ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী পদে সদ্য অভিষিক্ত লিজ ট্রাসের জন্য এই মুহূর্তটা হতে পারত বিজয় উদযাপনের; তাঁর পক্ষে ওঠা জনতার উল্লাস ধ্বনি উপভোগের। কিন্তু তাঁর এ বিজয় এমন এক সময়ে এলো, যখন তা বেশ পানসে মনে হচ্ছে। শুরুতে একটু খুঁড়িয়ে চললেও, গত দুই মাসের প্রচারাভিযানকালে ট্রাসকে বেশ আত্মবিশ্বাসী, জীবন্ত ও বেপরোয়া মনে হচ্ছিল। তার সবই এখন যেন উবে গেছে। খুবই স্বল্প ব্যবধানে ঋষি সুনাককে পরাজিত করে ডায়াসে উঠে ট্রাস যে বিজয় ভাষণ দিলেন, তাতে দেখা গেল সেই পুরোনো, কিছুটা পানসে ও কথা বলার আনুষ্ঠানিক ধরন ফিরে এসেছে। কথাটা ট্রাস বলে বলছি, এতে স্নায়ুচাপের লক্ষণ বেশ স্পষ্ট। সম্ভবত বিজয়ের পরেই ট্রাস বুঝতে পারছেন, তাঁর মাথার ওপর ভারী কিছু চেপে আছে। টোরি পার্টির অনুগত সদস্যরা বরিস জনসন সম্পর্কে ভালো কিছু বলতে গেলে রীতিমতো শব্দ হাতড়ে বেড়ান। কিন্তু তাঁরাই মাঝেমধ্যে দাবি করেন- বরিস অন্তত বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সফল ছিলেন। ওইসব গতানুগতিক বক্তব্য দিয়ে বরিসের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন অরাজক পরিস্থিতিকে হয়তো ঢেকে রাখা যাবে না; তারপরও তাঁদেরকে এসব বলতে হয়। কারণ একটা সংকটজনক পরিস্থিতিতে অন্তত আত্মবিশ্বাস ধরে রাখার মতো কিছু কথা একজন প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে লোকেরা আশা করে। তবে হঠাৎ একটা অরাজক পরিস্থিতি যখন সামনে আসে তখন আমাদের প্রত্যাশা, ওই সমর্থকদের সহজাত চেতনা ঠিক পথে থাকবে; অন্য যে কোনো বিষয়ে তাঁদের সঙ্গে আমাদের যতই মতদ্বৈধতা থাকুক না কেন। ট্রাসের জন্য যেটা ব্যতিক্রম সেটা হলো, দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথমেই স্বীকার করতে হবে- প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁকে শুরু করতে হচ্ছে কতগুলো বড় বিষয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে।
ট্রাস হয়তো স্বীকার করবেন না; তবে বাস্তবতা হলো, জীবনযাত্রার ব্যয় বিষয়ে তাঁর ধারণা ছিল মারাত্মকভাবে ভ্রান্ত। তিনি ভেবেছিলেন, স্রেফ কর হ্রাস ও জ্বালানি তেলের ওপর আরোপিত পরিবেশ কর কমিয়ে চলমান সংকট সামাল দেবেন। আশার কথা, তিনি হয়তো সংকটের গভীরতা এখন বুঝতে পারছেন এবং এটাও উপলব্ধি করতে পারছেন, পরিস্থিতি আরও বড় ও সরাসরি হস্তক্ষেপ দাবি করছে। নিজের অহম ভুলে তিনি যদি তাঁর ১০০ বিলিয়ন পাউন্ড খরচের পরিকল্পনায় লেবার পার্টির জ্বালানি বিল স্থগিত রাখার জনপ্রিয় নীতি ঢোকাতে পারেন, তাহলে লাখ লাখ মানুষ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। এর মাধ্যমে শুধু যে আসন্ন শীতে দরিদ্র মানুষদের চরম দুর্গতি থেকে বাঁচাতে পারবেন, তাই নয়; এ মুহূর্তে একটা মহাবিপর্যয় থেকে জাতিকে বাঁচাতে যে আত্মবিশ্বাস ও নিশ্চয়তাবোধ জাগানো দরকার, তাও তিনি করতে পারবেন। আগামী কয়েক মাস কেমন যেতে পারে, মানুষ যদি তা আঁচ করতে না পারে তাহলে সচ্ছল মানুষও তাদের অর্থ খরচ না করে জমাতে শুরু করবে, যা অর্থনীতির জন্য বিধ্বংসী এক পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
এ মুহূর্তে ট্রাসের পক্ষে ওই কর কর্তন প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসার সুযোগ নেই। কারণ তা তাঁর দলের মধ্যে বিদ্রোহের জন্ম দিতে পারে। আবার এটাও স্পষ্ট নয়- কর কর্তন করা হলে বাজেটে যে ঘাটতি তৈরি হবে তা তিনি কীভাবে পূরণ করবেন। তবে এটুকু বোঝা যাচ্ছে, তিনি এমন এক মাত্রায় ঋণ নেওয়ার দিকে ঝুঁকবেন, যা এক সময় লেবার পার্টির সাবেক নেতা জেরেমি করবিন প্রস্তাব করেছিলেন। করবিন যখন ওই প্রস্তাব করেছিলেন তখন বলা হয়েছিল, এর ফলে কেয়ামতের মতো কিছু ঘটে যেতে পারে। কারণ তা জাতীয় ক্রেডিট রেটিংকে মারাত্মকভাবে কমিয়ে দেবে। এমনকি সরকারকে আইএমএফের কাছে হাত পাতার মতো অবমাননাকর কিছুর দিকেও ঠেলে দিতে পারে। এ ধরনের সতর্কতা আসলে অতিরঞ্জিত ছিল। হিসাবের খাতা আপনি যেভাবেই মেলান, যতক্ষণ তা প্রথাকে মেনে চলে ততক্ষণ তাতে কোনো সমস্যা নেই এবং একমাত্র জয়ের ইচ্ছা যাঁর আছে তিনিই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আমরা যদি তা হতে না পারি তাহলে দেখব, আমাদের গাড়িটা সোজা কংক্রিটের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। এটি সম্ভবত এমন এক ক্ষতি হবে, যার তুলনা হতে পারে সেই কৃষ্ণ বুধবারের ক্ষতির সঙ্গে। ১৯৯২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ছিল সেই বুধবার, যেদিন পাউন্ডের মান এতটাই পড়ে যায় যে, ব্রিটেনকে ইউরোপীয় মুদ্রা বিনিময় মেকানিজম থেকে সরে আসতে হয়।
ডাউনিং স্ট্রিটে গিয়ে ট্রাস হিসাবের বইটা খোলার পর আমার ধারণা, নতুন করে গোনা শুরু করবেন। তবে এটাও নিশ্চিত, তিনি সোজাসাপ্টা ব্যাংক অব ইংল্যান্ডকে পরিস্থিতির জন্য দায়ী করার জেদ ছেড়ে দেবেন না; যদিও বাজেট দেখাশোনার দায়িত্বপ্রাপ্ত এ কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার কাজে সম্পূর্ণ স্বাধীন। সেই মূলধারার অর্থনীতিবিদদেরও, যাঁদেরকে তিনি প্রায়ই প্রাচীন ধারার অচল অ্যাবাকাস অর্থনীতিচর্চার দায়ে অভিযুক্ত করেন; ছেড়ে দেবেন না। ইতোমধ্যে তিনি একটা স্বাধীন অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন, যা এই ইঙ্গিত দেয়- বিপরীত ধরনের প্রজ্ঞার অনুসন্ধান চালাচ্ছেন। তাঁর এ অবস্থানের সমর্থনে তিনি মার্গারেট থ্যাচারের সাবেক উপদেষ্টা ৭৯ বছর বয়স্ক অধ্যাপক প্যাট্রিক মাইনফোর্ডকে উদ্ৃব্দত করেছেন। এটা দেখে অনেকেরই চক্ষু চড়কগাছ। বরিসের জনতুষ্টিবাদী নীতি দেশের আইন-আদালত, সংসদ, মিডিয়া- সবাইকে তাদের শেষ সীমার দিকে ঠেলে দিয়েছিল। এতে প্রমাণিত- আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো অন্তত বরিসের মতো আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো লোকদের সামলানোর যোগ্যতা অর্জন করেনি। ট্রামের সময়ে একই পরিণতি বরণের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে অর্থনীতিবিদ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকারদের। এ এমন এক পরিণতি, যা তাঁরা আগে কখনোই ভাবতে পারেননি; যাকে একসময় বলা হতো ব্যবসায়ীদের পার্টি।
এদিকে করবিনবাদ থেকে ট্রাসবাদের স্বাতন্ত্র্য হলো, ট্রাসবাদে ব্যাপক ধার নেওয়ার পাশাপাশি বেদনাদায়ক ব্যয় সংকোচনও চলবে। কারণ বিভাগীয় বাজেটগুলো এমন এক সময়ে নির্ধারিত হয়েছিল, যখন মূল্যস্ম্ফীতি ছিল কম। এখন নির্মাণ খরচ থেকে পাবলিক সেক্টরে মজুরি; সবই বেড়ে গেছে। অতএব, বাজেটও পুনর্নির্ধারণ করা হবে।
রাজনীতিতে মাঝেমধ্যে জোর করে কিছু বিশ্বাস করতে হয়; একেবারে শূন্যের ওপরেও কিছুটা আশাবাদী হতে হয়। কিন্তু বর্তমানে নজিরবিহীনভাবে আমাদের ট্রাসের বিচারধারার ওপর বিশ্বাস রাখতে বলা হচ্ছে। এমন একটা ধারণা দেওয়া হচ্ছে যে, ট্রাস একজন ভিশনারি নেতা। তাঁর এমন কিছু জাদুকরী ক্ষমতা আছে, যা দিয়ে প্রবৃদ্ধির উল্লম্ম্ফন ঘটানো যাবে। এ ক্ষমতা নাকি ট্রাসের পূর্বসূরি টোরি প্রশাসনের লোকদের ছিল না; অথচ ট্রাসের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সুনাকের মতে, একই আইডিওলজি থেকে বরিসের আমলে করপোরেট কর কমানো হয়, কিন্তু এর ফল হয়েছিল উল্টো। ট্রাস আসলে প্রচণ্ড এক প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আমাদের জীবন নিয়ে এক জুয়া খেলতে চাইছেন। খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও, ট্রাস যখন ওই মঞ্চে একাকী দাঁড়িয়ে ছিলেন; তাঁকে দেখে আমার মনে হয়েছে, তিনি বিষয়টা জানেন।
গ্যাবি হিনস্লিফ :দ্য গার্ডিয়ানের কলাম লেখক; দ্য গার্ডিয়ান থেকে ভাষান্তর সাইফুর রহমান তপন