নবজাতককে বরণ করে নিতে মা-বাবার প্রস্তুতির কমতি থাকে না। তারপরও অনেকটা খামতি থেকে যায়। এর কারণ হচ্ছে নবজাতকের যত্নে প্রচলিত কিছু ভুল রীতি ও অজ্ঞতা। বিশেষজ্ঞদের মতে, নবজাতকের যত্নের ক্ষেত্রে রয়েছে নির্দিষ্ট কিছু নিয়মকানুন। এগুলো অনুসরণ করলে সদ্যোজাত শিশু স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বেড়ে ওঠে। এ ব্যাপারে নবজাতক বিশেষজ্ঞ ডা. নাজমুন নাহার মনে করেন, প্রত্যেক বাবা-মা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সদ্যোজাত শিশুর যত্নের ব্যাপারে কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখা উচিত।
প্রচলিত প্রথানুযায়ী শিশুর জন্মের পরপরই তাকে গোসল করিয়ে প্রথম ভুল করা হয়। এটা মোটেই উচিত নয়। কেননা তার গায়ে লেগে থাকা তরল পদার্থ নোংরা মনে হলেও এটি মোটেও তা নয়। শিশুর শরীরে জীবাণু প্রবেশে প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে এটি।
একটি শিশু মায়ের গর্ভে থাকাকালীন প্রয়োজনমতো তাপমাত্রা পায়। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরও যেন সে উপযুক্ত তাপমাত্রায় থাকে, সেদিকে লক্ষ্য রাখা জরুরি। এজন্য শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে তার শরীরে লেগে থাকা তরল পদার্থ পাতলা ও নরম কাপড় দিয়ে মুছে শুস্ক করতে হবে। শিশু যদি পূর্ণ গর্ভাবস্থায় জন্মগ্রহণ করে তাহলে তাকে ২৬-২৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় রাখা উচিত। শিশুর এই তাপমাত্রা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন তাকে মায়ের সঙ্গে রাখা। এমনভাবে রাখতে হবে যেন মায়ের ত্বকের সঙ্গে নবজাতকের ত্বক লেগে থাকে। এতে মায়ের শরীরের তাপমাত্রা থেকে শিশু প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা পায়।
অনেকে শিশুকে ভিটামিন ডি-সমৃদ্ধ করতে রোদে শুইয়ে রাখেন। এটা একদমই অনুচিত বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ। তাঁর মতে, দুপুর ১২টা পর্যন্ত নবজাতককে মায়ের কোলে শুইয়ে রোদে রাখা উচিত। তবে কখনও একটানা আধঘণ্টার বেশি রোদে রাখা ঠিক নয়। নবজাতকের নাভির প্রতি রাখতে হবে বিশেষ খেয়াল। জন্মের পরপরই নাভি কেটে দিতে হবে। নাভিতে তেল মেখে রোদে মেলে রাখার রীতিও পরিহার করতে হবে। এতে শিশুর নাভি জীবাণু দ্বারা সংক্রমণের সমূহ আশঙ্কা থাকে। শিশুর গোসলেও কিছু নিয়ম মানা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। নবজাতককে তিন দিন পরপর গা মুছিয়ে দিতে হবে। আর শিশু যদি প্রিম্যাচিউরড হয়, তবে এক-দুই মাস গোসল করানো যাবে না। এরপর সপ্তাহে একবার করে গোসল করানো যেতে পারে। অনেকে শিশুর গোসলের পানিতে স্যাভলন মিশিয়ে থাকেন। এটি একেবারেই উচিত নয়। পাশাপাশি শিশুর শরীরে তেল বা অলিভ অয়েল ছাড়া কোনো লোশন মাখাও অনুচিত। শিশুর ডায়াপারের ক্ষেত্রেও থাকতে হবে সচেতন। চার ঘণ্টার বেশি একটি ডায়াপার শরীরে রাখা যাবে না। ডায়াপার অবশ্যই নাভির নিচে পরাতে হবে। নবজাতকের পোশাকেও রয়েছে কিছু বিধিনিষেধ। সম্পূর্ণ ঢিলেঢালা পোশাক পরাতে হবে। এ ক্ষেত্রে কাপড় অবশ্যই সুতির হতে হবে। কোনোভাবে উল বা গরম কাপড়ের পোশাক পরানো যাবে না।
অপেক্ষাকৃত বড় শিশুদেরও ত্বকে ডার্মাটোলজিক্যালি ও ক্লিনিক্যালি পরীক্ষিত সাবান ও শ্যাম্পু ব্যবহার করতে হবে। নারকেল, আমন্ড ও জোজোবা তেলযুক্ত পণ্য ব্যবহার করতে হবে। কারণ শিশুর ত্বক খুব কোমল ও পাতলা। ত্বকের ক্ষতি হয় এমন পণ্য ব্যবহার করা যাবে না। গরম ও ঘামে অনেক সময় শিশুর মাথায় খুশকি ও দানা দেখা যায়। খুশকি দূর করতে অ্যান্টি-ড্যানড্রাফ শ্যাম্পু ব্যবহার করা যাবে না। শিশুর ত্বকে ব্যবহার উপযোগী শ্যাম্পু দিতে হবে।
শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য :শিশুর মানসিক বিকাশ ঘটাতে এবং শিশুকে সুন্দর পরিবেশের মধ্য দিয়ে গড়ে তুলতে প্রস্তুতি নিতে হবে ছোটবেলা থেকেই। শিশু যখন ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে, মা-বাবাকে দেখে আচরণ আয়ত্ত করতে থাকে। অবচেতন মনেই মা-বাবার আচরণ, কথাবার্তায় সে প্রস্তুত হয়। তার জগৎ ছোট থাকায় আশপাশের বিভিন্ন ঘটনা সে আত্মস্থ করে ফেলে। শিশুরা অনুকরণপ্রিয় হওয়ায় এই সময়টায় সবচেয়ে সতর্ক থাকতে হবে মা-বাবাকে। শিশুর মানসিক বিকাশে সবচেয়ে সহায়ক খেলাধুলা। তাই শিশুকে খেলতে উৎসাহ দিন। যেসব শিশু হাঁটতে শেখেনি, তারা শুয়ে শুয়ে যেন খেলতে পারে, সে ব্যবস্থা করে দিন। তার সঙ্গে নিজেরাও খেলুন। তাকে হাসতে শেখান। নিজেরা হাসুন। ধীরে ধীরে শিশু যখন বড় হতে থাকবে, তার হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেবেন না। যথাসম্ভব মোবাইল ফোন থেকে তাকে দূরে রাখুন। খেলনা হিসেবে প্রযুক্তিনির্ভর কিছু দেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
যেসব শিশু কথা বলতে পারে, অনবরত প্রশ্ন করাটা তাদের স্বভাবজাত। অনেক মা-বাবা ধমকে তাদের প্রশ্ন করা থেকে বিরত রাখেন। এটা মোটেও উচিত নয়। এতে শিশুর জানার স্পৃহা কমে যায়, যা মানসিক বিকাশে বাধাদান করে। শিশুর আচরণে সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে দাম্পত্য কলহ। এটি শিশুকে অন্যদের সঙ্গে বন্ধুবৎসল হতে বাধা দেয়। পাশাপাশি মানসিকভাবেও হুমকির মুখে ফেলে। একটি মানুষকে সামনে এগিয়ে চলার পথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আত্মবিশ্বাস ও পরিশ্রম। শিশুর ব্যর্থতাকে বড় করে না দেখে তাকে 'তুমি পারবে'- এমন প্রেরণাদায়ক কথা বলুন। পাশাপাশি পরিবারের সব কাজে শিশুর অংশ নেওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। া

বিষয় : শিশুর লালন

মন্তব্য করুন