
ড. এম. মাসরুর রিয়াজ, চেয়ারম্যান, পলিসি এক্সচেঞ্জ
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অসামান্য উন্নয়নে রপ্তানির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সময়ক্রমে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী টেক্সটাইল ও তৈরি পোশাকের ভ্যালু চেইনে একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা করে নিয়েছে। ২০০১ সাল থেকে বার্ষিক গড়ে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রায় ১০ দশমিক ২৫ শতাংশ বেড়েছে। একটি সুবিশাল অভ্যন্তরীণ বাজার থাকার পাশাপাশি ২৮ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিশ্ববাণিজ্য বাজার বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের জন্য বিশাল সুযোগ।
ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং পরিবর্তনশীল চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ক্রেতা ও বাজারের ভিত্তি প্রসারে বাংলাদেশ কিছুটা সফলতা পেয়েছে। যদিও উচ্চমূল্য সংযোজিত পণ্যগুলোতে বৈচিত্র্য আনা এবং অন্যান্য বড় ও উদীয়মান বাজারে বিশেষত পূর্ব-এশীয় বাজারে প্রবেশ করা চ্যালেঞ্জিং। ক্রমবর্ধমান মজুরি, অটোমেশন, লজিস্টিকসের ওপর চাপ এবং উন্নত দেশগুলোর চাহিদার কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতার তীব্রতা ও ফাস্ট ফ্যাশনের বদলে উচ্চমানের এবং টেকসই পণ্যের চাহিদা বাংলাদেশের পোশাক খাতের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। ইউরোপে রপ্তানি প্রতিযোগিতায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে ভিয়েতনামের প্রেফারেন্সিয়াল ট্রেড এগ্রিমেন্টের (পিটিএ) অগ্রগতি এই চাপে নতুন মাত্রা যোগ করবে। কম ব্যয়ের মজুরি সুবিধা ক্রমে হ্রাস পাওয়া বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির পরবর্তী পর্যায়ে বাণিজ্য প্রতিযোগিতায় দ্রুত উন্নতি অত্যন্ত জরুরি। গ্লোবাল কম্পিটিটিভনেস ইনডেক্স ২০১৯-এ বাংলাদেশ ১০৫তম স্থানে রয়েছে, যা স্পষ্টভাবে লজিস্টিকস ও অবকাঠামো, উদ্ভাবন এবং ব্যবসায়িক গতিশীলতা উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরে। বিশ্বব্যাংকের লজিস্টিকস পারফরম্যান্স ইনডেক্সের মতে, এশিয়ার অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের সমকক্ষ হতে হলে বাংলাদেশকে তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। বাংলাদেশের ভিশন-২০৪১ অর্জনের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে এর সংযোগ বাড়াতে সুবিধাজনক বাণিজ্য অবকাঠামোর উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন প্রয়োজন।
একটি দেশের বন্দর ও লজিস্টিকস কর্মক্ষমতা পণ্য পরিবহনে স্থানীয়ভাবে এবং বিশ্বঅর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশ্বব্যাংকের মতে, বৈশ্বিক পণ্য বাণিজ্যের চার-পঞ্চমাংশের বেশি সমুদ্রপথে বহন করা হয় এবং মোট পরিমাণের প্রায় ৩৫ শতাংশ এবং বাণিজ্যিক মূল্যের ৬০ শতাংশের বেশি কনটেইনারে পাঠানো হয়। কনটেইনারভিত্তিক বাণিজ্যের ব্যবস্থাপনা বাণিজ্য এবং বৈশ্বিক সংযোগের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। একটি দেশের বন্দরের ভূমিকা শুধু কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্বজুড়ে উন্নত ও দক্ষ বন্দরগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লজিস্টিকস ইন্টিগ্রেটরে পরিণত হয়েছে। এর মাধ্যমে উন্নত লজিস্টিকস পরিষেবার সুযোগ সৃষ্টি হয়। মূল্য সংযোজিত লজিস্টিকস পরিষেবা আমদানি ও রপ্তানিতে ব্যয়, সময় ও জটিলতা কমায়। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে দক্ষ লজিস্টিকস সেবা দেওয়ার মাধ্যমে বন্দরগুলোর উন্নত বাণিজ্যিক সুবিধা এবং লজিস্টিকস পারফরম্যান্সের সক্ষমতা বাড়ানো যেতে পারে।
সড়কপথ, রেল ও বন্দরের মতো সহায়ক অবকাঠামোর গুণমান দ্বারা একটি দেশের লজিস্টিকস ক্ষমতা নির্ধারিত হয়। উন্নত আঞ্চলিক সংযোগ দেশের অভ্যন্তরীণ অঞ্চলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ এবং সহজে বন্দরে পৌঁছানোর সুযোগ একটি বন্দরের প্রতিযোগিতা সক্ষমতাকে আরও উন্নত করে।
যানজটপূর্ণ পরিবহন ব্যবস্থা ও দুর্বল লজিস্টিকস ইকোসিস্টেমের কারণে বাংলাদেশের এ বাবদ খরচের পরিমাণ বেশি। বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন খরচ বেশিরভাগ উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশের তুলনায় বেশি। সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা অনুসারে, মহাসড়কে ট্রাকের গড় গতি প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১৯ কিলোমিটার, যানজটহীন পরিস্থিতিতে যা হতে পারত দ্বিগুণেরও বেশি। যদি যানজটপূর্ণ অবস্থার সমাধান করা হয় তাহলে ক্ষেত্রভিত্তিক বিবেচনায় বাংলাদেশের লজিস্টিকস খরচ কমপক্ষে ৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ কমানোর সুযোগ রয়েছে। তবে এসব সমস্যার সঙ্গে এটাও স্পষ্ট- সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষ ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যে কার্গো চাপ মোকাবিলার চেষ্টা করছে। ২০২১ সালে চট্টগ্রাম বন্দর ৩ দশমিক ২ মিলিয়ন টিইইউ পরিচালনা করেছে, যা ২০২০ সালের তুলনায় ১৩ শতাংশ বেশি। তবে বন্দর পরিষেবার মান ও দক্ষতা এখনও চ্যালেঞ্জের মুখে।
বাংলাদেশের বাণিজ্য অবকাঠামো ও লজিস্টিকসের উন্নয়ন শুধু গার্মেন্ট ও টেক্সটাইলের বৈশ্বিক বাজারের অংশীদারিত্ব বাড়াতেই সক্ষম হবে না, বরং নতুন রপ্তানি বাজার ও পণ্যে বৈচিত্র্য আনবে। ইউএন-এসকাপের এক সমীক্ষায় অবকাঠামো উন্নয়ন ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য প্রায় ৩৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে অনুমান করা হয়েছে।
প্রতিযোগিতামূলক টার্নঅ্যারাউন্ড ও ক্লিয়ারেন্স সময়ের জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দ্বারা সমর্থিত বিশ্বমানের বন্দর, সড়ক যোগাযোগ, স্টোরেজ এবং পরিবহন সমন্বিত লজিস্টিকস ব্যবস্থা উন্নয়নের প্রয়োজন। বাণিজ্যে প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধির স্বার্থে বন্দরগুলোকে আরও উন্নত ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে দক্ষ ও শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তার প্রচেষ্টাস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কিছু সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন- মাতারবাড়ী বন্দর প্রকল্প এবং চট্টগ্রামের বে-টার্মিনাল প্রকল্প। প্রায় ৫ হাজার টিইইউর জাহাজ পরিচালনায় সক্ষম বে-টার্মিনালটি বাংলাদেশের জন্য যুগান্তকারী হবে। তবে এ জন্য প্রয়োজনীয় সড়ক, রেল, অভ্যন্তরীণ জলপথ এবং স্টোরেজ/গুদামজাতকরণ অবকাঠামোকে সারাদেশের বাণিজ্যিক কেন্দ্র ও অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। একটি দক্ষ ও টেকসই বন্দরভিত্তিক লজিস্টিকস ইকোসিস্টেম তৈরির জন্য সাপ্লাই চেইনের প্রতিটি উপাদানের যথাযথ ব্যবহার প্রয়োজন।
মন্তব্য করুন