি যখন কেমোথেরাপি দিই বা ওষুধ খাই, সেগুলো কিন্তু ভালো কোষগুলোকেও মেরে ফেলে। আমাকে করে ফেলছিল শয্যাশায়ী। ক্যান্সার কোনো রোগ নয়, এটা আমার শরীরের একটা পরিবর্তন। যেহেতু পরিবর্তনটা হয়েছে, আমাকে রিভার্সে যেতে হবে। লাইফস্টাইলে পরিবর্তন আনতে হবে। যখন আপনি ভাববেন, আরও অনেক কিছু করার আছে, আমাকে সুস্থ হতেই হবে। তখন দেখবেন চারপাশ থেকে কোনো না কোনো মানুষ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। কারণ তাঁরা হয়তো ভাবছেন- ও তো বাঁচতে চাইছে, তাহলে আমি একটু সাপোর্ট দিলেই বাঁচবে। কিন্তু আপনি যখন নিজেকে মনে করবেন হেল্পলেস, তখন অন্যরা ভাববেন- ও তো বাঁচবেই না, আমি দাঁড়ালেও কোনো লাভ নেই। এ ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকাটা আসলে খুব জরুরি।'
ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সফল লড়াই চালিয়ে এন কে নাতাশা বলেন, 'আমি কিন্তু এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ নই, শরীরের ভেতরে এখনও রোগটা রয়েই গেছে। তবে আবার কাজে ফিরেছি, সব কাজ করার চেষ্টা করছি, শরীরটা কিন্তু এ তো খারাপ লাগছে না। তার একটাই কারণ, মনের জোর। মাঝখানে হচ্ছে লাইফস্টাইলের কিছু পরিবর্তন। যতটুকু সম্ভব সাদামাটা জীবনে যদি ফিরে আসা যায়, তাহলে সেটাই শরীরের জন্য মঙ্গলজনক। শেষ কথা হচ্ছে, নিজেকে ভালোবাসতে হবে।'
শেষটা সুন্দর করেই বোঝালেন নাতাশা- 'শরীরের সব অংশ তো রোগী নয়। রোগী যেটুকু, সেটুকু বাদে বাকি পুরোটাই কিন্তু আনন্দ, নীরোগ, সুস্থ। আলোর মতো। যতক্ষণ যন্ত্রণা নিয়ন্ত্রণে, খানিক হলেও সামলে নেওয়া যাচ্ছে, ততক্ষণ এই আনন্দটাকে অনুভব করুন। নিজের শখ, নিজের ইচ্ছেগুলোর গোড়ায় পানি দিন। খুব ক্লান্ত লাগবে, ভালো লাগবে না কিছুই। তখন মনকে জাগাবেন গান-কবিতা বা আপনার শখের কাজটির মাধ্যমে। ধৈর্য ধরে মনের জোর টিকিয়ে রাখতে পারলেই জয়ের পথে খানিক এগোনো যায়। এরপরও মৃত্যু আসতেই পারে। কিন্তু নিয়তির লিখন মোছা যাবে না জেনেই মরার আগেই যেন মরে না যাই আমরা।' া
মন্তব্য করুন