- ফিচার
- বই পড়ানোই যাঁর কাজ
বই পড়ানোই যাঁর কাজ

পাঠাগারে আতিফ আসাদ
জামালপুর শহর থেকে ভ্যানে রওনা হয়েছি। গন্তব্য সরিষাবাড়ী উপজেলার ডোয়াইল ইউনিয়নের হাসড়া মাজালিয়া গ্রাম। ভ্যান চলছে। গ্রামের পর গ্রাম পার হচ্ছি। পথ যেন শেষ হয় না। প্রত্যন্ত ওই গ্রামে আতিফ আসাদের বাস। ভাঙা ঘর। পাটকাঠি দিয়ে বারান্দায় বেড়া দেওয়া। সেখানে এই তরুণ গড়ে তুলেছেন 'মিলন স্মৃতি পাঠাগার'। দুপুর সাড়ে ১২টায় সেখানে পৌঁছাই। আতিফের মা সেলাই করছিলেন কাঁথা। নারীরা ধান শুকাচ্ছেন। সবাই বিস্ময়ভরে দেখলেন। আতিফের পাঠাগারে প্রবেশ করলাম। পাঠাগার বলতে বারান্দায় একটি শোকেস, আর কিছু বই। নেই কোনো আসবাব কিংবা বইয়ের বিশাল ভান্ডার। তবুও এটি পাঠাগার। পাটকাঠির বেড়ার সঙ্গে টানানো রয়েছে একটি ব্যানার, যাতে লেখা 'মিলন স্মৃতি পাঠাগার'।
বাবা, মা আর সাত ভাইবোনের পরিবার আতিফদের। সবার ছোট আতিফ। তাঁরা তিন ভাই ও চার বোন। চার বোনের বিয়ে হয়ে গেছে অনেক আগে। বাবা ৭০ বছরের বৃদ্ধ। মেজো ভাই গ্রামের পাশে আব্দুল্লাহ মোড়ে রড-সিমেন্টের দোকানে কাজ করেন। আতিফও লেখাপড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। আতিফ ২০১৯-২০ সেশনে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগে জামালপুর সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজে পড়ছেন। বাড়ি থেকেই সকালে সিএনজি অটোরিকশা আর দুপুরে ট্রেনে আসা-যাওয়া করেন। লেখাপড়ার খরচের জন্য এখনও মাঝে মাঝে রাজমিস্ত্রি, রডমিস্ত্রি, ধান কাটার কাজ করতে হয় তাঁকে। জমি বিরোধের জেরে আতিফের বড় ভাই মিলন নিহত হন। গ্রামের কালভার্টের মধ্যে তাঁর মরদেহ পাওয়া যায়। আতিফ বলেন, 'যেহেতু ভাই সব সময়ই দিকনির্দেশনা দিতেন, পাশে ছিলেন; ভাইয়ের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণার একটা শক্তি ভেতরে কাজ করত। তাই ভাইয়ের নামেই 'মিলন স্মৃতি পাঠাগার' দিয়ে বই পড়ানোর কাজ আবার শুরু করলাম। আমার ভাইকে এর মাঝে খুঁজে পাই।'
তিনি আরও বলেন, 'টাকার অভাবে ভালোভাবে স্কুলে যেতে পারিনি। বই, গাইড কিনতে পারিনি। ভালো কোনো শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়তে পারিনি। এসব কষ্ট ছোট থেকেই বিবেককে নাড়া দিত। ভাবতাম সমাজের জন্য শিক্ষার আলো দরকার। কারণ এখানে আমার মতোই প্রায় সবাই।'
অভাববোধ থেকেই বিবেকের তাড়না বাড়ে। জ্ঞানের আলোয় বিকশিত করার মানসিকতা তৈরি হয়। জ্ঞানের প্রতি তীব্র মোহ থেকেই বই পড়ার আন্দোলন শুরু করেন আতিফ। বই পড়ার বিকল্প নেই, বোধ তৈরি হয়। যে বোধে আসে অজস্র বাধা-বিপত্তি।
২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে মাত্র ২০টি বই দিয়ে শুরু হয়। প্রথমে নামকরণ পর্যন্ত হয়নি পাঠাগারের। ছিল না তেমন কোনো পরিকল্পনা। এ প্রসঙ্গে আতিফ বলেন, 'কোথাও ঘর ভাড়া নিয়ে পাঠাগার শুরু করার টাকাও আমার ছিল না। ভাবলাম যেহেতু শিক্ষা ও জ্ঞানের আলো ছড়ানোই আমার মূল কাজ, সেখানে অবকাঠামো কোনো বাধা হতে পারে না। তাই নিজের বাড়িতেই ঘরের বারান্দায় পাটকাঠি দিয়ে বেড়া দিয়ে পাঠাগার শুরু করি।
প্রথমে নিজের ঘর থেকেই শুরু করি। তারপর ঘরের বারান্দায়। বই সংরক্ষণ করার একটা ব্যাপার আছে। তাই বাবার সঙ্গে পরামর্শ করে ঘরে কিছু কাঠ ছিল, তা দিয়েই নড়বড়ে একটা বই রাখার তাক বা বুকশেলফ বানাই।' তিনি জানান, 'প্রায় ১০০ পাঠক আছে পাঠাগারের। সময়ভেদে কম বা অনেক বেশিও হয়। প্রথমে তো পাঠাগার কী বুঝতেনই না অনেকে। তখন এক লোকজন বলেছে, এত বই দিয়ে কী করবে? পাঠাগারে কি বই বিক্রি হয়? সবার ধারণাও ছিল না, পাঠাগারে বই বিক্রি নয়, বিনামূল্যে পড়া যায়। এই জিনিসগুলো বুঝিয়ে পাঠক তৈরি করা শুরুতে একটু সমস্যাই ছিল।'
সাড়ে চার বছরের ব্যবধানে ছয়টি গ্রামে পাঠাগার করেছেন- সরিষাবাড়ী উপজেলার হাসড়া, মাজালিয়া, দোলভিটি, গ্রাম নিখাই, রামানন্দপুর, হরখালী গ্রামে। তিনটি স্টেশন পাঠাগার- তারাকান্দি, সরিষাবাড়ী, মতিয়র রহমান রেলওয়ে স্টেশনে।
আতিফ বলেন, 'শুরুর দিকে বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে চেয়ে চেয়ে ২-৪টা করে বই নিয়ে বই বাড়ানো আর পাঠকদের নতুন বই দেওয়ার চেষ্টা করি। এরপর গ্যাসটন ব্যাটারিজ লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক কেএইচ মালেক স্যার পাঠাগারে ১০০টি বই দেন এবং ভিয়েতনামে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজ ম্যাডাম বই কেনার জন্য কিছু টাকা দেন। এতে পাঠাগার সমৃদ্ধ হয় এবং পাঠকরা ভালো বই পড়তে পারেন। ছাত্র, শিক্ষক, চাকরিজীবী, প্রবাসী সবার দেওয়া বই নিয়ে আজ আমার গড়া ১০টা পাঠাগারে প্রায় ৮ হাজার বই আছে।'
ভবিষ্যতে মিলন স্মৃতি পাঠাগারকে কীভাবে দেখতে চান- এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আমার ইচ্ছা যতগুলো গ্রামে আমার পাঠক ছড়িয়ে আছে, সব গ্রামেই একটি করে পাঠাগার করা। পাঠাগার আন্দোলনের যে ভিত, সেটা সরিষাবাড়ীর প্রতিটি গ্রামে ছড়িয়ে দিতে চাই। আকাঙ্ক্ষা সারাদেশে ১০০টি স্টেশন পাঠাগার চালু করার।' তিনি আরও বলেন, 'যতদিন বেঁচে থাকব অন্তত চেষ্টা করব নিজের উপজেলার শিল্প-সংস্কৃতিকে জাগাতে প্রত্যেক গ্রামে বই পড়া ছড়িয়ে দিতে। আস্তে আস্তে বই পড়ার গণ্ডি উপজেলা থেকে জেলা পর্যন্ত নিয়ে যেতে চাই।' া
মন্তব্য করুন