- ফিচার
- জয়ী হওয়ার মানসিকতাটাই মূল কথা
জয়ী হওয়ার মানসিকতাটাই মূল কথা

রেফারি, কোচ ও প্রাক্তন ফুটবলার জয়া চাকমা। ছবি- সংগৃহীত।
আমি তখন ক্লাস অষ্টম পড়ি। ওই সময় রাঙামাটিতে ফুটবল টুর্নামেন্ট হয়। টুর্নামেন্ট থেকে দল বাছাইয়ের আয়োজন করে। যেখানে আমি টিকে যাই। তার আগে থেকেই স্কুলে দৌড়াদৌড়ি করতাম। হ্যান্ডবল, টেনিসবল, ব্যাডমিন্টন খেলতাম। ক্লাস ফোরে যখন পড়ি, তখন শিশু একাডেমির খেলা দিয়ে যার শুরু।
যেহেতু বেড়ে ওঠা পাহাড়ি অঞ্চলে, সেহেতু আমাদের নানা দৌড়ঝাঁপের মধ্যে থাকতে হতো। প্রথম যখন ফুটবল খেলতাম, তখন সেভাবে আগ্রহ ছিল না। কারণ আমি অন্যান্য খেলা আরও ভালো খেলতাম। আগ্রহ বাড়ে ২০০৫ সালে। তখন আন্তঃজেলা মহিলা ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থার আয়োজনে। ওই সময় আমরা অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম রাঙামাটিতে।
এটা খুব সম্ভবত ২০০৫-২০০৬ সালের কথা। আমি ম্যান অব দ্য ম্যাচ হই। প্রথম আন্তঃজেলা মহিলা ফুটবলের টুর্নামেন্ট ছিল। সুলতানা কামাল ক্রীড়া কমপ্লেক্সে আয়োজন করা হয়েছিল। সে সময় সাহস বাড়ল। ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা জন্মাল। ১১ জনের ক্যাম্পে বাছাই হলাম। ওই ক্যাম্প থেকেই সিনিয়র জাতীয় দলে চান্স পাই। এরপর থেকে জাতীয় দলে নিয়মিত খেলেছি।

খেলোয়াড় জীবন শেষে ২০১৬ সাল থেকে বিকেএসপিতে কোচ হিসেবে আছি। আমাদের লক্ষ্যই খেলোয়াড় তৈরি করা। এ জন্য সরকারও বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে। আমরা একনিষ্ঠভাবে সেই লক্ষ্য-উদ্দেশ্যেই কাজ করে যাচ্ছি।
এবার সাফজয়ীদের মধ্যে আঁখি খাতুন, ছোট স্বপ্না, ঋতুপর্ণাসহ পাঁচজনই বিকেএসপির খেলোয়াড়। আঁখি ছাড়া সরাসরি অন্যদের কোচ ছিলাম। জুনিয়রদের তৈরি করছি। এ জন্য মেধা-শ্রম দুটোই একসঙ্গেই লাগে। তার চেয়েও বেশি লাগে আগ্রহ। সাফজয়ের পরে অনেক মা-বাবার ভেতর আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। এটা আমাদের অনেক বড় পরিবর্তন নিয়ে আসবে। কিছুদিন আগেও মেয়েদের ফুটবল খেলা নিয়ে ওভাবে বলা যেত না। অনেক ক্ষেত্রে তুচ্ছতাচ্ছিল্য হতো। মেয়েরা আবার কী ফুটবল খেলবে! অনেকের ধারণা, মেয়েরা তো লেফট-রাইটই করতে পারে, এদের দিয়ে দৌড় দেওয়ানো, ফুটবলের পেছনে ছোটা তো অসম্ভব! এ খেলার জন্য জয়টা দরকার ছিল।
নারীদের ফুটবল খেলা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে প্রায় ১৩-১৪ বছর আগে। এতগুলো বছর লেগেছে এ জয় পেতে। এতদিন পর্যন্ত ওভাবে কিন্তু আমাদের সম্পর্কে কেউ জানত না। এই জানান দেওয়াটা দরকার ছিল। এই খেলার মধ্য দিয়ে যে মেয়েদের মধ্যে ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠেছে, এটিও জানান দেওয়া জরুরি। মেয়েদের ফুটবলের জন্য, দেশের জন্যও তা দরকার ছিল।
এখন অনেক মেয়েই ফুটবলার হবেন। মা-বাবাও চাইবেন পড়াশোনার পাশাপাশি মেয়েরা খেলুক। আগে তাঁরা ইনডোর গেমে অনুমতি দিতেন, এখন আউটডোর গেমেও তাঁরা স্বাচ্ছন্দ্যে খেলবেন। যে সম্মান-ভালোবাসা নারী ফুটবলারদের দেওয়া হয়েছে, তা-ই তো মানুষ চান। মানুষ তো দিনশেষে একটা সম্মানজনক পরিচয় চান।
আগে তো ফুটবল খেলোয়াড়দের ভাবতে হতো, পরবর্তী জীবন কীভাবে কাটবে। কিন্তু এখন কোচ বাড়বে, রেফারি বাড়বে, ক্যাম্প বাড়বে, খেলোয়াড়ও বাড়বে। অনিশ্চয়তা কমবে। অনেক প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের আমরা পরবর্তী সময়ে আর দেখছি না; কিন্তু এখন আর সে সম্ভাবনা নেই। ঘরোয়া লিগ, ক্লাব ফুটবল বাড়বে; অংশগ্রহণের জায়গাও বাড়বে। এটা অনেক বড় ক্ষেত্র হয়ে উঠবে। এ জয়টা ভীষণ দরকার ছিল।
এখন তো ন্যাশনাল টিমে খেলেন ১১ জন। আর বিভিন্ন টিমে রয়েছেন ৫০ থেকে ৬০ জন। তাঁদের বাইরেও সারাদেশে খেলাটা ছড়িয়ে গেছে। প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ফুটবল খেলায় উদ্বুদ্ধ করা হয়। তাঁরা যেমনই খেলুক। তারা মাঠে যায়। দৌড়ায়। সারাদেশ থেকেই হয়তো খেলোয়াড় বাড়বে; ন্যাশনাল টিমে কিন্তু ১১ জনই থাকবে। ওই চূড়ান্ত জায়গায় তাঁরাই পৌঁছাবেন যাঁদের কিছু এক্সট্রা অর্ডিনারি থাকবে। ফুটবলের ফিজিক্যাল, টেকনিক্যাল জ্ঞান থাকবে। নিয়মানুবর্তিতা থাকতে হবে। তা না হলে ছিটকে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মেন্টাল শার্পনেস থাকতে হবে। হার্ডওয়ার্কের ওপর কোনো কথাই নেই। তা না হলে পরবর্তী সময়ে টিকে থাকা সম্ভব হবে না। এগুলোর সমন্বয় না ঘটালে একসময় হেরে যেতে হবে সময়ের কাছে।

এখন তো খেলোয়াড়রা অনেক সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। মেয়েদের জন্য অনেক ইউনিভার্সিটি আছে, যেগুলোতে খেলোয়াড় কোটায় তারা পড়তে পারছেন। স্কলারশিপ দিচ্ছে। এখন কিন্তু অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। এখন শিক্ষিত কোচ, রেফারি লাগে। এখন কম্পিটিশনটা সেই পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
ফুটবল তো একটা শিল্প। সে শিল্পের বিষয়টিতে মনোযোগ দিতে হবে। কিছু বিষয় তো নিজে থেকে করতে হবে, যা অন্য কেউ করিয়ে দিতে পারবে না। ঋতুপর্ণার কথাই ধরা যাক। ওর ভেতরে কোঅর্ডিনেশন অ্যাবিলিটি, খেলার যে স্টাইল- এটা শুরু থেকেই আকর্ষণীয়। ঋতুকে আমি যখন দেখেছি, তখন সে একেবারেই ছোট। খেলায় দৌড়ানো, স্কিল এসবের চেয়ে বেশি হলো সে আসলে উইনিং মেন্টালিটি রাখে কিনা। যে কোনো বাচ্চার ভেতরে যদি জয়ের ক্ষুধা না থাকে, তাকে যতই টেকনিক্যাল, ফিজিক্যাল ট্রেনিং করানো হোক না কেন, পারফরম্যান্স দেওয়া কষ্ট। এটি যে কোনো মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
ঋতুপর্ণার ভেতর এক্সেপশনাল একটা বিষয় ছিল। ২০১৬ থেকেই ঋতু বিকেএসপিতে। প্রথম ব্যাচ। তখন স্যাররা ওকে নিয়েছিল কিছু ইন্টেলেকচুয়াল বিষয়ের কারণে। যারা ন্যাশনাল টিমে আছে, প্রত্যেকেই আসলে উইনিং মেন্টালিটি নিয়ে এসেছে। যদি না থাকত তাহলে ওই জায়গায় টিকে থাকা খুব কষ্টকর। ওদের যে ট্রেনিং শিডিউল, ডিসিপ্লিন, এত কম্পিটিশন- সবাই ফুটবলে লাথি মারতে পারে, হয়তো ভালো খেলতেও পারে; কিন্তু উইনিং মেন্টালিটি বা জয়ী হওয়ার মানসিকতাটা সবার থাকে না। ওরাই কেন ১১ জন, ওরাই কেন ২৩ জন টিমে আছে। কারণ ওই জয়ী হওয়ার মানসিকতা। এটাই পার্থক্য গড়ে দেয়।
লেখক: রেফারি, কোচ ও প্রাক্তন ফুটবলার।
মন্তব্য করুন