হারমান মেলভিলের কালজয়ী গ্রন্থ
মবি-ডিকের ১৭০ বছর

এনামুল রেজা
প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০
এনসাইক্লোপিডিক উপন্যাস বলে একটা বিষয় আছে পশ্চিমা সাহিত্যে। অর্থাৎ উপন্যাস, কিন্তু বিষয়বস্তুর আলাপে বিশ্বকোষের সঙ্গে তুলনীয়। এ ধরনের উপন্যাসে কোনো একটা বিষয় নিয়ে মানবজাতির যা অর্জিত জ্ঞান, তার প্রায় সবটাই তুলে আনার চেষ্টা করা হয়। মার্কিন ঔপন্যাসিক টমাস পিঞ্চনের গ্র্যাভিটিস রেইনবো নিয়ে এক লেখায় (১৯৭৬) সাহিত্যতাত্ত্বিক এডওয়ার্ড মেন্ডেলসন এই টার্ম প্রথম ব্যবহার করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে জার্মান মিলিটারির ব্যবহূত ভি-২ রকেট নিয়ে এ উপন্যাসের আলাপ এবং তা যন্ত্রণাদায়কভাবে ক্ষিপ্র। বইটা পড়লে মোটামুটি ভি-২ রকেটের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ হয়ে যাবেন পাঠক।
কিন্তু জেমস জয়েসের ইউলিসিস বা পিঞ্চনের গ্র্যাভিটি নয়, বিশ্বকোষসম প্রথম পশ্চিমা উপন্যাসটা আসলে মবি-ডিক। হারমান মেলভিলের এ উপন্যাস প্রথম প্রকাশিত হয় আজ থেকে ঠিক ১৭০ বছর আগে (১৮৫১)। এই বইয়ের পাগলামো আজ এতকাল পরেও পাঠকের কাছে বিস্ময়ই থেকে গেছে। মহান আমেরিকান উপন্যাসের যে ধারা স্কারলেট লেটার বা লাস্ট অব দ্য মোহিকানস থেকে শুরু হয়েছিল, মবি-ডিক সেই ধারাকে নিয়ে গিয়েছিল নতুন উচ্চতায়।
কী নিয়ে আসলে আলাপ করে মবি-ডিক? ওই যুগে আমেরিকার তিমি শিকার নিয়ে হেন তথ্য নেই, যা মবি-ডিকে উঠে আসেনি; বিশেষ করে তিমি ধরার কৌশল, এদের বেড়ে ওঠা, পরিবার গঠনের নিয়ম, তাত্ত্বিক আলোচনার পাশাপাশি তিমি শিকারের চমকপ্রদ বর্ণনা।
উপন্যাসের যে কথক, ইশমায়েল, তার চোখ দিয়ে যেন এক নতুন পৃথিবীর দিকে আমাদের তাকাতে বলেন মেলভিল। একটা জাহাজে বিভিন্ন রকমের নাবিক কাজ করে। এদের আচরণ ও কাজকর্মের নিখুঁত বিবরণে উঠে আসে ওই সময়ের সামাজিক শ্রেণিবিভাগ, শ্রেণিবৈষম্য, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং সংঘর্ষও।
সবকিছু ছাপিয়ে তিমির হাড়ে তৈরি নিজের একটা নকল পায়ে ভর করে দাঁড়িয়ে থাকা ক্যাপ্টেন আহাবকেই আমার বারবার মনে পড়ে। মবি-ডিক নামের এক দানবীয় শ্বেতবর্ণ স্পার্মতিমির সঙ্গে যার অনন্ত বোঝাপড়া বাকি আছে। আছে এক পুরোনো শত্রুতা। বহুদিন আগে এক সমুদ্র অভিযানে এই কিংবদন্তির তিমি তার জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছিল আর আহাব হারিয়েছিল নিজের একটা পা।
তাই আহাবের ধ্যান-জ্ঞান আরেকবার মবি-ডিকের মুখোমুখি হয়ে তাকে পরাজিত করা। সেই প্রায় অলৌকিক বিকটাকৃতির তিমি যেন আহাবের একটা পা খায়নি শুধু, সে আহত করেছে মানুষ হিসেবে আহাবের অহমকেও।
আমার মনে হয়, প্রকৃতির অপার শক্তির বিরুদ্ধে মানুষের যে লড়াই, সেই অসম লড়াইয়ের সবচেয়ে স্মরণীয় সাহিত্যিক সৃষ্টি এই উপন্যাস। মবি-ডিককে শিকার করা যতটা অসম্ভব, হার মেনে নেওয়া উন্মাদ আহাবের পক্ষে যেন আরও অসম্ভব। কিন্তু আবার এও মনে হয়, আহাবকে উন্মাদ বলে কি আমরা নিজেদের সান্ত্বনা দিই যে, সে উন্মাদ হয়ে নিজের জীবনের মানে খুঁজতে চায় আর আমরা শান্তি-সুস্থির জীবনের মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি নিশ্চিন্তে?
আহাবের প্রতিশোধকল্প, দ্রুত এগিয়ে আসতে থাকা সাদা মৃত্যুর মতো বিকট তিমির কল্পনা, দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটা মুহূর্তকে চিন্তা দিয়ে, ব্যাখ্যা দিয়ে, যুক্তি ও গল্প দিয়ে ধরে রাখার চেষ্টা- সব মিলিয়ে শিকারি জাহাজ পিকড ও তার অভিযাত্রীদের মোমের আলোয় লালাভ ও ঢেউয়ের তালে কুয়াশায় দিশেহারা অভিযান হয়ে উঠতে চায় মানবজীবনের সেই অমোঘ জিজ্ঞাসার সমান্তরাল- বেঁচে থাকার মানে কী?
ক্যাপ্টেন আহাবের সেই চিরায়ত সংলাপে তাই আমাদের কেঁপে উঠতে হয়- ঈশ্বরদ্রোহিতার কথা আমাকে বলতে এসো না, স্বয়ং সূর্যকেও আমি আঘাত করব যদি সে আমাকে অপমান করে!
কিন্তু জেমস জয়েসের ইউলিসিস বা পিঞ্চনের গ্র্যাভিটি নয়, বিশ্বকোষসম প্রথম পশ্চিমা উপন্যাসটা আসলে মবি-ডিক। হারমান মেলভিলের এ উপন্যাস প্রথম প্রকাশিত হয় আজ থেকে ঠিক ১৭০ বছর আগে (১৮৫১)। এই বইয়ের পাগলামো আজ এতকাল পরেও পাঠকের কাছে বিস্ময়ই থেকে গেছে। মহান আমেরিকান উপন্যাসের যে ধারা স্কারলেট লেটার বা লাস্ট অব দ্য মোহিকানস থেকে শুরু হয়েছিল, মবি-ডিক সেই ধারাকে নিয়ে গিয়েছিল নতুন উচ্চতায়।
কী নিয়ে আসলে আলাপ করে মবি-ডিক? ওই যুগে আমেরিকার তিমি শিকার নিয়ে হেন তথ্য নেই, যা মবি-ডিকে উঠে আসেনি; বিশেষ করে তিমি ধরার কৌশল, এদের বেড়ে ওঠা, পরিবার গঠনের নিয়ম, তাত্ত্বিক আলোচনার পাশাপাশি তিমি শিকারের চমকপ্রদ বর্ণনা।
উপন্যাসের যে কথক, ইশমায়েল, তার চোখ দিয়ে যেন এক নতুন পৃথিবীর দিকে আমাদের তাকাতে বলেন মেলভিল। একটা জাহাজে বিভিন্ন রকমের নাবিক কাজ করে। এদের আচরণ ও কাজকর্মের নিখুঁত বিবরণে উঠে আসে ওই সময়ের সামাজিক শ্রেণিবিভাগ, শ্রেণিবৈষম্য, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং সংঘর্ষও।
সবকিছু ছাপিয়ে তিমির হাড়ে তৈরি নিজের একটা নকল পায়ে ভর করে দাঁড়িয়ে থাকা ক্যাপ্টেন আহাবকেই আমার বারবার মনে পড়ে। মবি-ডিক নামের এক দানবীয় শ্বেতবর্ণ স্পার্মতিমির সঙ্গে যার অনন্ত বোঝাপড়া বাকি আছে। আছে এক পুরোনো শত্রুতা। বহুদিন আগে এক সমুদ্র অভিযানে এই কিংবদন্তির তিমি তার জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছিল আর আহাব হারিয়েছিল নিজের একটা পা।
তাই আহাবের ধ্যান-জ্ঞান আরেকবার মবি-ডিকের মুখোমুখি হয়ে তাকে পরাজিত করা। সেই প্রায় অলৌকিক বিকটাকৃতির তিমি যেন আহাবের একটা পা খায়নি শুধু, সে আহত করেছে মানুষ হিসেবে আহাবের অহমকেও।
আমার মনে হয়, প্রকৃতির অপার শক্তির বিরুদ্ধে মানুষের যে লড়াই, সেই অসম লড়াইয়ের সবচেয়ে স্মরণীয় সাহিত্যিক সৃষ্টি এই উপন্যাস। মবি-ডিককে শিকার করা যতটা অসম্ভব, হার মেনে নেওয়া উন্মাদ আহাবের পক্ষে যেন আরও অসম্ভব। কিন্তু আবার এও মনে হয়, আহাবকে উন্মাদ বলে কি আমরা নিজেদের সান্ত্বনা দিই যে, সে উন্মাদ হয়ে নিজের জীবনের মানে খুঁজতে চায় আর আমরা শান্তি-সুস্থির জীবনের মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি নিশ্চিন্তে?
আহাবের প্রতিশোধকল্প, দ্রুত এগিয়ে আসতে থাকা সাদা মৃত্যুর মতো বিকট তিমির কল্পনা, দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটা মুহূর্তকে চিন্তা দিয়ে, ব্যাখ্যা দিয়ে, যুক্তি ও গল্প দিয়ে ধরে রাখার চেষ্টা- সব মিলিয়ে শিকারি জাহাজ পিকড ও তার অভিযাত্রীদের মোমের আলোয় লালাভ ও ঢেউয়ের তালে কুয়াশায় দিশেহারা অভিযান হয়ে উঠতে চায় মানবজীবনের সেই অমোঘ জিজ্ঞাসার সমান্তরাল- বেঁচে থাকার মানে কী?
ক্যাপ্টেন আহাবের সেই চিরায়ত সংলাপে তাই আমাদের কেঁপে উঠতে হয়- ঈশ্বরদ্রোহিতার কথা আমাকে বলতে এসো না, স্বয়ং সূর্যকেও আমি আঘাত করব যদি সে আমাকে অপমান করে!
- বিষয় :
- মবি-ডিক