- ফিচার
- চিহ্নমেলা: বাংলা ভাষার সর্ববৃহৎ লিটলম্যাগ সম্মিলন
চিহ্নমেলা: বাংলা ভাষার সর্ববৃহৎ লিটলম্যাগ সম্মিলন

দেশ-বিদেশের দুই শতাধিক লিটলম্যাগ এবং পাঁচ শতাধিক লেখক-পাঠক-সম্পাদকের সমাবেশ ঘটে এবারের মেলায়
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত 'চিহ্ন' বাংলা ভাষার একটি প্রতিনিধিত্বশীল সাহিত্য পত্রিকা। শহীদ ইকবালের সম্পাদনায় যা ২২ বছর ধরে নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে। বছরে চিহ্নের দুটি সংখ্যা বের হয়। 'এসো লিখিয়ে সব, লেখায় লেখায় ভাঙি মগজের কারফিউ' স্লোগানকে সামনে রেখে এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ২০০০ সালের এপ্রিলে। ২০২২ সালের আগস্টে প্রকাশিত হয়েছে ৪৩তম সংখ্যা। এ চর্চারই ধারাবাহিকতায় চিহ্নের যুগবর্ষযাপন উপলক্ষে ২০১১ সালের জানুয়ারিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ্ কলাভবন চত্বরে অর্ধশতাধিক ছোট কাগজ নিয়ে বসেছিল প্রথম চিহ্নমেলা। শতাধিক সম্পাদকের বাইরেও সেখানে হাজির ছিলেন হাসান আজিজুল হক, আসাদ চৌধুরী, সনৎকুমার সাহা, খোন্দকার সিরাজুল হক, জুলফিকার মতিন, মামুন হুসাইনের মতো সাহিত্যিক ও চিন্তকেরা। এ মেলা থেকেই 'মুসলমানমঙ্গল' উপন্যাসের জন্য সৃজনশীল শাখায় চিহ্ন পুরস্কার লাভ করেন জাকির তালুকদার। 'এই বদ্বীপের কবিতাকৃতি' গ্রন্থের জন্য মননশীল শাখায় পুরস্কার পান মামুন মুস্তাফা। এর সঙ্গে চিহ্ন লিটলম্যাগ সম্মাননা পায় সাতটি ছোট কাগজ- সমুজ্জ্বল সুবাতাস, আরণ্যক, পড়শি, ধূলিচিত্র, ভাস্কর, দোআঁশ ও শব্দ। এই পুরস্কার ও সম্মাননা নির্বাচনে চিহ্ন সবসময় আস্থা জানিয়ে এসেছে প্রান্তিকতার প্রতি।
শতাধিক পত্রিকা ও তিন শতাধিক লেখক-সম্পাদকের সম্মিলনে 'চিহ্নমেলা বিশ্ববাঙলা' শিরোনামে এই আয়োজনের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ আসর বসে ২০১৩, ২০১৬ ও ২০১৯ সালে।
এবার ১৬, ১৭ ও ১৮ অক্টোবর পঞ্চমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয় 'চিহ্নমেলা মুক্তবাঙলা'। এই মেলায় দেশ ও দেশের বাইরের দুই শতাধিক লিটলম্যাগ এবং পাঁচ শতাধিক লেখক-পাঠক-সম্পাদকের সমাবেশ ঘটে। তিন দিনব্যাপী মেলার প্রাক-আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ১৬ অক্টোবর পড়ন্ত বেলায়। ফানুস উড়িয়ে উৎসবমুখর পরিবেশের সূচনা করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার। মেলার উদ্বোধন ও বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় ১৭ অক্টোবর সকালে। উদ্বোধন করেন প্রসিদ্ধ লিটলম্যাগ ব্যক্তিত্ব সন্দীপ দত্ত। প্রধান অতিথি ছিলেন দেশবরেণ্য কবি নির্মলেন্দু গুণ। বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার সমাপ্তিতে ছিল 'প্রয়াত প্রিয়জন' শঙ্খ ঘোষ, সৈয়দ শামসুল হক, দেবেশ রায়, আনিসুজ্জামান ও হাসান আজিজুল হককে নিয়ে আড্ডা। আলোচনা করেন নির্মলেন্দু গুণ, সনৎকুমার সাহা, জুলফিকার মতিন, রুহুল আমিন প্রামাণিক, ইমানুল হক ও মোহাম্মদ আজম। এরপর 'সৃষ্টিশীলতার সমাজতত্ত্ব ও লিটলম্যাগ' শিরোনামে বক্তৃতা করেন মোহাম্মদ আজম।
সৈকত হাবিবের সঞ্চালনায় নির্মলেন্দু গুণকে মধ্যমণি রেখে জমে ওঠে 'গল্প ও কবিতাপাঠ'। এতে অংশ নেন ৫০ জনের মতো কবি-গল্পকার। 'ভাষার অনুবাদ, অনুবাদের ভাষা' নিয়ে মোজাফ্ফর হোসেনের সঞ্চালনায় অনুবাদ নিয়ে মতামত রাখেন আলম খোরশেদ, শরীফ আতিক-উজ-জামান, সফিকুল ইসলাম ও প্রত্যয় হামিদ। এদিন সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় পরিবেশিত হয় ইকবাল মতিনের বেহালা। আমিনুর রহমান সুলতানের উপস্থাপনায় সংগীত পরিবেশন করেন কাঙালিনী সুফিয়া; শোনান তাঁর জীবনের কথাও। মেলার তৃতীয় দিন ১৮ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয় 'লিটলম্যাগে লেখালেখি :দ্বৈরথ ও দ্বন্দ্ব' আড্ডা। আসরে বসেন সন্দীপ দত্ত, হোসেনউদ্দীন হোসেন, নারায়ণ রায়, রাজা সহিদুল আসলাম, মনিরুল মনির, মনজু রহমান ও সৈকত হাবিব। এর পরপরই লিটলম্যাগ ব্যক্তিত্ব সন্দীপ দত্ত ও চিহ্ন সম্পাদক শহীদ ইকবালকে মধ্যমণি রেখে চলে গ্রন্থ ও পত্রিকার 'মোড়ক উন্মোচন'। এতে ৪০টির মতো গ্রন্থ-পত্রিকার মোড়ক উন্মোচন করা হয়। বিকেলে রাহেল রাজীবের সঞ্চালনায় থাকে 'গদ্য আখ্যান ও বাংলার গ্রামীণ জীবন' নামে মোস্তাক আহমেদের প্রবন্ধ পাঠ। এ নিয়ে আলোচনা করেন কানাই সেন, তারেক রেজা, এম আবদুল আলীম, মাসুদুল হক ও কাজী রাফি।
বিকেলে অংশগ্রহণকারী পত্রিকার দেশি-বিদেশি সম্পাদকদের চিহ্ন স্মারক দিয়ে শুভেচ্ছা জানান চিহ্ন সম্পাদক শহীদ ইকবাল। সমাপনী সন্ধ্যায় চিহ্ন সাহিত্য পুরস্কার, চিহ্ন সারস্বত সম্মাননা ও চিহ্ন লিটলম্যাগ সম্মাননা দেওয়া হয়। এবারে চিহ্ন সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন কথাসাহিত্যিক হামিদ কায়সার; চিহ্ন সারস্বত সম্মাননায় ভূষিত হন প্রবীণ সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ জুলফিকার মতিন; চিহ্ন লিটলম্যাগ সম্মাননা পায় তৃতীয় চোখ (বাংলাদেশ) ও নৌকো (ভারত)। এদিনের সাংস্কৃতিক আয়োজনে ছিল হাসান রাজার বাঁশি, গানের দল 'মাতাল'-এর দৈশিক পরিবেশনা এবং ড. শ্রদ্ধা নাগের ধ্রুপদি নৃত্যায়োজন। চিহ্নের এই আয়োজন দেশ ও দেশের বাইরের সব সাহিত্যপ্রেমীর জন্য ছিল অবাধ ও উন্মুক্ত। আয়োজকদের মতে, বৃহৎ বঙ্গের সব বাংলাভাষীর তারুণ্যদীপ্ত লিখনশৈলীর পর্যবেক্ষণ ও প্রয়াস এ চিহ্নমেলা মূলত এক ধরনের প্রগতিবাদী লড়াই ও শানিত প্রতিবাদ। া
মন্তব্য করুন