- ফিচার
- সিংড়ার মনোরম পত্রঝরা বন
সিংড়ার মনোরম পত্রঝরা বন

দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে যে কয়টি বনভূমি আজও টিকে আছে, সেগুলোর ভেতর স্বকীয় সৌন্দর্য ও প্রাকৃতিক বিস্ময়ের দিক থেকে সিংড়ার শালবন রয়েছে অনন্য অবস্থানে। দিনাজপুর জেলা শহর থেকে সড়কপথে ৪০ কিলোমিটার উত্তরে, বীরগঞ্জ উপজেলার ভোগনগর ইউনিয়নে এ বনের অবস্থান। শালবনের আধিক্যের কারণে চরিত্রের দিক থেকে তাকে পত্রঝরা বন বলা যায়। ঘন গাছের সন্নিবেশ থাকার পরও গোটা বন প্রায় আলোকিত। বিরাটকার শাল ছাড়াও এখানে রয়েছে- শিমুল, জারুল, মিনজিরি, ঘোড়ানিম, সোনালু, হরীতকী, বহেরা, গামারি, আমলকীসহ চেনা-অচেনা বনজ গুল্ম। গাছের ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ বৃদ্ধ ভাঙা বৃক্ষকাণ্ডের মতো দাঁড়িয়ে আছে বড় বড় উইয়ের ঢিবি। এখানকার মতো বৃহৎ আকারের ঢিবি দেশের অন্যান্য বনাংশে সচরাচর দেখা যায় না বলে স্থানীয়রা জানান।
বনের নান্দনিকতার অন্যতম উৎস নর্ত নদী। বনের বাইরে এর শরীর খালের মতো সরু দেখালেও বনের ভেতর এর সর্পিলাকার বিস্তৃতি, কোথাও কোথাও প্রসারতা রয়েছে। খরার মৌসুমের ক্ষীণ জলধারা স্বভাবতই বর্ষায় আরও স্রোত ও প্রসারতা পায়। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৭ কিলোমিটার এবং গড় প্রস্থ ১৫ মিটার। পানি উন্নয়ন বোর্ড নির্ধারিত পরিচিতি নম্বর ৬২।
বনের সীমাঘেঁষে লোকবসতি রয়েছে। এসব বসতির মানুষজন অনিবার্যভাবে বনের ওপর নির্ভরশীল। নর্ত নদীর প্রবাহকে উপজীব্য করে বনের কিনারে শস্যের চাষ করা হয় যেগুলোর ভেতর ধান প্রধান। কিছু আদিবাসী সাঁওতাল গোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে- যাঁরা পশুপালন, চাষবাসসহ প্রকৃতিঘেঁষা জীবনযাপন করেন। ছোট শিশুরা বনের ভেতর ঘুরে বেড়িয়ে ডালপালা, পাতা, বীজ সংগ্রহ করে। সিংড়া বনে মে মাসে এক অপূর্ব ঘটনা ঘটে। কিনারের শিমুল গাছগুলো যখন ফুলে ফুলে ছেয়ে যায়, ঝোড়ো বাতাস বয়ে গেলে ফুলগুলো মঞ্জরি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তুষারের মতো ঝরতে থাকে। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে মাঝবয়সী চাষি, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সবাই ছোটাছুটি করে সেই শিমুল তুলা সংগ্রহ করতে থাকেন। একটা আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্ট হয়।
এ বন একসময় বহু বর্ণিল বন্যপ্রাণী ও পাখি, সরীসৃপ মুখর ছিল। আজ তাদের অনেকেই বিলুপ্তির পথে। এ বনে একসময় বাঘ ছিল বলে স্থানীয়দের কাছে শোনা যায়। এখন অল্পসংখ্যক শিকারি মেছোবাঘ চোখে পড়ে। কিছু ঐতিহাসিক সূত্র নীলগাইয়ের উপস্থিতির কথাও বলে। আরও কিছু প্রাণী যেমন বানর, শূকর, হরিণ, বনগরু প্রভৃতিও ছিল বলে জানা যায়; তবে কিছু বানর গোত্রীয় প্রাণী ছাড়া তেমন কিছু আর চোখে পড়ে না। বনকে রক্ষা করে তার হিংস্র প্রাণী। তেমন প্রাণীরা বিলুপ্ত হয়ে পড়ায় মানুষের অবাধ আনাগোনা বনের সহজাত বৃদ্ধিকে প্রতিনিয়ত ব্যাহত করছে বলেই মনে হয়।
কিছু পাখির কথা বলা যাক। এ বনে হাঁড়িচাচা, খুরুলে পেঁচা, তিলা ঘুঘু, বেনে বউ, লম্বা লেজ রাতচরা প্রভৃতি পাখি দেখা যায়। একটি বিশেষ পাখি শকুন- বাংলাদেশ থেকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় পরিবেশের ভারসাম্য টলে উঠেছে। সিংড়া বনের সূচনাপ্রান্তে বাংলাদেশ বন বিভাগ ও আইইউসিএনের যৌথ তত্ত্বাবধানে একটা শকুন উদ্ধার ও পরিচর্যা কেন্দ্র রয়েছে। মুমূর্ষু শকুন এখানে পরিচর্যা পেয়ে প্রকৃতিতে ফিরে যায়। সিংড়ার শালবনের মোট আয়তন প্রায় ৩৫৫ হেক্টর, যার ৩০৫.৬৯ হেক্টর বনাঞ্চল সংরক্ষিত জাতীয় উদ্যান হিসেবে স্বীকৃত। ২০১০ সালের ১০ অক্টোবর এ স্বীকৃতি আসে। চারটি মৌজায় বিভক্ত এ বন। ডালাগ্রাম, চাউলিয়া, সিংড়া ও নর্ত নদী। ব্রিটিশ শাসন চলাকালে ১৮৮৫ সালে সিংড়ার বন, বনাঞ্চল হিসেবে অধিভুক্ত হয় এবং স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে এ বনকে বনবিভাগের আওতায় এনে গেজেট প্রকাশ করা হয়। বনের সিংড়া মৌজার নাম অনুসারে বনাঞ্চলের নাম করা হয় সিংড়া জাতীয় উদ্যান।
সারা বছর পর্যটকের আনাগোনা চোখে পড়ে। থাকার সুবিধার্থে এখানে একটি রেস্ট হাউস ও দুটি পিকনিক স্পট রয়েছে। বনের প্রবেশ পথে নর্ত নদীর ওপর ছোট নান্দনিক একটি সেতু রয়েছে। বিকেলে স্থানীয় ও পর্যটকের সমাগম ঘটে অল্পবিস্তর।
মন্তব্য করুন