মিতু (ছদ্মনাম), একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত আছেন। তাঁর স্বামী রাজীব সরকারি চাকরিজীবী। রাজীবের বাবা তাঁদের সঙ্গেই থাকেন। মিতু প্রতিদিন ভোর ৬টায় উঠে বাসার সবার জন্য নাশতা তৈরি করেন। নিজের এবং রাজীবের দুপুরের খাবার তৈরি করে শ্বশুরের খাবার ও ওষুধ গুছিয়ে দেন। মিতুর অফিস ছুটি হয় সন্ধ্যা ৬টায়। বেসরকারি ব্যাংক হওয়ায় ৭টাও বাজে। অফিস বাসা থেকে ১ ঘণ্টার পথ। মাঝে মধ্যে ট্রাফিকের কারণে দেড় ঘণ্টাও সময় লাগে। অফিস থেকে বাসায় ফিরে মিতু ফ্রেশ হয়ে আবার চলে যান সংসারের কাজ করতে। ঘর গোছানো, সবার জন্য নাশতা তৈরি, রাতের রান্না, পরের দিন অফিসের খাবার তৈরি করা- সব মিলিয়ে দম ফেলার সময় থাকে না মিতুর। রাজীব মাঝে মধ্যে অভিযোগ করেন মিতুকে, সে আর আগের মতো সময় দেয় না।

ময়না (ছদ্মনাম) মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। মা-বাবার পছন্দে বিয়ে করেছিলেন সাব্বিরকে। তাঁদের ছয় বছরের মেয়ে আছে একটি। সাব্বিরের মা-বাবা আর ভাই আছেন। ময়না পুরোদস্তুর গৃহিণী। সকাল ৬টা থেকে শুরু হয় তাঁর ঘরের কাজ করা। ঘর পরিস্কার, নাশতা তৈরি এরপর সাব্বিরের অফিসের দুপুরে খাবার দেওয়া। মেয়েকে স্কুলের জন্য প্রস্তুত করা। কাজের লোক এসে কাপড় পরিস্কার করেন এবং ঘর মুছে যান। এরপর দুপুরের রান্নার প্রস্তুতি নেওয়া। সাব্বিরদের বাসায় রান্না হয় দুই ধরনের। শ্বশুর খান কম তেলে মসলা ছাড়া রান্না। বাকিদের জন্য অন্য ধরনের রান্না। দুপুরের খাবারের পর আবার সব পরিস্কার করা। ময়নার নিজের দুপুরের খাবার খেতে বেজে যায় ৪টা। সন্ধ্যা ৬টায় আবার সবার জন্য নাশতা তৈরি। সাব্বির যখন অফিস থেকে ফেরেন তখন তাঁকে সময় দেওয়া, আবার রাতের খাবারের প্রস্তুতি। এই হলো ময়নার নিত্যদিনের গল্প। সকাল ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত কাজ করে চলেন।

যে কোনো শিশুকেও যদি জিজ্ঞেস করা হয় তোমার বাবা কী করেন? সে হয়তো বলবে, কৃষিকাজ করেন, ব্যবসা বা চাকরি করেন ইত্যাদি। কিন্তু যদি জিজ্ঞেস করা হয়, তোমার মা কী করেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উত্তর হবে- কিছু করে না, ঘরের কাজ করেন। শিশুরা এটা শিখেছে আর বড়রা এসব শিখিয়েছেন যুগ যুগ ধরে। এখন প্রশ্ন হলো- এই যে গৃহস্থালি কাজগুলো আমাদের কাছে দৃশ্যমান হয় না। সেটি কেন? এর পেছনে অন্যতম একটি কারণ- এই কাজগুলো করে কোনো টাকা উপার্জন হয় না। এ জন্য এই কাজগুলোর স্বীকৃতি নেই। তাই এখন প্রশ্ন উঠছে এবং উত্তর খোঁজা হচ্ছে, নারীরা ঘরে যে কাজ করেন তা কি জাতীয় অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে না? যদি জাতীয় উৎপাদনে এর প্রভাব থাকে, তবে গৃহস্থালি কাজের স্বীকৃতি নেই কেন? এর আর্থিক মূল্য কি নির্ধারণ করা সম্ভব নয়?

বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, মজুরিবিহীন কাজে পুরুষের চেয়ে নারীর অংশগ্রহণ দিনে ৬ দশমিক ৪৬ ঘণ্টা বেশি। ২০১২ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর টাইম ইউজড সার্ভে রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ১৫ বছরের বেশি কর্মজীবীদের মধ্যে ঘরের বিভিন্ন কাজে পুরুষ দৈনিক ১ দশমিক ৪ ঘণ্টা এবং নারী ব্যয় করেন ৩ দশমিক ৬ ঘণ্টা। কর্মজীবী না হলে গড়ে নারীরা দিনে ৬ দশমিক ২ ঘণ্টা এবং পুরুষ ১ দশমিক ২ ঘণ্টা এ ধরনের কাজে ব্যয় করেন। এর পরের রিপোর্ট প্রকাশিত হলেও নিশ্চয়ই এর খুব একটা তারতম্য হবে না।

অবৈতনিক কাজের মূল্যের একটা ছায়া হিসাব করেছিল গবেষণা সংস্থা সানেম। তাদের তথ্য অনুযায়ী, যদি গৃহস্থালি কাজের আর্থিক মূল্য হিসাব করা যায় তাহলে তা দাঁড়াবে নারীর ক্ষেত্রে জিডিপির ৩৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ এবং পুরুষের ক্ষেত্রে ৯ শতাংশ। সানেমের পক্ষ থেকে বলা হয়, নারী কর্মসংস্থানে এক শতাংশ বৃদ্ধি কার্যকরভাবে সামগ্রিক অর্থনৈতিক বৃদ্ধি করতে পারে শূন্য দশমিক ৩১ শতাংশ। ২০২১ সালের জিডিপির তথ্য বিবেচনা করলে কেবল ১০ শতাংশ নারীর কর্মসংস্থান বৃদ্ধি দেশের অর্থনীতিতে যোগ করতে পারত বাড়তি ১ হাজার ১৩০ কোটি ডলার (৯৬ হাজার ৫০ কোটি টাকার বেশি)। সিপিডির গবেষণায় দেখা গেছে, নারীর কাজের ৭৮ থেকে ৮৭ শতাংশই অর্থনৈতিক হিসাবে আসে না। যেমন- কাপড় ধোয়া, রান্না করা, ঘর পরিস্কার করা ইত্যাদি। এত গেল আর্থিক হিসাব, এবার আসি আরেকটি প্রশ্নে। এই গৃহস্থালি কাজগুলো নারীকেই করতে হবে- এটি কি সহজাত বা প্রকৃতিপ্রদত্ত কোনো নিয়ম? না, এটি আমাদের সমাজের নিয়ম। প্রকৃতপক্ষে নারীর কাজ বা পুরুষের কাজ বলে কিছু নেই। যে কোনো কাজ যে কেউ করতে পারে। গৃহস্থালি কাজগুলোতে টাকার মূল্যায়ন থাকে না। অথচ এ কাজগুলো অত্যাবশ্যকীয়। পরিবারের এ কাজগুলো একত্রে করা হলে সময় যেমন কম লাগে, তেমনি এ কাজ করতে পরিবারের সদস্যের মধ্যে সহমর্মিতা বাড়ে। 
লেখক :উন্নয়নকর্মী