১৯৬৯ সালে আমি ছিলাম পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। সে সময় আইয়ুববিরোধী গণআন্দোলনে প্রকম্পিত সারাদেশ। সে আন্দোলনের ঝোড়ো হাওয়ায় আন্দোলিত আমার কিশোর মন। বড় ভাইদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে 'আইয়ুব-মোনায়েম দুই ভাই/ এক রশিতে ফাঁসি চাই' স্লোগান দিয়ে মিছিল করতাম আমাদের থানা সদর শ্রীনগরে (মুন্সীগঞ্জ)। শাহ্‌ মোয়াজ্জেম হোসেন নামটির সঙ্গে পরিচয় ঘটে তখনই। তবে স্বচক্ষে তাঁকে দেখি ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে শ্রীনগর হাই স্কুল প্রাঙ্গণের এক জনসভায়। তাঁর জ্বালাময়ী ভাষণ আমাকে শিহরিত করে। আমি রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। কিন্তু তাঁর সঙ্গে আমার রাজনৈতিক সম্পর্ক হয় ২০০৬ সালে; তিনি বিএনপিতে যোগ দেওয়ার পর। এই ঘনিষ্ঠতা তাঁর জীবদ্দশায় শেষ দিন পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল। যদিও বিএনপি থেকে আমি পদত্যাগ করার পর তাঁর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ কমে গিয়েছিল। তারপরও মাঝেমধ্যে যেতাম তাঁর বাসায়। তাঁর কাছে অতীত রাজনৈতিক ঘটনাবলি জানা যেত। ঘটনার অন্তরালের অনেক ঘটনাই জেনেছি তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতায়। তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময় তাঁকে আমার বাংলাদেশের রাজনীতির জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া বলে মনে হয়েছে।
বর্ণাঢ্য এক রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী ছিলেন শাহ্‌ মোয়াজ্জেম হোসেন। অষ্টম শ্রেণির ছাত্র থাকাবস্থায় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে মিছিলে অংশগ্রহণ এবং গ্রেপ্তার হওয়ার মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনীতির পথচলা শুরু। তারপর দীর্ঘ ৭০ বছরের পথচলার অবসান হলো এ বছর ১৪ সেপ্টেম্বর। ইহলোক ত্যাগ করে চলে গেলেন তিনি। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি যেমন সমাদৃত হয়েছেন, তেমনি সমালোচনারও পাত্র হয়েছেন। এ দেশের প্রাচীনতম ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং একাধিকবার সভাপতি ছিলেন। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার পর তিনি গভীর সান্নিধ্যে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। অত্যন্ত স্নেহভাজন শিষ্যে পরিণত হন তিনি বঙ্গবন্ধুর। তাঁর সাহস, সাংগঠনিক দক্ষতা এবং বাগ্মিতা তাঁকে বঙ্গবন্ধুর প্রিয় পাত্রে পরিণত করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন ঢাকা-৫ (বর্তমানে মুন্সীগঞ্জ-১) আসন থেকে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন শাহ্‌ মোয়াজ্জেম হোসেন। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে যে প্রতিনিধি দলটি দিল্লিতে পাঠিয়েছিল, তাতে কনিষ্ঠতম সদস্য ছিলেন শাহ্‌ মোয়াজ্জেম হোসেন। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিজে উদ্যোগী হয়ে ভারতের যৌথ পার্লামেন্টে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের বক্তৃতা করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। সেদিন শাহ্‌ মোয়াজ্জেম হোসেন দীর্ঘ আড়াই ঘণ্টা বক্তৃতা করেছিলেন ইংরেজিতে। সে বক্তৃতায় তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচার ও বর্বরোচিত গণহত্যার কথা মর্মস্পর্শী ভাষায় তুলে ধরেছিলেন। সে ঘটনার কথা তিনি তাঁর 'বলেছি বলছি বলব' গ্রন্থে সবিস্তারে তুলে ধরেছেন।
স্বাধীনতার পর তিনি প্রথম জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নিযুক্ত হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর গঠিত মোশতাক সরকারের তিনি ছিলেন পর্যটন প্রতিমন্ত্রী। তাঁর এ অবস্থান তাঁকে যথেষ্ট বিতর্কিত করে। পরবর্তী সময়ে এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়ে প্রথমে মন্ত্রী, তারপর উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং জাতীয় পার্টির মহাসচিব হন। তাঁর এই রাজনৈতিক অবস্থান বদল সমালেচিত হয়েছে তীব্রভাবেই। একদা বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী এবং শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত অনুগত শাহ্‌ মোয়াজ্জেম হোসেন কী করে সম্পূর্ণ বিপরীত ধারার বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদভিত্তিক রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হলেন- এ প্রশ্ন ছিল অনেকের। রাজনৈতিক অবস্থান বদল, প্রতিপক্ষকে তির্যক ভাষায় আক্রমণ ইত্যাদি কারণে তিনি সমালেচিত ছিলেন। তবে দলীয় কর্মী এবং এলাকার উন্নয়ন ও এলাকাবাসীর কল্যাণে তিনি ছিলেন নিবেদিত। কর্মীদের আপদ-বিপদে তিনি আবির্ভূত হতেন ত্রাণকর্তা রূপে। বিক্রমপুরে তাঁর সম্পর্কে একটি কথা প্রচলিত ছিল- কেউ যদি শাহ্‌ মোয়াজ্জেমের জন্য হাঁটুপানিতে নামে, তিনি তার জন্য গলাপানিতে নামতে দ্বিধা করেন না। শ্রীনগর-লৌহজং তথা পশ্চিম বিক্রমপুরের শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, সমাজ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে শাহ্‌ মোয়াজ্জেম হোসেনের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। পেশায় আইনজীবী আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ শাহ্‌ মোয়াজ্জেম হোসেন রাজনীতিকে ব্যবহার করে বিত্ত-বৈভব গড়ার কথা ভাবেননি কখনোই। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে একাধিকবার রাষ্ট্রক্ষমতার পাদপ্রদীপের নিচে থাকা সত্ত্বেও তাঁর বিরুদ্ধে ১ টাকার দুর্নীতির অভিযোগও কেউ উত্থাপন করতে পারেনি। এরশাদের পতনের পর সংগত কারণেই মোয়াজ্জেম ভাইকে জেলে যেতে হয়েছিল। তাঁর বিরুদ্ধে খাদ্যমন্ত্রী থাকাকালে দুই লাখ চটের বস্তা ক্রয় সংক্রান্ত একটি দুর্নীতির মামলা হয়। কিন্তু তদন্তে সে মামলা ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয় এবং তিনি বেকসুর খালাস পান। মোয়াজ্জেম ভাই মাঝেমধ্যেই আক্ষেপ করতেন রাজনীতির পচনশীল অবস্থা দেখে। বলতেন, রাজনীতিতে এখন নোটের রাজত্ব। অনেকেই আশা করেছিলেন, মোয়াজ্জেম ভাইয়ের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞাকে বিবেচনায় নিয়ে তাঁকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য করা হবে। এ বিষয়ে খালেদা জিয়া তাঁকে একাধিকবার কথাও নাকি দিয়েছিলেন বলে মোয়াজ্জেম ভাই বলেছিলেন। কিন্তু তা হয়নি। কেন হয়নি, তা কারও অজানা নেই। তিনি আক্ষেপ করে বলতেন, আমার কর্মীর কর্মী যেখানে স্থায়ী কমিটির সদস্য, সেখানে আমি কোথায়? কয়েকবার ইস্তফাও দিতে চেয়েছেন। কিন্তু ঘনিষ্ঠজনের পরামর্শে বিরত থেকেছেন। এক বুক যন্ত্রণা ও অভিমান নিয়েই চলে গেলেন শাহ্‌ মোয়াজ্জেম হোসেন।
১৫ সেপ্টেম্বর শ্রীনগর স্টেডিয়ামে তাঁর জানাজা শেষে ঢাকায় ফিরছিলাম প্রবীণ রাজনীতিক শফি বিক্রমপুরীর সঙ্গে। একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন, 'রাজনৈতিক অঙ্গনে আমাকে তুমি করে বলার মতো আর কেউ রইল না!' বললাম, শুধু তাই নয়; সমস্যা-সংকটে পরামর্শ-উপদেশ পেতে যাওয়ার কোনো জায়গাও আর থাকল না।
মহিউদ্দিন খান মোহন :সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্নেষক