ছোটকাল থেকেই সাফল্য তাঁর সঙ্গী। প্রথম পাবলিক পরীক্ষায় সারাদেশে প্রথম হন। জীবনের প্রতিটি স্তরেই তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। বাংলাদেশ উন্নয়নের বিশ্বতত্ত্বের প্রবক্তা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। বরেণ্য এই ব্যক্তিত্বের একান্ত ভুবন মানুষটির মতোই নিভৃত ও রঙিন। লিখেছেন শাহেরীন আরাফাত

ধানমন্ডি লেকের আশপাশের প্রায় সব বাড়িই এখন বহুতল ভবন। যে দু-একটি পুরোনো বাড়ি এখনও টিকে রয়েছে, তার মধ্যে ৬এ রোডের 'শ্যামলী' একটি। তিনতলা এ বাড়িটিতেই থাকেন দেশের প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। বাড়ির পেছনেই ধানমন্ডি লেক। বর্তমান ঢাকার এমন যান্ত্রিকতা, কৃত্রিমতার মাঝেও যেন ফল ও ফুল গাছে ঘেরা এক টুকরো ছায়ানীড়। কারও ভেতর লুকিয়ে থাকা শিল্পীমনকে বাইরে টেনে আনতে এমন প্রকৃতিই যথেষ্ট, যার প্রমাণ মেলে এক অর্থনীতিবিদের ফেসবুকে প্রকাশিত চিত্রকর্ম ও গানে।

এ প্রসঙ্গে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, "আমি বরাবরই যে কোনো কাজের মাঝে গুনগুন করতাম। এখনও করি। এটা আমার অভ্যাসের মতো। তবে আমি কখনও গান শিখিনি। আমার ভাই গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ গান শিখেছিলেন। তিনি আমার গান শুনে বলেছেন, 'তুই যেহেতু গ্রামার মেনে গান করিস না, গান গাওয়াটা তোর মনের আনন্দ, তাই এখানে একটা স্বতঃস্ম্ফূর্ত আছে। তাই এটা শুনতে খুব ভালো লাগে'।"

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ১৯৪৮ সালের ১ জুলাই নোয়াখালী জেলার রায়পুরে জন্মগ্রহণ করেন। সেখানেই রায়ট হয়েছিল তাঁর জন্মের এক বছর আগে। ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের বাবা ছিলেন সাব-রেজিস্ট্রার। সরকারি চাকরিতে বদলি খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। সেই সূত্রে বিভিন্ন জেলায় গিয়েছেন, পড়েছেন বেশ কয়েকটি স্কুলে। তবে এর মাঝে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর ও অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় তাঁর মনের বিশেষ স্থান জুড়ে রয়েছে। তিনি বলেন, 'এই স্কুলে আমি চার বছর পড়েছি। আমরাই একমাত্র ব্যাচ ছিলাম, যারা এসএসসি দুই বছরে পাস করেছি। ১৯৬২ সালে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে চারটি বিষয় নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় এসএসসি প্রথম পর্ব। পরের বছর দ্বিতীয় পর্ব। তখনও বোর্ড হয়নি। সেখানে আমি গোটা পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছিলাম। পরে শুনেছিলাম, আমার পরীক্ষার খাতা দেখেছিলেন ময়মনসিংহের এক শিক্ষক। তিনি পরে নাকি আমার সঙ্গে দেখা করতেও চেয়েছিলেন। ওই স্যারের শিক্ষার্থীরাই পরে তা জানিয়েছেন। তবে স্যারের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। আমার আরেক ভাইও অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বোর্ড স্ট্যান্ড করেছিলেন।' তিনি আরও বলেন, 'ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছিল খুবই ছিমছাম একটি শহর। ইউরোপে অনেক ছোট ছোট শহর আছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছিল ঠিক সে রকম। রাস্তায় পিচ ছিল না। ছিল কংক্রিটের রাস্তা। খুবই পরিস্কার একটি শহর ছিল, যা এখন দেখে বোঝা যাবে না।'

পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আমি সব পরীক্ষায় প্রথম হয়েছি। তবে এটা কোনো বড় বিষয় না। প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় হওয়া দিয়ে প্রকৃত মেধা যাচাই হওয়া সম্ভব নয়। বরং এটা বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে। সেই সঙ্গে এক রকম চাপও সৃষ্টি হয়।'

উচ্চ মাধ্যমিক ঢাকা কলেজে, স্নাতক করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, অর্থনীতি বিভাগে, স্নাতকোত্তর ইসলামাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রতিটি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছেন রেকর্ড ফলাফলে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে বিলাসী জীবনের হাতছানি উপেক্ষা করে দেশে ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যুক্ত হন। এরপর উন্নয়ন গবেষণা থেকে শুরু করে বহু সরকারি ও রাষ্ট্রীয় কাজে যুক্ত থেকেছেন।

গবেষণাকে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দিলেও দুটো কাজের মধ্যে শিক্ষকতাকেই এগিয়ে রাখবেন বলে জানান ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি বলেন, 'যখন আমার কোনো শিক্ষার্থীকে ভালো কিছু করতে দেখি, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখি, তখন এক ধরনের সুখ অনুভব করি। এটিকে জীবনের এক অর্জন বলে মনে করি।'
ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, 'আমার সবকিছু অত্যন্ত পরিবারকেন্দ্রিক। আমার দুই ছেলে ও এক মেয়ে আসলে আমার সবচেয়ে নিকটতম বন্ধু। আমার স্ত্রীর সঙ্গেও অনেক গবেষণা করেছি। আমার শিক্ষকতা, গবেষণা ও পারিবারিক জীবন অনেকটা মিলেমিশে গেছে।' ঘরে রাখা আছে বহু অ্যান্টিক শোপিস। এগুলো দেখিয়ে তিনি বলেন, 'আমার স্ত্রী গবেষণার কাজে অনেক দেশে যেত। এগুলো তাঁরই আনা।'

অর্থনীতিতে অসামান্য অবদানের জন্য 'বাংলাদেশ ব্যাংক পুরস্কার-২০২০' পেয়েছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় গ্রামীণ অ-কৃষিজ অর্থনীতির দিকে। এরপর তিনি মনোযোগ দিয়েছেন অর্থনীতি, বিশেষত প্রবৃদ্ধি ও সুশাসনের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক বিষয়ক আলোচনায়। 'মার্কেটস, মোরালস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট : রিথিংকিং ইকোনমিকস ফ্রম আ ডেভেলপিং কান্ট্রি পারসপেকটিভ' একটি আকর গ্রন্থ। তিনি বলেন- চীন, সিঙ্গাপুর, হংকংয়ের মতো দেশগুলোতে অনেক অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। এসব দেশে যেভাবে উন্নয়ন হয়েছে, সে পথ অনুসরণ করলেই আমাদের উন্নয়ন হবে- বিষয়টা এমন নয়। প্রতিটি দেশেরই নিজস্ব সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কাঠামো ও মূল্যবোধ থাকে। এটিকে আমলে না নিয়ে চাপিয়ে দিয়ে কোনো অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয় বা সেটি খুবই ক্ষণস্থায়ী হবে।

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের মতে, আমাদের উন্নয়ন হয়েছে, হচ্ছে। তবে সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের দিক থেকে না এগোতে পারলে বাজার ব্যবস্থা বৈষম্য আরও বাড়াবে। এ উন্নয়ন টেকসই হবে না।

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ জানান, আগে গবেষণার সুযোগ কম পেয়েছেন বলে এখন শুধু গবেষণাই করে যেতে চান। এ গবেষণা তাঁকে রাজনৈতিক অর্থনীতির দিকেই ধাবিত করছে। এখন তিনি লিখছেন বাজার ব্যবস্থার নেতিবাচক উপাদানগুলো সরিয়ে কীভাবে বাজারে সমাজতন্ত্র গড়ে তোলা যায়, তা নিয়ে।

লেখালেখির ফাঁকে তাঁর আনন্দের জায়গা হলো চিত্রকর্ম। এ ক্ষেত্রে তিনি ব্যবহার করেন ডিজিটাল রংতুলি। আইপ্যাডে অ্যাপ ব্যবহার করে যে চিত্রকর্ম তিনি সৃষ্টি করেছেন, তা ইতোমধ্যে ফেসবুকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

চিত্রকর্মে সময় দেওয়ার বিষয়ে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, 'কয়েক বছর আগে আমার স্ত্রী (ড. সিমীন মাহমুদ) মারা যান। তখন থেকেই চিত্রকর্মে বেশি সময় দেওয়া শুরু করি।' তিনি আরও জানান, একটি চিত্রকর্ম শেষ করতে কখনও কয়েক ঘণ্টা সময় লাগে। বিদেশে এখন অনেক নামকরা চিত্রশিল্পীও এই ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করছেন বলে জানালেন ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। কখনও ইন্টারনেটে পাওয়া কোনো গানের মিউজিকের সঙ্গে নিজের কণ্ঠ মিলিয়ে রেকর্ড করে তা চিত্রকর্মে যুক্ত করে ফেসবুকে পোস্ট করেন। তাঁর গাওয়া গান ও চিত্রকর্ম ইতোমধ্যে আলোচিত হচ্ছে।