- ফিচার
- বাণিজ্য প্রসারে চাই উন্নত লজিস্টিকস
বাণিজ্য প্রসারে চাই উন্নত লজিস্টিকস

দেশে ছোট-বড় নানা খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে। বাড়ছে আমদানি-রপ্তানি। ফলে প্রসারিত হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিধি। তবে অনেক দিন ধরেই এ ক্ষেত্রে বড় একটি সমস্যা দুর্বল লজিস্টিকস সুবিধা। এটি আমদানি-রপ্তানিকে শুধু বাধাগ্রস্তই করছে না; বাড়াচ্ছে উদ্যোক্তাদের অপ্রয়োজনীয় ব্যয়। এতে বিশ্ববাণিজ্যের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাচ্ছেন রপ্তানিকাকরা। অনেক ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়ছে পণ্যমূল্যেও।
দেশের লজিস্টিকস খাত আন্তর্জাতিক মান থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। বিশ্বের শীর্ষ লজিস্টিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাজিলিটি লজিস্টিকস সম্প্রতি উদীয়মান ৫০টি দেশের লজিস্টিকস নিয়ে সূচক তৈরি করেছে। এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৯তম। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কারও পেছনে রয়েছে বাংলাদেশ। দেশের আমদানি-রপ্তানির সিংহভাগই হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। কিন্তু কনটেইনার হ্যান্ডলিং বিবেচনায় দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাব, পোর্ট ইয়ার্ডের স্বল্পতা, পোর্ট শেড ও আধুনিক যন্ত্রপাতির অনুপস্থিতিসহ নানা কারণে এশিয়ার সমুদ্রবন্দরগুলোর মধ্যে এ বন্দরের অবস্থান পেছনের সারিতে।
অথচ সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, লজিস্টিকস খাত উন্নত করা গেলে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ২০ শতাংশ বাড়ানো যাবে। সেই সঙ্গে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ১৫ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক বিনিয়োগ আনা সম্ভব। এ জন্য এ বিষয়ে একটি জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশ্নেষকরা।
আমদানি-রপ্তানিসহ সার্বিক বাণিজ্য কার্যক্রম গতিশীলতার সঙ্গে চালাতে যে ধরনের অবকাঠামো, পরিবহন, ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রয়োজন, তার সবকিছুকে সামগ্রিকভাবে লজিস্টিকস খাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর পরিধি বিশাল। পণ্য পরিবহনে সড়ক, রেল ও জলপথ থেকে শুরু করে বন্দরের অবকাঠামো, পণ্য খালাস কার্যক্রম ও গুদামজাতকরণ, হিমাগার ও কনটেইনার সুবিধা এবং এসব কাজের ব্যবস্থাপনাসহ নানা বিষয় লজিস্টিকস সুবিধার আওতার মধ্যে পড়ে। কোনো পণ্য আমদানি, উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত সব ধরনের কর্মকাণ্ডেই প্রয়োজন হয় লজিস্টিকস সুবিধার।
গবেষকদের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে শুধু পরিবহন লজিস্টিকস সেবার বাজারই প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলারের। এটি জিডিপির ৬ দশমিক ৮ শতাংশের সমান। এক হাজার একশটির বেশি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের পণ্য পরিবহনে সহায়তাকারী হিসেবে যুক্ত। অন্যান্য সেবা মিলিয়ে পুরো লজিস্টিকস খাতের আকার আরও অনেক বড়। তবে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কবির আহমেদ সমকালকে বলেন, সমুদ্রবন্দরে প্রায়ই জাহাজের জট লেগে যাচ্ছে। এতে আমদানি ও রপ্তানি ব্যয় বাড়ছে। বিমানবন্দরেও পণ্য পরিবহনে প্রয়োজনীয় সংখ্যক যন্ত্রপাতি নেই। কার্গো ভিলেজ, কার্গো এলাকা, কার্গো নিরাপত্তায় সমস্যা রয়েছে।
লজিস্টিকস খাত নিয়ে ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের (আইইউবি) স্কুল অব বিজনেসের অধ্যাপক মামুন হাবিবের এক গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, রমজানে অতিরিক্ত পণ্য বহনের জন্য সাধারণ সময়ের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি ট্রাকের প্রয়োজন হয়। সড়কগুলো ট্রাকের এই বাড়তি চাপ নিতে পারে না। বেশিরভাগ সড়কে ট্রাকের জট থাকে দীর্ঘ। বন্দরেও দেখা যায় ২০ থেকে ৩০টি জাহাজ দিনের পর দিন পণ্য বহন ও খালাসের অপেক্ষায় পড়ে থাকে। ফলে পণ্য সরবরাহ চেইন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়। জটিলতা রয়েছে বিমানবন্দরেও। মাঝেমধ্যে স্ক্যানিং যন্ত্র বিকল হওয়া, কাস্টমস জটিলতা, পণ্য সংরক্ষণাগারের স্বল্পতাসহ নানা কারণে সেখানেও রপ্তানিমুখী পণ্যের জট সৃষ্টি হয়। আমদানি পণ্য সংরক্ষণাগারের সক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণ পণ্যের স্তূপ লেগে যায়। অন্যদিকে আইসিডি লাইসেন্স পেতেও নানা ভোগান্তিতে পড়তে হয় ব্যবসায়ীদের।
বেসরকারি ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোটস (আইসিডি) বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন এ খাতসংশ্নিষ্টরা। তাঁরা বলেন, বর্তমানে চট্টগ্রামে ১৯টি বেসরকারি আইসিডি রয়েছে। ৭৬ হাজার টিইইউএস কনটেইনারের সক্ষমতা রয়েছে। এটি আরও এক লাখ টিইইউএস বাড়ানো দরকার। এ খাতে বর্তমানে বেসরকারি বিনিয়োগ রয়েছে দুই হাজার কোটি টাকার মতো। রপ্তানি বাণিজ্য বাড়াতে আরও বিনিয়োগ দরকার।
ব্যবসায়ীদের মতে, লজিস্টিকস সংক্রান্ত নীতিমালা না থাকায় বিদেশি লজিস্টিকস অপারেটরদের বিনিয়োগ আনার ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার ওঠানামার ক্ষেত্রে পরিচালনা এবং রেগুলেটরি পদ্ধতি অনেক জটিল। কিছু নীতি আছে, যা বন্দরের দক্ষ ব্যবস্থাপনার জন্য সহায়ক নয়। বন্দর কার্যক্রমে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ সীমিত। চট্টগ্রাম বন্দরের গভীরতা দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় কম। দেশে লজিস্টিকস ব্যয়ও অনেক বেশি। রপ্তানি বাড়াতে লজিস্টিকস সূচকের উন্নতি জরুরি।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রাহমান সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের সার্বিক সক্ষমতার উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কার্যক্রমে পরিচালন ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে কমানো সম্ভব। এ ছাড়াও মহাপরিকল্পনার মাধ্যমে বে-টার্মিনাল ও পতেঙ্গা টার্মিনালের কার্যক্রম বাস্তবায়ন, ক্যাপিটাল ড্রেজিং, জেটির সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বন্দরের সঙ্গে সড়ক ও রেলপথের যোগাযোগ আরও উন্নত করা দরকার বলে মনে করেন তিনি।
শিল্পোদ্যোক্তাদের মতে, দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলে পুরোদমে উৎপাদন ও রপ্তানি শুরু হলে সড়ক, নৌ, রেল, আকাশপথে পণ্যের সরবরাহ বর্তমানের চেয়ে কয়েক গুণ বাড়বে। বিশাল এই কর্মযজ্ঞ সামাল দেওয়ার জন্য দরকার হবে দক্ষ লজিস্টিকস ব্যবস্থাপনা। বর্তমানে ৯টি মন্ত্রণালয় এবং ২১টি বিভাগ লজিস্টিকস-সংক্রান্ত বিভিন্ন কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করে। এতে জটিলতা বাড়ে। এসব কার্যক্রম ব্যবস্থাপনার জন্য একটি আলাদা মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তর দরকার। এ ছাড়া সড়কপথের ওপর অতিনির্ভরশীলতা কমাতে জল-যোগাযোগের দিকে বেশি নজর দিতে হবে। প্রাধান্য দিতে হবে রেলপথের ওপর। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যানজট কমাতে সড়কটিকে আট লেনে রূপান্তর করা দরকার।
অধ্যাপক মামুন হাবিব সমকালকে বলেন, দেশের লজিস্টিকস খাতে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। তবে অনেক চ্যালেঞ্জও আছে। বিশেষ করে ঢাকা বিমানবন্দর, চট্টগ্রাম বন্দর ও ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি)- এ তিনটি জায়গায় পণ্য পরিবহনে অবকাঠামো ও পরিবহন সমস্যা এবং পরিচালনায় দক্ষ জনশক্তির অভাব রয়েছে।
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লজিস্টিকস ও সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে পড়ানো হয় না। ফলে এ খাতে দক্ষ জনশক্তি তৈরি হচ্ছে না। আমদানি-রপ্তানি, লেনদেন ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে ডিজিটাল সুবিধাগুলো নিতে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। সে জন্য সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত ও নতুন উদ্যোগ প্রয়োজন।
মন্তব্য করুন