- ফিচার
- স্নাতক থিসিসে জারীনের অর্জন
গ্লোবাল আন্ডারগ্র্যাজুয়েট অ্যাওয়ার্ডস-২০২২
স্নাতক থিসিসে জারীনের অর্জন

জারীন তাসনীম শরীফ ছবি : অনলাইন
জারীন তাসনীম শরীফ। বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী তাঁর স্নাতক থিসিসের জন্য অর্জন করেছেন জুনিয়র নোবেল প্রাইসখ্যাত গ্লোবাল আন্ডারগ্র্যাজুয়েট অ্যাওয়ার্ডস-২০২২। স্থাপত্য, প্রত্নতত্ত্ব, দর্শন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, প্রকৌশলসহ মোট ২৫ ক্যাটাগরিতে এবার বিশ্বের ৭৩ দেশ থেকে দুই হাজার ৮১২টি থিসিস জমা পড়ে। এর মধ্যে আর্কিটেকচার ও ডিজাইন বিভাগে সেরা হয়েছেন জারীন তাসনীম শরীফ। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন রাফসান রোহান
'ওয়েস্ট ইন দ্য সিটি :অ্যাগ্লোমেরেটিং লোকাল ইকোনমি অব মাতুয়াইল ল্যান্ডফিল' শিরোনামে স্নাতক থিসিসের জন্য আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনভিত্তিক 'গ্লোবাল আন্ডারগ্র্যাজুয়েট অ্যাওয়ার্ডস' জিতেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জারীন। গ্লোবাল আন্ডারগ্র্যাজুয়েট অ্যাওয়ার্ডস বিশ্বের মর্যাদাপূর্ণ একাডেমিক পুরস্কারগুলোর মধ্যে একটি। এর পৃষ্ঠপোষক আয়ারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট মাইকেল ডি হিগিন্স। অনলাইনে জমা দেওয়া শিক্ষার্থীদের থিসিসগুলো মূল্যায়ন করে পেশাদার শিক্ষাবিদের একটি দল। জমাকৃত আবেদন থেকে প্রতি ক্যাটাগরিতে হাইলি কমেন্ডেড এনট্রান্স, রিজিওনাল উইনার ও গ্লোবাল উইনার- এই তিন পর্যায়ে পুরস্কার দেওয়া হয়। এ কর্মসূচি চলে আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া, ইউরোপ, আয়ারল্যান্ড, লাতিন আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায়। এ বছর আর্কিটেকচার ও ডিজাইন বিভাগে সেরা হয়েছেন জারীন। তাঁর আগে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা 'হাইলি কমেন্ডেড এনট্রান্স' এবং 'রিজিওনাল উইনার' হয়েছিলেন।
যাচ্ছেন ডাবলিনে
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল থেকে এসএসসি এবং হলি ক্রস কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ২০১৫ সালে বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন জারীন তাসনীম শরীফ। স্নাতকে তাঁর থিসিসের সুপারভাইজার ছিলেন নাসরিন হোসেন, প্যাট্রিক ডি রোজারিও ও অপূর্ব কুমার পোদ্দার। থিসিসটি মূলত মাতুয়াইলের ল্যান্ডফিল নিয়ে। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি শেষের থিসিস বা অভিসন্দর্ভ। 'জুনিয়র নোবেল প্রাইস'খ্যাত পুরস্কার হিসেবে স্বর্ণপদকের পাশাপাশি আয়োজকদের অর্থায়নে আগামী ৬ থেকে ৯ নভেম্বর ডাবলিনে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া দ্য গ্লোবাল আন্ডারগ্র্যাজুয়েট সামিটে অংশ নেবেন জারীন। দ্য গ্লোবাল আন্ডারগ্র্যাজুয়েট কর্তৃপক্ষের ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হবে তাঁর থিসিসটি।
ল্যান্ডফিল বা আবর্জনাভূমির জন্য মায়া
জারীন ল্যান্ডফিল কিংবা আবর্জনাভূমির প্রথম ধারণা পান পঞ্চম বর্ষের প্রথম সেমিস্টারে। আবর্জনা ব্যবস্থাপনা বা পরিশোধনের সবচেয়ে পুরোনো ব্যবস্থা এটি। এতে ময়লা বা আবর্জনাকে কোনো নির্দিষ্ট স্থানে ফেলে মাটিচাপা দেওয়া হয়। ঐতিহাসিকভাবে আবর্জনাভূমি সুশৃঙ্খলভাবে বর্জ্য নিস্কাশনের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ব্যবস্থা। তৎকালীন বুয়েট থেকে ডিজাইনিং রেসিলিয়েন্স ইন এশিয়া শীর্ষক একটি আন্তর্জাতিক সিম্পোজিয়ামেও অংশ নিয়েছিলেন জারীন। তাঁদের প্রজেক্টটা ছিল চেন্নাই শহর নিয়ে। সেখানকার একটি ল্যান্ডফিল নিয়ে কাজ করেছেন তাঁরা। এরপর ধীরে ধীরে ল্যান্ডফিল নিয়ে আরও কাজের আগ্রহ জন্মায় তাঁর। ঢাকার মাতুয়াইল এবং আমিনবাজার ল্যান্ডফিল ঘুরে তিনি বুঝতে পারেন, একজন স্থপতি হিসেবে এই জনপদে মানুষের জন্য অনেক কিছু করার আছে তাঁর। এ জন্যই স্নাতকের চূড়ান্ত থিসিসের প্রকল্প হিসেবে মাতুয়াইলকে বেছে নেন জারীন।
নেতিবাচক ধারণার পরিবর্তন
বর্জ্যের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি সবসময়ই নেতিবাচক। জারীন চেষ্টা করেছেন বর্জ্য নিয়ে মানুষের ধ্যানধারণা পাল্টাতে। বর্জ্যকে ফেলনা কিছু হিসেবে না দেখে বরং বর্জ্য থেকে কীভাবে একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ কমিউনিটি তৈরি করা যায় তা দেখিয়েছেন। কীভাবে এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন এনে দেশের সম্পদে পরিণত করা যায়, সেটিই তুলে ধরেছেন তিনি তাঁর থিসিসে। শুধু তাই না, বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়াতে পরিবেশ দূষণের মুখ্য ভূমিকা রুখতেও সক্ষম হবে।
ঢাকার বর্জ্য মাতুয়াইলে
প্রায় তিন দশক ধরে ঢাকার বর্জ্য মাতুয়াইলে ডাম্প করা হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মাতুয়াইল ল্যান্ডফিল বর্জ্যের ভেতরে সীমাবদ্ধ রাখা যায়নি। এটি কৃষিজমি, জল এবং বায়ুকে দূষিত করছে। এখানকার বিত্তশালীরা অন্যত্র চলে গেছেন। বছরের পর বছর মাতুয়াইল বর্জ্যভিত্তিক পুনর্ব্যবহারযোগ্য শিল্পের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে। মানুষের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে ল্যান্ডফিলের বর্জ্যকে রিসাইকেল করার একটি সিস্টেম যদি দাঁড় করানো সম্ভব হয়, তবেই পরিবেশ রক্ষা পাবে। এমনটাই ধারণা করছেন জারীন। এখানকার কৃষি ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা যাবে প্রকল্পটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হলে। থিসিসে এই সিস্টেমটিই ডিজাইন করেন তিনি।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা
মাতুয়াইল ল্যান্ডফিলের বাসিন্দারা ছিলেন কৃষক। তাঁরা ক্ষেতে চাষ করতেন এবং আশপাশের জলাশয় থেকে মাছ ধরতেন। মাতুয়াইল স্থলভাগে পরিণত হলে তাঁদের অনেকেই এলাকা ছেড়ে চলে যান। যাঁরা ছেড়ে যেতে পারেননি তাঁদের কেউ বর্জ্য সংগ্রহকারী হয়ে ওঠেন, কেউ খুলে বসেন ছোট ছোট রিসাইক্লিং মিল। দুর্ভাগ্যবশত, তাঁরা সমাজ থেকে বহিস্কৃত হয়ে যান। আশপাশের মানুষ সারাদিন বর্জ্য নিয়ে পড়ে থাকা মানুষদের আপন করে নিতে চান না। এই মানুষদের মুক্তি, মাতুয়াইল অঞ্চলের আশপাশের জলাশয় উদ্ধার, ল্যান্ডফিলে ঢোকার রাস্তা তৈরি এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য প্রকল্পের স্বপ্ন দেখেন। এখানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শুরু হলে ঘণ্টায় ১৫০ টন এবং প্রতিদিন এক হাজার টন শোধন বা পুনর্ব্যবহার করার সক্ষমতা তৈরি হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে নিশ্চিত করতে হবে যে মোট বর্জ্যের কমপক্ষে ৪০ ভাগ শোধন বা পুনর্ব্যবহার করা হচ্ছে এবং এই অঞ্চলে একটি সহায়ক পুনর্ব্যবহার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রকল্পটিতে। প্রকল্পের চূড়ান্ত পর্যায়, যা ২০৪৩ সালের মধ্যে সম্পন্ন করা প্রয়োজন।
বর্তমান ব্যস্ততা ও আগামীর স্বপ্ন
বর্তমানে আমিনবাজার ল্যান্ডফিল নিয়ে গবেষণা করছেন জারীন। আগামীতেও ল্যান্ডফিলকেন্দ্রিক সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে কাজ করতে চান তিনি। সেই সঙ্গে জারীন বিশ্বাস করেন, সময়মতো ঠিকই তাঁর স্বপ্নের প্রকল্প বাস্তবায়নের মুখ দেখবে। সেই বিশ্বাস আমাদেরও!
মন্তব্য করুন