২০১৮ সালের ১ নভেম্বর 'দস্যুমুক্ত সুন্দরবন' ঘোষণা করা হয়। তবে এ কাজ সহজসরল পথে এগোয়নি। সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করতে অনেকের সঙ্গে অবদান রয়েছে মোহসীন-উল হাকিমের। সম্প্রতি সামাজিক অবদানের জন্য ইনক্যাপ র‌্যাঙ্কিংয়ে দক্ষিণ এশিয়ার সেরা দশজন সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সারের একজন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন তানভীর তানিম

'বনদস্যুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনাটা নিশ্চিতভাবেই এক বড় অর্জন। তবে এটা শুধু আমার একার কৃতিত্ব নয়। পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং আরও অনেকের সহযোগিতা ছিল বলেই তা সম্ভব হয়েছে। প্রথম যখন একটা দস্যুদল আত্মসমর্পণ করল, তখন এক অন্যরকম অনুভূতি কাজ করেছে। পরেরগুলোর ক্ষেত্রে বাড়তি কোনো অনুভূতি ছিল না। মনে হচ্ছিল, আমরা খুব সুন্দর এগোচ্ছি। একদিন গোটা সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হবে।

কিন্তু তা যখন সম্ভব হলো, তখন আমি খুব উল্লসিত ছিলাম না। আরেক চিন্তায় পড়ে গেলাম- এটা ধরে রাখাটা তো এক বড় চ্যালেঞ্জ। আমি একজন সাধারণ মানুষ। আমার তো কোনো ক্ষমতা নেই। আমার জায়গা থেকে আমি এটা ধরে রাখার জন্য ফলোআপ করে গিয়েছি। আমার কাছে মনে হয়েছে, এটা আমার দায়িত্ব।' কথাগুলো সেই মানুষটির, যাঁর মধ্যস্থতায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে সুন্দরবনের ৩৪টি দস্যুবাহিনী। বলছি, সাংবাদিক মোহসীন-উল হাকিমের কথা। সম্প্রতি তিনি ইনক্যাপ র‌্যাঙ্কিংয়ে দক্ষিণ এশিয়ার সেরা দশজন সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সারের একজন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন।

প্রায় দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে মোহসীন-উল হাকিম সাংবাদিকতায় যুক্ত। কর্মজীবনে একাধিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করেছেন। বর্তমানে বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর সাংবাদিকতার একটি বিশেষ দিক হলো, তিনি স্থানীয়দের ক্ষয়ক্ষতি ও সমস্যার কথা তুলে ধরেন এবং মিডিয়ার প্রচারে আনেন। তবে সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করার ক্ষেত্রে তাঁর উদ্যোগ ও অবদানের জন্যই মোহসীন-উল হাকিম সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসেন।

এর শুরুটা হয়েছিল ২০০৯ সালে। সেবার ঘূর্ণিঝড় আইলার প্রভাবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মোহসীন-উল হাকিম তখন সে অঞ্চলে যান সংবাদ সংগ্রহের কাজে। মানুষের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে নতুন একটি বিষয় আবিস্কার করেন। ঘূর্ণিঝড়ে সহায়-সম্বল হারানো মানুষগুলোর চোখেমুখে অন্য আরেকটি ভয়। যে ভয় ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ভয়ের চেয়েও বেশি কিছু; বনদস্যুর ভয়ে রীতিমতো তটস্থ থাকেন তাঁরা। বিষয়টি মোহসীন-উল হাকিমের মনে দাগ কাটে। এরপর যতবার ওই অঞ্চলে গেছেন, পেশাগত কাজের বাইরে সুন্দরবন ও এর বনদস্যুদের বিষয়ে খোঁজ নিয়েছেন।

দস্যুবাহিনী কর্তৃক যাঁরা আক্রান্ত হতেন, তাঁদের সবাই ছিলেন সুন্দরবনের নিকটবর্তী ও বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী অঞ্চলের গরিব জেলে, বাওয়ালি ও মৌয়াল। তাঁদের দৈন্য, দুর্দশা নিয়ে ভাবার মতো কেউ ছিল না। মোহসীন এর গুরুত্ব বুঝলেন। এ অঞ্চলে কাজ করার সুবাদে তাঁর সব সময়ই মনে হয়েছে, সুন্দরবনের এ দস্যুপ্রবৃত্তি ঠেকানো সম্ভব। তবে তার জন্য দস্যুদল ও সরকারের সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। এ যোগাযোগে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিজেও মনে মনে অনেককে খুঁজে ফিরেছেন।

কিন্তু পছন্দমতো কাউকে পাননি। অবশেষে নিজেই মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যান। মধ্যস্থতাকারী হওয়া সহজ ছিল না মোহসীনের জন্য। এর জন্য সবার আগে যা অর্জন করতে হয়েছে তা হলো, উভয় পক্ষের বিশ্বাস। সাংবাদিক হওয়ায় সরকার পক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসনের দিক থেকে সেই সমর্থন পাওয়া তুলনামূলক সহজ ছিল। কিন্তু বনদস্যুদের ক্ষেত্রে এটি ছিল ব্যতিক্রম। এর জন্য মোহসীনকে প্রথমত তাঁদের মানসিকতা বুঝে সেভাবে চলতে হয়েছে। মোহসীন বনদস্যুদের সঙ্গেই শুধু নয়, তাঁদের পরিবারের খোঁজখবরও নিতেন। এসব কাজের মাধ্যমে মোহসীন একটি বার্তা সবসময়ই দিতে চেষ্টা করেছেন- তোমাদের ক্ষতি করব না, আত্মসমর্পণে সর্বাত্মক সহযোগিতা করব।

প্রথম যে দস্যুবাহিনীর সঙ্গে মোহসীন-উল হাকিমের পরিচয় হয় সেটি মোতালেব বাহিনী। তাঁদের সঙ্গে দুই-তিন মাস কথা এগোনোর পর বন্দুকযুদ্ধে মোতালেব মারা যান, থেমে যায় প্রথম মধ্যস্থতা। এরপর দেখা হয় রাজু বাহিনীর সঙ্গে। খুলনার রূপসা ঘাট থেকে আট ঘণ্টা নদীপথ পেরিয়ে দেখা মেলে তাঁদের। চার দিন সেখানে থেকে তাঁদের সঙ্গে কথা বলে আত্মসমর্পণের পথ সুগম করেন।

মোহসীন-উল হাকিম বলেন, 'দস্যুবাহিনীর সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, তাঁরা ভালো নেই। আবার এটি ছিল ওয়ানওয়ে রোডের মতো, ওখানে গেলে ফেরার উপায় নেই। আমি তাঁদের আশ্বস্ত করি, আত্মসমর্পণ করার পর বাসায় থাক, জেলে থাক বা জামিনে থাক, ঘুমাতে অন্তত পারবে। এত টাকা কামানোর পরও সন্তানকে দেখতে পাও না, শান্তিতে ঘুমাতে পার না। তাঁরা তখন আমার কথায় আশ্বস্ত হতো।'

কাজের শুরুতে মোহসীন দেখতে পান, বনদস্যুদের খবর মূলধারার সংবাদমাধ্যমে সেভাবে আসে না। তখন নিজ জায়গা থেকে এ ব্যাপারগুলো নিয়ে তিনি রিপোর্ট করতে শুরু করেন। এ সময় এলাকাবাসীর সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বনদস্যুরাও ছিল তাঁর বিষয়ে ওয়াকিবহাল। সব মিলিয়ে তাঁদের সঙ্গেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যোগাযোগ শুরু হয়। ২০১১ সালে সর্বপ্রথম মোহসীন বনদস্যুদের আত্মসমর্পণের বিষয়ে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং প্রত্যাখ্যাত হন। এরপর ২০১৩ সালে দ্বিতীয়বার চেষ্টা করে আবারও ব্যর্থ হন। ২০১৫ সালে আবারও চেষ্টা করেন।

সেবার সরকার বনদস্যুদের আত্মসমর্পণের বিষয়ে একমত হয়। অবশেষে ২০১৬ সালে আসে সেই সুদিন। সে বছরের ৩১ মে মাস্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় অগ্রযাত্রা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের কাছে অস্ত্র জমা দেন তাঁরা। এরপর একে একে আত্মসমর্পণ করেন মজনু, ইলিয়াস, শান্ত, আলম, খোকাবাবু ও নোয়া বাহিনীর সদস্যরা। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর ছয়টি দস্যু বাহিনীর অস্ত্র জমার মধ্য দিয়ে আত্মসমর্পণ পর্ব শেষ হয়। এভাবে দীর্ঘ আড়াই বছরে ৩২৮ জন দস্যু আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর 'দস্যুমুক্ত সুন্দরবন'-এর ঘোষণা দেন।

মোহসীন-উল হাকিমের এ কাজ সহজসরল পথে এগোয়নি। বনদস্যুদের সঙ্গে দেখা করতে একটা নির্দিষ্ট সময়ে (বেশিরভাগ সময় গভীর রাতে) নির্দিষ্ট জায়গায় উপস্থিত হয়ে তাঁদের দেওয়া সিগন্যালের জন্য অপেক্ষা করতে হতো। সঠিক সময়ে পৌঁছাতে না পারলে বা সিগন্যাল খেয়াল না করলে ওই দিন আর দেখা হতো না। যেহেতু দস্যুদল মোহসীন-উল হাকিমকে দেখেই সিগন্যাল দিত, তাই এ সময় গলুইয়ের ওপর থাকতে হতো তাঁকে। দস্যুবাহিনী ও কোস্টগার্ডের মধ্যকার গোলাগুলির মধ্যেও তাঁকে পড়তে হয়েছে, রাত-বিরাতে সুন্দরবনের গহিনে বনদস্যুদের আস্তানায় যেতে হয়েছে, যেখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক দুষ্প্রাপ্য।

এ বিষয়টিকে মোহসীন-উল হাকিম সাংবাদিকতার অন্তর্গত বলে মনে করেন না; বরং সমাজের জন্য সবারই যার যার জায়গা থেকে দায়বদ্ধতা রয়েছে বলে মনে করেন। তিনি বলেন, 'সাংবাদিক হিসেবে আমি যখন পেশাগত কাজটা করছি, তাতেই আমার দায়িত্ব পালন হচ্ছে। তাঁর সঙ্গে আমি বনদস্যুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার কাজটা মেশাই না। সাংবাদিকতা করতে করতে আমি ওই কাজটা করেছি। সাংবাদিকতাকে ব্যবহার করে, অপব্যবহার না। একজন মানুষ হিসেবে মানুষের কথা ভাবতে চাই। সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হয়ে কথা বলব।

এ ক্ষেত্রে আমি হয়তো এখনও একাংশের কথা তুলে ধরি, সবারটা পারি না। মানুষের হয়তো প্রত্যাশা অনেক। আমি তো সেটা সেভাবে পূরণ করতে পারি না। সব সময় মনে হয়, এখনও আমার অনেক কাজ করা বাকি। কিন্তু আমি তো তাবত কাজ করতে পারব না। আমরা সমাজ থেকেই এসেছি। তাই চেষ্টা করি সমাজকে কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার, সমাজের জন্য কিছু করার। চেষ্টা থাকলেই দায়িত্বও পালন করা সম্ভব।'

আগের এই বনদস্যুরা এখন কেমন আছেন? মোহসীন-উল হাকিম বলেন, 'আমার সঙ্গে এখনও তাঁদের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। তাঁরা যে খুব স্বাচ্ছন্দ্যে আছেন, তা নয়। দস্যু থাকা অবস্থায় যে মামলাগুলো হয়েছিল, সেগুলো তাঁদের চালাতে হচ্ছে। এতে অনেক অর্থও ব্যয় হয়েছে। তবে এসব মামলা শিগগিরই তুলে নেওয়া হবে বলে জানতে পেরেছি। তবে স্বাচ্ছন্দ্য না থাকলেও প্রতিনিয়ত শঙ্কা-আতঙ্ক তো নেই। তাই এ নিয়ে তাঁদের মনে তেমন কোনো খেদও নেই।'

ইনক্যাপ র‌্যাঙ্কিংয়ে সোশ্যাল ইনফু্লয়েন্সারের স্বীকৃতি প্রসঙ্গে মোহসীন-উল হাকিম বলেন, 'সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষের সঙ্গে আমার যে যোগাযোগ বা আমার কাজটাকে যেভাবে তাঁরা গ্রহণ করেছে এবং একটা কাজ করলে মানুষ যে গ্রহণ করে, স্বীকৃতি দেয় তার প্রমাণ এটা।' তিনি আরও বলেন, 'আমি যে কাজটা করছি, দীর্ঘদিন ধরে লেগে থেকে একটা পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছি এবং একটা পরিবর্তন সেখানে এসেছে- সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হয়েছে, এর একটা স্বীকৃতি ইনক্যাপের এই র‌্যাঙ্কিং।' া

বিষয় : দস্যুমুক্ত সুন্দরবন

মন্তব্য করুন