- ফিচার
- শতরঞ্জিতে সাজুক ঘর
শতরঞ্জিতে সাজুক ঘর

আজকাল ঘর সাজাতে অনেক শৌখিন ও রুচিশীল মানুষ ব্যবহার করছেন শতরঞ্জি। এর ব্যবহারে ঘরে বাঙালিয়ানা ভাব ফুটে ওঠে। মেঝে ও দেয়াল সব জায়গায় শতরঞ্জির ব্যবহার ঘরকে আকর্ষণীয় করে তোলে। লিখেছেন সানজানা এস পায়েল
রংপুর অঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী কারুপণ্য হলো শতরঞ্জি। কার্পেটের মতো দেখতে হলেও, এটি কার্পেটের মতো ভারী নয়। বাঁশ এবং রশি দিয়ে ছোট বা বড় চরকার মাধ্যমে সুতা টানা দিয়ে গ্রামের বুনন শিল্পীরা খুব যত্নের সাহায্যে শতরঞ্জি তৈরি করেন। এসব শতরঞ্জি দেশ-বিদেশের ক্রেতার নজর কেড়েছে। বসার ঘরের মেঝে, শোবার ঘর, শিশুর ঘরের মেঝেতে এসব শতরঞ্জি রাখা যায়। খাবার টেবিলের ওপরও টেবিল ম্যাট ও রানারের মতো করে শতরঞ্জি বিছানো যায়। ওয়ালম্যাট, জায়নামাজ, পাপোশ হিসেবেও ব্যবহূত হয় শতরঞ্জি।
ইতিহাস :শতরঞ্জির ইতিহাস প্রায় কয়েকশ বছর পুরোনো। মোগল আমল থেকে রংপুরে শতরঞ্জি তৈরি করা হতো। ১৮৩০ সালে জনৈক ব্রিটিশ কালেক্টর মি. নিশবেত রংপুরে শহরতলির পীরপুর গ্রামে গিয়ে শতরঞ্জি দেখে অনেক মুগ্ধ হন। তিনি শতরঞ্জির প্রসারে অনেক সাহায্য করেন। সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই শতরঞ্জি অনেক জনপ্রিয়।
উপকরণ :শতরঞ্জি তৈরির প্রধান উপকরণ সুতা। স্থানীয় বাজার থেকে কটন সুতা, পাট, শ্যানালসহ (উল জাতীয়) বিভিন্ন ধরনের ফাইবার কিনে প্রয়োজনমতো রং করে শুকিয়ে নেন তাঁতিরা। সুতা টানা দেওয়া হয় বাঁশের ফ্রেমে। টানার দৈর্ঘ্য সাধারণত ১০ থেকে ৩৫ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। সুতার বান্ডিল তৈরি করে শতরঞ্জি তাঁতে বা মেঝেতে বিছিয়ে নকশা অনুযায়ী হাতে বোনা হয়। হাতের কৌশলই শতরঞ্জি নির্মাণের ভিত্তি; তবে সুতার গাঁথুনি শক্ত করার জন্য পাঞ্জা (চিরুনির মতো দেখতে বিশেষ যন্ত্র) ব্যবহার করা হয়।
নকশা :শতরঞ্জি তৈরিতে দুই ধরনের নকশা ব্যবহার করা হয়। একটি প্রাচীন বা ঐতিহ্যবাহী এবং অন্যটি আধুনিক নকশা। প্রাচীন নকশাগুলোর মধ্যে রয়েছে হাতি-ঘোড়া, রাজা-রানী, কলসিসহ নারী, পৌরাণিক চরিত্র, নবান্ন, পূজা-পার্বণ ইত্যাদি। আধুনিক নকশাগুলোর মধ্যে রয়েছে- পানপাতা, মাছ, পাখি, নৌকা, বিবি রাসেলের উদ্ভাবিত নকশা ইত্যাদি। শতরঞ্জির নকশা এমন কায়দায় বোনা হয় যেন এটি দুই পাশেই ব্যবহার করা যায়। এর কোনো উল্টো পাশ নেই, দুই পাশে থাকে দুই রকম রঙের নকশার অদলবদল।
উৎপাদন ও আয় :শতরঞ্জি সাধারণত আসন, শয্যা, বিছানা, সভা বা মজলিসে ব্যবহূত হয়। বর্তমানে রংপুরের বেশ কয়েকটি এলাকায় এবং বিভিন্ন জেলাতেও গড়ে উঠছে শতরঞ্জি কারখানা। রংপুর শহরের উপকণ্ঠে ঘাঘট নদীর তীরে কয়েকটি গ্রামে এই শতরঞ্জির উৎপাদন হয়। ভৌগোলিক ও আবহাওয়াজনিত কারণে রংপুরের ঘাঘট নদীর পানি শতরঞ্জি সুতার রঙের উপযোগী। জানা যায়, রংপুরের আবহাওয়া ও জলবায়ুর কারণেই রংপুরে শতরঞ্জি শিল্পের কারুশিল্প গড়ে উঠেছে শত শত বছর আগে। রংপুরে রবার্টসন এলাকায় 'কারুপণ্য রংপুর লিমিটেড'-এর উদ্যোগে শতরঞ্জি উৎপাদন হচ্ছে।
চাহিদা বাড়ার ফলে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান 'আইকা' ও 'বিবি রাসেল'-এর উদ্যোগে রংপুরের শতরঞ্জি উৎপাদনশীলতার মাধ্যমে দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রপ্তানির বিপুল সম্ভাবনা সৃষ্টি হচ্ছে। অবাধ বাণিজ্য ও তুমুল প্রতিযোগিতার বাজারে রংপুরের শতরঞ্জি বর্তমানে বিশ্বের ৩৬টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
অনলাইনে শতরঞ্জি :অনলাইনেও এখন বিভিন্ন পেজে শতরঞ্জি বিক্রয় করা হয়। ফেসবুকে জনপ্রিয় পেজ দেশি পণ্যের স্বত্বাধিকারী নাবিলা আনজুম জানিয়েছেন, তাঁরা শতরঞ্জি বিক্রি শুরু করেন ২০২০ সালে। বর্তমানে তাঁর পেজে শতরঞ্জির চাহিদা অনেক বেশি হলেও প্রাথমিকভাবে চাহিদা আশানুরূপ ছিল না। দেশি পণ্য পেজ থেকে জানা যায়, এটি সর্বাধিক ব্যবহূত হয় মানুষের বসার ঘরের মেঝেতে। শতরঞ্জির দাম ডিজাইনের ওপর নির্ভর করে প্রতি বর্গফুটে ৭০ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। অন্যদিকে শতরঞ্জির জন্য অনলাইনে আরেকটি জনপ্রিয় পেজ হচ্ছে মনিহারি। এই পেজের স্বত্বাধিকারী শারমিন ইম্মি জানিয়েছেন, তাঁরা শতরঞ্জি বিক্রি শুরু করেছেন ২০২১ সাল থেকে এবং প্রথম দিকেই বিশাল সাড়া পেয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, করোনাকালে মানুষ যেহেতু ঘরে বেশি সময় কাটিয়েছেন, তাই ঘর সাজানোর জন্য শতরঞ্জির চাহিদা অনেক বেশি ছিল। তিনি জানিয়েছেন, প্রতি মাসে তাঁদের শতরঞ্জি বিক্রি হয় গড়ে ৩০ থেকে ৪০টি, যেখানে শীতকালে তা বেড়ে ৭০-৮০টি পর্যন্ত হয়। তাঁদের সর্বোচ্চ বিক্রির সংখ্যা মাসে ১০০টির মতো। তাঁর পেজে ১ হাজার ৪৫০ থেকে ৫ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত শতরঞ্জি পাওয়া যায়। তাঁরা দু'জনেই জানিয়েছেন মানুষের বেশি পছন্দ ৩-৫ ফুটের শতরঞ্জি এবং শীতকালে শতরঞ্জির চাহিদা অনেক বেশি বেড়ে যায়। তাঁরা উভয়েই এটিও জানিয়েছেন, শতরঞ্জির বুনন এবং প্রস্তুতকরণের তুলনায় বিক্রয় মূল্য অনেক কম।
কালের আবর্তে অনেক কারুশিল্প হারিয়ে গেলেও শতরঞ্জি শিল্প বহুকাল থেকে আপন ঐতিহ্য নিয়ে শুধু টিকে আছে তাই নয়, বর্তমানে এর নকশা, নান্দনিকতা এবং আধুনিকতার কারণে এই শিল্পটির ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল ও সম্ভাবনাময়। া
রংপুর অঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী কারুপণ্য হলো শতরঞ্জি। কার্পেটের মতো দেখতে হলেও, এটি কার্পেটের মতো ভারী নয়। বাঁশ এবং রশি দিয়ে ছোট বা বড় চরকার মাধ্যমে সুতা টানা দিয়ে গ্রামের বুনন শিল্পীরা খুব যত্নের সাহায্যে শতরঞ্জি তৈরি করেন। এসব শতরঞ্জি দেশ-বিদেশের ক্রেতার নজর কেড়েছে। বসার ঘরের মেঝে, শোবার ঘর, শিশুর ঘরের মেঝেতে এসব শতরঞ্জি রাখা যায়। খাবার টেবিলের ওপরও টেবিল ম্যাট ও রানারের মতো করে শতরঞ্জি বিছানো যায়। ওয়ালম্যাট, জায়নামাজ, পাপোশ হিসেবেও ব্যবহূত হয় শতরঞ্জি।
ইতিহাস :শতরঞ্জির ইতিহাস প্রায় কয়েকশ বছর পুরোনো। মোগল আমল থেকে রংপুরে শতরঞ্জি তৈরি করা হতো। ১৮৩০ সালে জনৈক ব্রিটিশ কালেক্টর মি. নিশবেত রংপুরে শহরতলির পীরপুর গ্রামে গিয়ে শতরঞ্জি দেখে অনেক মুগ্ধ হন। তিনি শতরঞ্জির প্রসারে অনেক সাহায্য করেন। সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই শতরঞ্জি অনেক জনপ্রিয়।
উপকরণ :শতরঞ্জি তৈরির প্রধান উপকরণ সুতা। স্থানীয় বাজার থেকে কটন সুতা, পাট, শ্যানালসহ (উল জাতীয়) বিভিন্ন ধরনের ফাইবার কিনে প্রয়োজনমতো রং করে শুকিয়ে নেন তাঁতিরা। সুতা টানা দেওয়া হয় বাঁশের ফ্রেমে। টানার দৈর্ঘ্য সাধারণত ১০ থেকে ৩৫ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। সুতার বান্ডিল তৈরি করে শতরঞ্জি তাঁতে বা মেঝেতে বিছিয়ে নকশা অনুযায়ী হাতে বোনা হয়। হাতের কৌশলই শতরঞ্জি নির্মাণের ভিত্তি; তবে সুতার গাঁথুনি শক্ত করার জন্য পাঞ্জা (চিরুনির মতো দেখতে বিশেষ যন্ত্র) ব্যবহার করা হয়।
নকশা :শতরঞ্জি তৈরিতে দুই ধরনের নকশা ব্যবহার করা হয়। একটি প্রাচীন বা ঐতিহ্যবাহী এবং অন্যটি আধুনিক নকশা। প্রাচীন নকশাগুলোর মধ্যে রয়েছে হাতি-ঘোড়া, রাজা-রানী, কলসিসহ নারী, পৌরাণিক চরিত্র, নবান্ন, পূজা-পার্বণ ইত্যাদি। আধুনিক নকশাগুলোর মধ্যে রয়েছে- পানপাতা, মাছ, পাখি, নৌকা, বিবি রাসেলের উদ্ভাবিত নকশা ইত্যাদি। শতরঞ্জির নকশা এমন কায়দায় বোনা হয় যেন এটি দুই পাশেই ব্যবহার করা যায়। এর কোনো উল্টো পাশ নেই, দুই পাশে থাকে দুই রকম রঙের নকশার অদলবদল।
উৎপাদন ও আয় :শতরঞ্জি সাধারণত আসন, শয্যা, বিছানা, সভা বা মজলিসে ব্যবহূত হয়। বর্তমানে রংপুরের বেশ কয়েকটি এলাকায় এবং বিভিন্ন জেলাতেও গড়ে উঠছে শতরঞ্জি কারখানা। রংপুর শহরের উপকণ্ঠে ঘাঘট নদীর তীরে কয়েকটি গ্রামে এই শতরঞ্জির উৎপাদন হয়। ভৌগোলিক ও আবহাওয়াজনিত কারণে রংপুরের ঘাঘট নদীর পানি শতরঞ্জি সুতার রঙের উপযোগী। জানা যায়, রংপুরের আবহাওয়া ও জলবায়ুর কারণেই রংপুরে শতরঞ্জি শিল্পের কারুশিল্প গড়ে উঠেছে শত শত বছর আগে। রংপুরে রবার্টসন এলাকায় 'কারুপণ্য রংপুর লিমিটেড'-এর উদ্যোগে শতরঞ্জি উৎপাদন হচ্ছে।
চাহিদা বাড়ার ফলে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান 'আইকা' ও 'বিবি রাসেল'-এর উদ্যোগে রংপুরের শতরঞ্জি উৎপাদনশীলতার মাধ্যমে দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রপ্তানির বিপুল সম্ভাবনা সৃষ্টি হচ্ছে। অবাধ বাণিজ্য ও তুমুল প্রতিযোগিতার বাজারে রংপুরের শতরঞ্জি বর্তমানে বিশ্বের ৩৬টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
অনলাইনে শতরঞ্জি :অনলাইনেও এখন বিভিন্ন পেজে শতরঞ্জি বিক্রয় করা হয়। ফেসবুকে জনপ্রিয় পেজ দেশি পণ্যের স্বত্বাধিকারী নাবিলা আনজুম জানিয়েছেন, তাঁরা শতরঞ্জি বিক্রি শুরু করেন ২০২০ সালে। বর্তমানে তাঁর পেজে শতরঞ্জির চাহিদা অনেক বেশি হলেও প্রাথমিকভাবে চাহিদা আশানুরূপ ছিল না। দেশি পণ্য পেজ থেকে জানা যায়, এটি সর্বাধিক ব্যবহূত হয় মানুষের বসার ঘরের মেঝেতে। শতরঞ্জির দাম ডিজাইনের ওপর নির্ভর করে প্রতি বর্গফুটে ৭০ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। অন্যদিকে শতরঞ্জির জন্য অনলাইনে আরেকটি জনপ্রিয় পেজ হচ্ছে মনিহারি। এই পেজের স্বত্বাধিকারী শারমিন ইম্মি জানিয়েছেন, তাঁরা শতরঞ্জি বিক্রি শুরু করেছেন ২০২১ সাল থেকে এবং প্রথম দিকেই বিশাল সাড়া পেয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, করোনাকালে মানুষ যেহেতু ঘরে বেশি সময় কাটিয়েছেন, তাই ঘর সাজানোর জন্য শতরঞ্জির চাহিদা অনেক বেশি ছিল। তিনি জানিয়েছেন, প্রতি মাসে তাঁদের শতরঞ্জি বিক্রি হয় গড়ে ৩০ থেকে ৪০টি, যেখানে শীতকালে তা বেড়ে ৭০-৮০টি পর্যন্ত হয়। তাঁদের সর্বোচ্চ বিক্রির সংখ্যা মাসে ১০০টির মতো। তাঁর পেজে ১ হাজার ৪৫০ থেকে ৫ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত শতরঞ্জি পাওয়া যায়। তাঁরা দু'জনেই জানিয়েছেন মানুষের বেশি পছন্দ ৩-৫ ফুটের শতরঞ্জি এবং শীতকালে শতরঞ্জির চাহিদা অনেক বেশি বেড়ে যায়। তাঁরা উভয়েই এটিও জানিয়েছেন, শতরঞ্জির বুনন এবং প্রস্তুতকরণের তুলনায় বিক্রয় মূল্য অনেক কম।
কালের আবর্তে অনেক কারুশিল্প হারিয়ে গেলেও শতরঞ্জি শিল্প বহুকাল থেকে আপন ঐতিহ্য নিয়ে শুধু টিকে আছে তাই নয়, বর্তমানে এর নকশা, নান্দনিকতা এবং আধুনিকতার কারণে এই শিল্পটির ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল ও সম্ভাবনাময়। া
বিষয় : শতরঞ্জি
মন্তব্য করুন